Web bengali.cri.cn   
চীনের তরুণ চলচ্চিত্র পরিচালক লি রুই চুন
  2015-07-09 19:03:58  cri



চীনের তরুণ চলচ্চিত্র পরিচালক লি রুই চুনের বর্তমান বয়স মাত্র ৩২ বছর, তবে ইতোমধ্যেই তিনি ৪টি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছেন।

লি: ভেনিস, বার্লিন ও টোকিও চলচ্চিত্র উত্সবে অংশগ্রহণকারী এই তরুণ চলচ্চিত্র পরিচালক তার শিল্পকর্মে শহরায়নের প্রক্রিয়ায় ধাপে ধাপে বিস্মৃত হয়ে যাওয়া গ্রামীণ জীবনকে তুলে ধরেছেন।

অনেক স্বাধীন চলচ্চিত্র পরিচালকের মতো লি রুই চুনেরও সৃষ্টির অনুপ্রেরণা বাস্তব জীবন থেকে। তার চলচ্চিত্রে তিনি জীবনের প্রখর পর্যবেক্ষণ এবং মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা এক একটি গল্প তুলে ধরেছে।

'রিভার রোড' চলচ্চিত্রটি হলো লি রুই চুনের চতুর্থ শিল্পকর্ম। এতে দু'জন ভাইয়ের মরুভূমিতে বাবাকে খুঁজে বের করার গল্প তুলে ধরা হয়। এই চলচ্চিত্র প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে লি রুই চুন তার নিজের শৈশবের কথা স্মৃতিচারণ করেন।

তার ক্যামেরায় তিনি তার নিজের জন্মস্থান চীনের কান সু প্রদেশের কাও থাইয়ের গল্প তুলে ধরেছেন। লি রুই চুনের স্মৃতিতে তার জন্মস্থান এবং বেড়ে ওঠা সেই গ্রামের কাছাকাছি একটি ছোট আকারের মরুভূমি ছিলো। এই গ্রাম এবং এই মরুভূমিতে বাস করতেন ইউ কু উপজাতির লোক।

বর্তমানে ইউ কু উপজাতির লোকসংখ্যা মাত্র ১৪ হাজার। তারা প্রধানত কান সু প্রদেশের চাং ইয়ে শহরের ইউ কু উপজাতির স্বায়ত্তশাসিত জেলায় বসবাস করেন।

চীনের ইতিহাসে এই জাতির ইতিহাস অনেক উজ্জ্বল। খৃষ্টীয় ৯ শতাব্দীর কাছাকাছি সময় ইউ কু জাতি রেশম পথে কানচৌ উইগুর রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তবে এই রাজ্য সিসিয়া বংশে বিলুপ্ত হয়ে যায়। তখন থেকে কানচৌ উইগুর জাতির বংশধর চাং ইয়ে শহরের কাছাকাছি এলাকায় বাস করা শুরু করেন।

এই জাতি সম্পর্কে মানুষের জানাশোনা তেমন বেশি নয়। অবশেষে অনেক ঘটনার মধ্য দিয়ে ১৯৫৩ সালে আবার নতুন করে 'ইউ কু জাতি' এই নাম নির্ধারণ করা হয়।

তৃণভূমির মরুকরণ এবং শহরায়নের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে লি রু চুন কিছু বেদনাদায়ক পরিবর্তন লক্ষ্য করেন। ক্রমাগতভাবে তৃণভূমি ধ্বংস করার কারণে ইউ কু জাতি আরো দূরের জায়গায় যেতে বাধ্য হন। এতে এই জাতি এবং তাদের ঘোড়ায় চড়ে বেড়ানোর সেই দৃশ্য ধীরে ধীরে বিলীন হতে থাকে।

বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে ইউ কু জাতির তরুণ তরুণীরা হান ভাষা শিখতে শুরু করেন। আর এতে নীরবে নিভৃতে তাদের কাছ থেকে হারিয়ে যেতে থাকে তাদের নিজ জাতির ভাষা।

এই অবস্থা দেখে লি রুই চুন ইউ কু জাতির ভাষা দিয়ে তাদের জাতি সম্পর্কে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নেন। তবে অত্যন্ত দু:খের বিষয় হলো, এতে তিনি এমন একজন লোককেও খুঁজে পেতে ব্যর্থ হন যিনি কিনা সাবলীলভাবে ইউ কু ভাষা বলতে পারেন। কোনো উপায় না পেয়ে তিনি ৮০ বছর বয়সী এক বৃদ্ধের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন। সেই বৃদ্ধ চলচ্চিত্রের সব সংলাপ রেকর্ড করেন, তারপর চলচ্চিত্রের প্রধান অভিনেতা তার রেকর্ড অনুযায়ী ইউ কু ভাষার উচ্চারণ অনুকরণ করেন।

শুধু ভাষা নয়, ইউ কু জাতির সবচেয়ে সাধারণ যানবাহন হিসেবে পরিচিত উট তার চলচ্চিত্র পরিচালনার প্রক্রিয়ায় একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

তৃণভূমির মরুকরণ এবং সেসব জমিকে আবাদি জমিতে রূপান্তর করার সঙ্গে সঙ্গে আগেকার যাযাবর জাতি বর্তমান জেলার বাসিন্দাতে পরিণত হন। বয়স্করা জমিতে চাষ করেন এবং তরুণ-তরুণীরা বাইরে বড় বড় শহরে চাকরি করেন।

চলচ্চিত্রটি শুটিং করার সময় উটে চড়তে সক্ষম এমন কাউকে খুঁজে পান না তিনি। এতসব প্রতিকূলতা সত্ত্বেও লি রুই চুন 'রিভার রোড' চলচ্চিত্রে অভিনয় করার জন্য ইউ কু জাতির জনগণকে যুক্ত করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেন।

'রিভার রোড' চলচ্চিত্র নির্মাণ নিয়ে লি রুই চুন অসহায়ত্ব বোধ করেন। করণ তিনি চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বাস্তবতা তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলেন, তবে এখন চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তিনি বাস্তবতা সৃষ্টি ও পুনর্নির্মাণ করতে বাধ্য হন।

এই চলচ্চিত্রটি বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, শিশু ও মাটির সঙ্গে জড়িত। পরিচালক লি রুই চুনের চোখে বর্তমানে চীনের গ্রামাঞ্চলের বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ও শিশুরা হলো দুটি বৃহত্তম দল। তবে এ দুটি দল হলো জীবনের দুর্বল দল। তাদের প্রতি সারা সমাজের খুব যত্ন দরকার বলে তিনি মনে করেন।

'রিভার রোড' চলচ্চিত্রটি চলতি বছরের টোকিও আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সবের প্রধান প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় এবং জাপানে এ ছবির কপিরাইট বিক্রি করা হয়।

২০১৫ সালের প্রথম দিকে শিশু বিষয়ক 'রিভার রোড' নামের এ চলচ্চিত্রটি বার্লিন চলচ্চিত্র উত্সবের 'ক্রিস্টাল বিয়ার অ্যাওয়ার্ড' প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়।

আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সবের নিয়মিত অতিথি হওয়া সত্ত্বেও লি রুই চুনের নামটি অধিকাংশ চীনা দর্শকদের কাছে তেমন সুপরিচিত নয়।

২০১৫ সালের বার্লিন চলচ্চিত্র উত্সবে জার্মান শিশুদের জন্য 'রিভার রোড' চলচ্চিত্রটি প্রদর্শন করা হয়। শিশুরা এ চলচ্চিত্র পছন্দ করবে কিনা তা নিয়ে প্রথম দিকে কিছুটা উদ্বিগ্ন ছিলেন লি রুই চুন। তবে বাস্তবতা থেকে প্রতিফলিত হয় যে, তার উদ্বেগ ছিল একটু অতিরিক্ত। ছোট জার্মান দর্শকরা অত্যন্ত শান্তভাবে গোটা চলচ্চিত্র উপভোগ করেন এবং সুশৃঙ্খলভাবে চলচ্চিত্র পরিচালককে প্রশ্ন করেন এবং তার সঙ্গে ছবি তোলেন।

লি রুই চুন মনে করেন, কেবল এমন ধরনের দর্শক থাকলেই বার্লিন চলচ্চিত্র উত্সব নতুন করে জন্মগ্রহণ করতে পারে। অন্যভাবে বলা যায়, বার্লিন চলচ্চিত্র উত্সব থাকলে এমন ধরনের দর্শকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়।

জার্মান দর্শকরা ছোটবেলা থেকে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ও বিভিন্ন সংস্কৃতির দিক থেকে বিভিন্ন পদ্ধতিতে নির্মিত চলচ্চিত্রগুলো উপভোগ করতে পারেন। তাই খুব সহজেই বোঝা যায়, কেন ইউরোপীয় দেশগুলোতে চলচ্চিত্র এবং চলচ্চিত্রের দর্শক এত বহুবিধ।

লি রুই চুনের কাছে বক্সঅফিস বা চলচ্চিত্র উত্সবের পুরস্কার তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। তিনি মনে করেন, এসব কিছু চলচ্চিত্রের সত্যিকার মূল্য নির্ধারণ করতে পারে না এবং চলচ্চিত্রকে পেশা হিসেবে বাছাই করার ক্ষেত্রে মানুষের আগ্রহে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না।

তিনি বলেন, 'চলচ্চিত্র ভালোবাসলে, আশেপাশের পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করলে এবং কোনো একটি ভালো কাহিনী দর্শকদের কাছে তুলে ধরতে চাইলে কোনো পুঁজি বিনিয়োগ করা ছাড়াই চলচ্চিত্র শুটিং করা যায়'।

লি রুই চুন ৭ বছরের মধ্যে চারটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। তার কাছে চলচ্চিত্র শুটিং করা হলো জীবনের সহজাত প্রবৃত্তি, যেন মানুষের নিয়মিত নাস্তা, লাঞ্চ ও ডিনার খাওয়ার মতো।

একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা হতে চাইলে কোন গুনটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ? এই প্রশ্নের উত্তরে লি রুই চুন বলেন, 'আমি মনে করি, এটি জীবন, আশেপাশের মানুষ ও এই পৃথিবীর প্রতি আপনার ভালোবাসার মাত্রার ওপর নির্ভর করে। সবকিছুর প্রতি মনে সবসময়ই গভীর ভালোবাসা রাখতে হবে। একজন চলচ্চিত্র নির্মাতার এটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গুণ বলে আমি মনে করি'। (লিলি/টুটুল)

সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন
মন্তব্যের পাতা
ভিডিও চিত্র
সাক্ষাত্কার
চিঠিপত্র
Play Stop
© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040