

0203jingji.m4a
|
একুশ শ' বছর আগে হান রাজবংশের দূত চাং ছিয়েন দু'বার পশ্চিমা অঞ্চলে সফর করেন এবং রেশমপথের সূচনা করেন। এরপর এ পথ চীন ও পশ্চিমা বিশ্বের বিনিময়ের প্রধান সড়কে পরিণত হয়। বিশ্বের অনেক দেশ এর মাধ্যমে চীনকে জানতে পারে। ১৩শ' বছর আগে থাং রাজবংশের প্রখ্যাত বৌদ্ধভিক্ষু হিউয়েন সাং রেশমপথ দিয়ে ভারত যান এবং বৌদ্ধ ধর্মের গ্রন্থ চীনে নিয়ে আসেন। রেশমপথ আবার চীন ও বিদেশের সাংস্কৃতিক বিনিময়ের ক্ষেত্রেও অবদান রাখে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের ওপর ব্যাপক প্রভাববিস্তারকারী রেশমপথ এখন আবার মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং কাজাখস্তান, তুর্কমেনিস্তান, কিরগিজস্তান আর উজবেকিস্তান - এ চারটি মধ্য এশীয় দেশ সফর করেন এবং কাজাখস্তানের নাজারবায়েভ বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দেন। বক্তৃতায় সি চিন পিং প্রথম বারের মতো যৌথভাবে ইউরোপ ও এশিয়া অতিক্রমকারী রেশমপথ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার ধারণা উত্থাপন করেন।
তিনি বলেন, "ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক যোগাযোগ আরো নিবিড় করা, পারস্পরিক সহযোগিতা আরো গভীর করা এবং উন্নয়নের সুযোগ আরো বিস্তীর্ণ করার উদ্দেশ্যে আমরা নতুন সহযোগিতার পদ্ধতিতে যৌথভাবে রেশমপথ অর্থনৈতিক এলাকা প্রতিষ্ঠা করতে পারবো। এটা হবে অঞ্চলের জনগণের কল্যাণ সৃষ্টির এক মহান কাজ।"
রেশমপথ অর্থনৈতিক অঞ্চলের ধারণা ব্যাখ্যা করে চীনের আধুনিক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক গবেষণা এ্যাকাডেমির ইউরোপ ও এশিয়া গবেষণা কেন্দ্রের মি. ওয়াং লি চিউ বলেন, "আমি মনে করি, এ ধারণার দুটি বৈশিষ্ট্য আছে। একটা হচ্ছে তার বিষয়বস্তু সমৃদ্ধ। আরেকটা হচ্ছে এ অঞ্চলের ব্যাপকতা আছে। ভবিষ্যতে এ অঞ্চলের দেশগুলোর নীতিগত যোগাযোগ, সড়ক যোগাযোগ, বাণিজ্যিক যোগাযোগ, মুদ্রার যোগাযোগ ও জনগণের মনের যোগাযোগ বাস্তবায়িত হবে। এ ভিত্তিতে আমরা ইতিহাসের রেশমপথকে মিলনসূত্র হিসেবে কাজে লাগাবো এবং বর্তমান উপায়ে অতীতের রেশমপথকে আরো সমৃদ্ধ করবো।"
এখন চীন ও মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন দেশ এবং রাশিয়া সবাই সহযোগিতা জোরদার করা এবং অর্থনীতি উন্নয়ন অর্জনের গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্যের সামনে আছে। এ অঞ্চলের দেশগুলোর সহযোগিতা জোরদার করার সাথে সাথে তত্কালীন রেশমপথ আবার ফুটে উঠেছে। এক নতুন অর্থনৈতিক উন্নয়ন অঞ্চল হিসেবে রেশমপথ অর্থনৈতিক অঞ্চলের পূর্ব দিক হচ্ছে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অর্থনৈতিক বলয় এবং পশ্চিম দিক হচ্ছে উন্নত ইউরোপীয় অর্থনৈতিক বলয়। এ অর্থনৈতিক অঞ্চলকে পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘ এবং উন্নয়নের সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা-সমৃদ্ধ অর্থনৈতিক অঞ্চল বলে মনে করা হচ্ছে। এটা কেবল একটি সরু পথ নয়, এটা হচ্ছে আধুনিক সড়ক, রেলপথ, বিমানপথ এবং গ্যাস পাইপলাইন নিয়ে গঠিত ত্রিমাত্রিক পথ। এ পথ ইউরোপ ও এশিয়া অতিক্রম করেছে। ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক উ থিয়েন হুই এ সম্পর্কে বলেন, "২১০০ বছর আগে চাং ছিয়েনের অভিযানের মধ্য দিয়ে প্রাচ্য ও পশ্চিমের এ প্রধান পথের সূচনা হয়। এ পথ দিয়ে কেবল পণ্য স্থানান্তর হয়নি; এটা সাংস্কৃতিক বিনিময়ের পথও বটে। এখন বিশ্বে বহুপক্ষীয় বাণিজ্যিক ব্যবস্থা চলছে। যদি রেশমপথ সুগম হয়, তাহলে এ পথ-সংলগ্ন দেশগুলো সংযুক্ত হবে। ভিন্ন দেশের ভিন্ন অঞ্চলের ভিন্ন জাতির মানুষের মেলামেশা আরও গভীর হবে।"
গত বছরের সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত শাংহাই সহযোগিতা সংস্থার বিশকেক শীর্ষ সম্মেলনে সদস্য দেশগুলো রেশমপথ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার ধারণা বিষয়ে মতৈক্যে পৌঁছায়। শাংহাই সহযোগিতা সংস্থা হচ্ছে চীন, রাশিয়া, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, তাজিকিস্তান ও উজবেকিস্তান নিয়ে গঠিত একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা। এ সংস্থার পাঁচটি পর্যবেক্ষক দেশ আছে। সেগুলো হচ্ছে ইরান, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, মঙ্গোলিয়া ও ভারত। সদস্য দেশগুলোর মোট আয়তন হচ্ছে ৩ কোটি ১ লাখ ৮৯ হাজার বর্গকিলোমিটার, অর্থাত্ ইউরোপ ও এশিয়ার মোট আয়তনের তিন-পঞ্চমাংশ। এ অঞ্চলের জনসংখ্যা প্রায় ১৬০ কোটি, যেটা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ।
উ দা হুই বলেন, "আমি মনে করি, প্রাচীনকালের রেশমপথের সাংস্কৃতিক চেতনা আর বর্তমান শাংহাই সহযোগিতা সংস্থার চেতনা একই ধরনের। সেটা হচ্ছে পারস্পরিক আস্থা, উপকারিতা, সমতা, আলোচনা, ভিন্ন সভ্যতাকে সম্মান করা এবং অভিন্ন উন্নয়ন অন্বেষণ করা। এ থেকে শাংহাই চেতনা প্রতিফলিত হয়। আমরা শাংহাই সহযোগিতা সংস্থার ভিত্তিতে মধ্য এশিয়া থেকে রওনা হয়ে পশ্চিমের ইউরোপ ও বাল্টিক সাগরের তীরে যাবো, মধ্যপ্রাচ্য প্রবেশ করবো, এরপর পশ্চিম এশিয়া, ভারত মহাসাগর ও পারস্য উপসাগর যাবো।"
রেশমপথ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করার ধারণা শাংহাই সহযোগিতা সংস্থার উন্নয়নের জন্য নতুন বিষয় ও প্রাণশক্তি যুগিয়েছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রশান্ত মহাসাগর থেকে বাল্টিক সাগরগামী পরিবহণের পথ সুগম করার জন্য শাংহাই সহযোগিতা সংস্থা নতুন পরিবহণ সহজায়ন চুক্তি নিয়ে আলোচনা করছে। চীনের প্রতিরক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাং সিয়াং ছিং বলেন, "যদি পরিবহনের পথ সুগম না হয়, তাহলে এ অর্থনৈতিক অঞ্চল উন্নয়নের বিশাল বাধার সম্মুখীন হবে। তাছাড়া, আরো অনেক ক্ষেত্রের সমস্যা রয়েছে। যেমন মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়নের মান ভিন্ন। সেই দেশগুলোর সমস্যার বড় তফাত্ আছে। এ অর্থনৈতিক অঞ্চলের পথ সুগম করতে চাইলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা দরকার, যাতে আরো দ্রুত ও সুষ্ঠুভাবে অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা সম্পন্ন করা যায়।"
শাংহাই সহযোগিতা সংস্থা ছাড়া চীন ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আরেকটি বহুপক্ষীয় বিনিময়ের প্লাটফর্ম আছে। সেটি হচ্ছে ইউরোপ-এশিয়া অর্থনৈতিক ফোরাম। এ ফোরামের উদ্দেশ্য হচ্ছে ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশের পারস্পরিক বোঝাপড়া ও সহযোগিতা বাড়ানো। এ ফোরাম শাংহাই সহযোগিতা সংস্থার সদস্য দেশ ও পর্যবেক্ষক দেশগুলো নিয়ে গঠিত বিস্তীর্ণ ইউরোপ ও এশীয় অঞ্চল অন্তর্ভুক্তকারী একটি উচ্চ-পর্যায়ের আন্তর্জাতিক সম্মেলন।
ইউরোপ-এশিয়া অর্থনৈতিক ফোরাম ২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর প্রতি দু'বছরে একবার এ ফোরাম আয়োজন করা হয়। গত বছর পঞ্চম ইউরোপ-এশিয়া অর্থনৈতিক ফোরাম পশ্চিম চীনের সি'আন শহরে অনুষ্ঠিত হয়। ফোরামে রেশমপথ অর্থনৈতিক অঞ্চল বিভিন্ন পক্ষের প্রতিনিধিদের অন্যতম আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয় এবং অবশেষে 'রেশমপথ অর্থনৈতিক অঞ্চল বিষয়ক যৌথ সি'আন ঘোষণা' গৃহীত হয়।
চীনের উপপ্রধানমন্ত্রী ওয়াং ইয়াং ওই ফোরামে বলেন, "এখন আমাদের সামনের অভিন্ন কর্তব্য হচ্ছে আরো অটল সংকল্প এবং আরো বাস্তব ব্যবস্থা নিয়ে এ অঞ্চলে আরো ব্যাপক আওতার ও আরো উচ্চ-মানের সহযোগিতা সম্প্রসারণ করা এবং রেশমপথ অর্থনৈতিক অঞ্চলের ধারণা থেকে যথাশিগগির ব্যাপক সুবিধা সৃষ্টি করা। এ অভিন্ন লক্ষ্য অর্জনের প্রস্তাব দিচ্ছি আমি। প্রথম, পারস্পরিক রাজনৈতিক আস্থার দৃঢ় ভিত্তি থাকতে হবে। দ্বিতীয়, অভিন্ন উন্নয়নকে কেন্দ্র হিসেবে গণ্য করতে হবে। তৃতীয়, দৃঢ়ভাবে উন্মুক্তকরণ সম্প্রসারণের চালিকাশক্তি হাতে নিতে হবে। চতুর্থ, একে দৃঢ়ভাবে সাংস্কৃতিক বিনিময়ের মিলনসূত্র হিসাবে গণ্য করতে হবে।"
রেশমপথ অর্থনৈতিক অঞ্চলের নির্মাণ ইউরোপ ও এশিয়ার ৩০০ কোটি জনসংখ্যার বিশাল বাজারে ছড়িয়ে যাবে। তবে এ নির্মাণে সুদীর্ঘ সময় লাগবে। ইতিহাসে রেশমপথে কঠোর প্রাকৃতিক অবস্থা ছিলো। দাঙ্গাহাঙ্গামা রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিলো। ঘন ঘন যুদ্ধ ঘটতো। ফলে কেবল রেশমের মতো বিলাসদ্রব্যের বাণিজ্য এ পথে যথেষ্ঠ মুনাফা অর্জন করতে পারতো। আজ পর্যন্ত স্থলপথে বিপুল পরিমাণ ও দীর্ঘ দূরত্বের পরিবহণের উপায় নৌপরিবহণের মতো উন্নত হয়নি। তাছাড়া সড়কপথ দিয়ে বহু দেশ অতিক্রম করার সময় শুল্ক বিভাগের কার্যপ্রক্রিয়াও খুব জটিল। ফলে রেশমপথ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার বিশেষ তাত্পর্য আছে। (ইয়ু/এসআর)

| ||||



