Web bengali.cri.cn   
চন্দ্রবীর নিল আর্মস্ট্রংয়ের জীবনাবসান
  2012-09-10 18:53:55  cri

 

যাঁর পা চাঁদের মাটি স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে মানবজাতি পৌঁছে গিয়েছিল অনন্য উচ্চতায়, মেতেছিল চন্দ্রজয়ের অপার আনন্দে, সেই নিল আর্মস্ট্রং আর নেই। ৮২ বছর বয়সে গত ২৫ আগস্ট তিনি পৃথিবীর মায়া ছেড়ে পাড়ি দিয়েছেন অজানা গন্তব্যে।

হয়তো অনেকেই জানেন, চাঁদে পা রাখার মুহূর্তকে তিনি বর্ণনা করেছেন মানুষের জন্য 'একটি ছোট পদক্ষেপ' কিন্তু মানবজাতির একটি 'বিশাল অগ্রগতি' হিসেবে।

অ্যাপোলো-১১ এর চন্দ্র অভিযানে বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত মানুষ বনে যাওয়া নিল আলডেন আর্মস্ট্রং ১৯৩০ সালের ৫ অগাস্ট ওহাইওতে জন্ম গ্রহণ করেন। স্টিফেন ও ভায়োলা আর্মস্ট্রংয়ের তিন সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে বড় নিলের ছোটবেলা থেকেই প্রবল ইচ্ছা ছিল আকাশে ওড়ার।

বাবার সঙ্গে ছয় বছর বয়সে বিমানে ওড়া আর্মস্ট্রং ১৬ বছর বয়সেই তা চালানো শিখে ফেলেন। গাড়ি চালানোর লাইসেন্স পাওয়ার আগেই রপ্ত হয়ে যায় 'ওড়ার' কায়দা।

আর্মস্ট্রংয়ের বেড়ে ওঠা ওহাইওতেই। স্কুলে বিজ্ঞান ও অংকে খুবই ভালো ফল করে বলে তিনি মার্কিন নৌবাহিনীর বৃত্তি পেয়েছেন এবং ১৯৪৭ সালে ইন্ডিয়ানার পারডু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যান । দু' বছর পর নৌবাহিনীর পাইলট হিসেবে কোরীয় যুদ্ধে অংশ নেন তিনি। যুদ্ধ বিমান চালনায় অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য তিনটি মেডেলও পান।

এবং কোরীয় যুদ্ধ থেকে ফেরার পর ১৯৫৫ সালে পারডু থেকে অ্যারোনটিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক শেষ করেন। এরপর তিনি ন্যাশনাল অ্যাডভাইসরি কমিটি অন অ্যারোনটিকস (এনএসিএ) যোগ দেন, যা পরে নাসায় রূপ নেয়।

নাসায় সাত বছর পরীক্ষামূলক পাইলট হিসেবে কাজ করার সময় আর্মস্ট্রং অসামান্য সাফল্য অর্জন করেন । যখন তিনি ৩৫ বছর বয়সে, তখন তার মহাকাশ অভিযান শুরু হয়; ১৯৬৬ সালের ১৬ মার্চ মহাশূন্যযান জেমিনি-৮ দিয়ে।

যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ সংস্থা নাসার বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য অনুযায়ী, অ্যাপোলো ১১ মিশনের অধিনায়ক আর্মস্টংয়ের দক্ষতার সঙ্গে চন্দ্রযান নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছিলেন বলেই মানুষের পক্ষে ওই অভিযানে চাঁদে নামা সম্ভব হয়। স্বয়ংক্রিয় যান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার বদলে তিনি নিজেই লুনার মডিউল ঈগলের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিলেন। তা খুব বিপদজনক ব্যাপার। আর্মস্ট্রং যখন 'সি অব ট্রানকুইলিটি' নামে পরিচিত অবতরণস্থলে ঈগলকে নামান- তখন কেবল ৩০ সেকেন্ডের জ্বালানি অবশিষ্ট ছিল।

এবং চাঁদে নেমে আর্মস্ট্রং নাসার মিশন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে পাঠান বিখ্যাত সেই রেডিও বার্তা, হয়তো রেডিওর সামনে অনেক শ্রোতা এ কথা মুখস্ত হয়েছেন, তা হল "দ্য ঈগল হ্যাজ ল্যান্ডেড।"

এরপরই চাঁদে আর্মস্ট্রংয়ের সেই বিখ্যাত 'ছোট' পদক্ষেপ যা মানবজাতিকে পৌঁছে দিয়েছিল অনেকদূর। ১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই চাঁদে মানুষের প্রথম পদচিহ্ন এঁকে দেন তিনি। চাঁদে পা রাখার মুহূর্তকে তিনি বর্ণনা করেছেন মানুষের জন্য 'একটি ছোট পদক্ষেপ' কিন্তু মানবজাতির একটি 'বিশাল অগ্রগতি' হিসেবে।

আর্মস্ট্রাং একাই চাঁদ অনুসন্ধ্যান করেন তা নয়, তাঁর সঙ্গী এডইউন অলড্রিনের সঙ্গে প্রায় তিন ঘণ্টা চাঁদে বিচরণ করেন আর্মস্ট্রং। চাঁদের নামার অভিজ্ঞতা নিয়ে সিবিএসকে তিনি বলেছিলেন, "যাওয়ার জন্য চাঁদ একটি মজার জায়গা। আমি সেখানে সবাইকে যেতে বলব!"

আর্মস্ট্রংয়ের নামে পরে চাঁদের একটি খাদের নামকরণ করা হয়। ঈগলের অবতরণস্থলের ৩০ মাইল দূরে সেই খাদের অবস্থান।

অ্যাপোলো ১১ মিশন শেষে মহাশূন্য অভিযান থেকে সরে এসে নাসার উন্নত গবেষণা ও প্রযুক্তি বিভাগে উপ-সহযোগী প্রশাসক হিসেবে যোগ দেন আর্মস্ট্রং। পরের বছরেই নাসা ছেড়ে দিয়ে সিনসিনাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকৌশলের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন তিনি। স্ত্রী ক্যারলের সঙ্গে থাকতেন সিনসিনাটিতেই।

এত মহান কাজ সম্পন্ন করেছেন, সাধারণ মানুষের মতে আর্মস্ট্রাং নিশ্চয়ই বিখ্যাত হয়েছেন এবং এরপর ঘন ঘনভাবে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন এবং অনেক টাকাপয়সা পাবেন। তবে চন্দ্র অভিযানের পর বলতে গেলে নিভৃত জীবন কাটিয়েছেন চন্দ্রজয়ী এ বীর। জনসম্মুখে এসেছেন কদাচিৎ।

আর্মস্ট্রং কখনই তার খ্যাতির কোনো সুবিধা নিতে চাননি। একবার কেবল তিনি গাড়ি নির্মাতা মার্কিন প্রতিষ্ঠান ক্রাইসলারের হয়ে টিভি বিজ্ঞাপন করেছিলেন। পরে তিনি বলেছিলেন, ক্রাইসলারের প্রকৌশলে অগ্রগতির ইতিহাসে আকৃষ্ট হয়ে এ কোম্পানির অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে সহায়তা করতেই বিজ্ঞাপনে অংশ নিয়েছিলেন তিনি।

২০০৫ সালে আর্মস্ট্রংয়ের এক গুচ্ছ চুল এক সংগ্রাহকের কাছে ৩ হাজার ডলারে বিক্রি করেন তার নাপিত। এ ঘটনায় আর্মস্ট্রং ব্যথিত হলেও ওই সংগ্রাহক তা ফিরিয়ে দিতে অস্বীকার করেন।

রাজনীতিতে আসার জন্য আর্মস্ট্রংকে অনেক বার সাধা হয়েছে। প্রতিবারই তিনি প্রস্তাবগুলো ফিরিয়ে দিয়েছেন। ১৯৮৬ সালে উড্ডয়নের পরপরই স্পেস শাটল চ্যালেঞ্জার বিস্ফোরণে সাত আরোহীর মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে গঠিত তদন্ত কমিশনে তিনি সদস্য হিসেবে কাজ করেন।

কয়েক বছর আগে আন্তর্জাতিক মহাশূন্য কেন্দ্র থেকে মার্কিন নভোচারীদের আনা-নেওয়ার জন্য অন্য কোনো দেশ বা কোম্পানির কাছ থেকে নভোযান কেনার বিষয়ে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার পরিকল্পনা নিয়ে কংগ্রেসের এক শুনানিতে সাক্ষ্য দেন তিনি।

গত নভেম্বরে আরো তিনজন নভোচারীর সঙ্গে আর্মস্ট্রংকে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক কংগ্রেশনাল গোল্ড মেডেল দিয়ে সম্মানিত করা হয়।

১৯৫৬ সালে প্রেমিকা জেনেট শিয়ারনকে বিয়ে করেন আর্মস্ট্রং। ১৯৯৪ সালের জেনেটের সঙ্গে ছাড়াছাড়ির পর বিয়ে করেন ক্যারল নাইটকে।

সুখী জীবন দেখতে যেন কখনই শেষ হবে না, তবে জীবন যেন আর্মস্ট্রাংকে ঠাড্ডা করছে। গত ৫ অগাস্ট ৮২তম জন্মদিন পালন করার ঠিক দুই দিনের মাথায় হৃদরোগে আক্রান্ত হন আর্মস্টং। তার পরিবারের বরাত দিয়ে মার্কিন গণমাধ্যমগুলো জানায়, হৃদপিণ্ডে অস্ত্রোপচারের সেই ধকল আর তিনি সামলে উঠতে পারেননি। আর্মস্ট্রংয়ের পরিবার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, হৃদপিণ্ডে চারটি ধমনিতে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে ৭ আগস্ট তাঁর অস্ত্রোপচার করা হয়। সেখান থেকে সৃষ্ট জটিলতায় আর্মস্ট্রংয়ের মৃত্যু হয়। তবে তিনি কোথায় মারা গেছেন, ওই বিবৃতিতে তা উল্লেখ করা হয়নি।

আর্মস্ট্রং দুই ছেলে এবং এক সত্ ছেলে ও এক সত্ মেয়ে রেখে গেছেন। তবে পৃথিবীর সব মানুষের মণিকোঠায়, সব শিশুর পাঠ্যবইয়ের পাতায় উজ্জ্বল হয়ে থাকবেন চন্দ্রবিজয়ী এই বীর।

একজন নভোচারী হিসেবে আর্মস্ট্রং সব সময়ই নিভৃতে থাকতে পছন্দ করতেন। তবে মার্কিন সরকার তাঁকে যোগ্য সম্মান দিতে কার্পণ্য করেনি। গত বছরের নভেম্বরে তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক 'কংগ্রেশনাল গোল্ড মেডেল'-এ ভূষিত করা হয়।

আর্মস্ট্রংয়ের বিদায়ে শোক প্রকাশ করেছেন সেদিনের সেই অভিযানে তাঁর সহযাত্রী নভোচারী এডউইন অলড্রিন। তিনি বিবিসির নিউজআওয়ার অনুষ্ঠানে বলেন, "চাঁদে অভিযানের ৫০তম বার্ষিকী উদযাপন অনুষ্ঠানে আমরা একসঙ্গে থাকতে পারব না, এটা খুবই দুঃখের বিষয়।"

বিবিসি অনলাইনের খবরে বলা হয়েছে, আর্মস্ট্রংয়ের মৃত্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, "আর্মস্ট্রং কেবল তাঁর সময়েরই নয়, বরং সর্বকালের সেরা মার্কিন মহানায়ক।"

সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন
মন্তব্যের পাতা
ভিডিও চিত্র
সাক্ষাত্কার
চিঠিপত্র
Play Stop
© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040