৫০ বছর আগে তিব্বতে চালানো গণতান্ত্রিক সংস্কার লাখ লাখ ক্রীতদাসের ভাগ্য পরিবর্তন করেছে। বন্ধুরা, আজকের " তিব্বতের কথকতা" অনুষ্ঠানে আমরা একজন তিব্বতী গবেষক চিয়াং পিয়ান চিয়া ছুও'র গল্প নিয়ে আপনাদেরকে পরিচয় দেবো:
এখন ৭১ বছর বয়সী চিয়াং পিয়ান চিয়া ছুও হচ্ছেন তিব্বতের প্রথমজন ডক্টর ডিগ্রীর অধিকারী। তিব্বতী ভাষায় চিয়াং পিয়ান চিয়া ছুও-এর অর্থ হচ্ছে বুদ্ধিমান। ১৯৩৮ সালের শেষ দিকে তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের সি খাং প্রদেশের পা থাং জেলার এক দরিদ্র পরিবারে চিয়াং পিয়ান চিয়া ছুও-এর জন্ম হয়। ছোটবেলার সময় স্মরণ করলে একটি শব্দ চিয়াং পিয়ান চিয়া ছুও'র মুখে বেশি বলা হয়। যা হলো " দুঃখ"। তিনি আমাদের সংবাদদাতাকে দেয়া এক সাক্ষাত্কারে বলেন:
" মুক্ত পাওয়ার আগে তিব্বত হচ্ছে একটি সম্প্রায় সমাজ। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে মাঝে মাঝে ঝকড়া ছিল। প্রত্যেকবারে ঝকড়া হয়েছে দু'পক্ষের অধিবাসীরা নিশ্চয়ভাবে এর ক্ষতিগ্রস্ত হতো। এ জন্য সবার মনে অনেক দুঃখ লাগতো।"
১৯৫০ সালের জুন মাসে চীনের গণ মুক্তি ফৌজ চিয়াং পিয়ান চিয়া ছুও'র জন্মভূমিতে মোতায়েন করেছে। এ বছর হচ্ছে চিয়াং পিয়ান চিয়া ছুও'র ভাগ্য হস্তান্তর হওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর। সে সময় তিনি তাঁর মেজবোন এবং বড়ভাইর সাথে চীনের গণ মুক্তি ফৌজের একজন সদস্যে পরিণত হয়েছেন। এটি সেসময় শান্তিপূর্ণভাবে তিব্বতকে মুক্তি দেয়ার লক্ষ্যে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি নির্ধারিত সংশ্লিষ্ট নীতি-মালার সঙ্গে সম্পর্কিত। এর মধ্যে রয়েছে তিব্বতী অধিবাসীকে চীনের গণ মুক্তি ফৌজে অংশ নেয়ার উত্সাহ দেয়াসহ বিভিন্ন বিষয়। এ সম্পর্কে চিয়াং পিয়ান চিয়া ছুও স্মরণ করে বলেন:
" সেসময় মহানেতা মাও সে তুংয়ের নির্দেশ অনুযায়ী, চীনের গণ মুক্তি ফৌজ তিব্বতে আসায় শুধু হান জাতির লোক যথেষ্ট নয়, কারণ তারা তিব্বতী ভাষা বলতে এবং কিছু বুঝতেও পারতো না, আমাদের বাহিনীর মধ্যে বিভিন্ন জাতির মানুষ যোগ দেয়া দরকার।"
এভাবেই চিয়াং পিয়ান চিয়া ছুও আনুষ্ঠানিকভাবে সেনাবাহিনীর মধ্যে একজন সাধারণ সৈন্যে পরিণত হয়েছেন।
গণতান্ত্রিক সংস্কারের পর, চিয়াং পিয়ান চিয়া ছুও প্রথমবারের মত দেশের বাড়ি ত্যাগ করে তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের রাজধানী লাসায় আসেন এবং তোতালা প্রাসাদ দেখতে পান। পরবর্তীকালে তিনি আবার প্রথমবারের মত মালভূমি থেকে নেমে চীনের সি ছুয়ান প্রদেশের ছেং তু শহরে পড়তে আসেন।
১৯৬০ সালের জুন বা জুলাই মাসে গণতান্ত্রিক সংস্কার সংক্রান্ত গ্রুপের একজন চাচা আমাকে জিজ্ঞেস করেন যে, আমি অন্তর্ভাগে গিয়ে লেখাপড়া করতে চাই কি না, উত্তরে আমি বলি ,আমি চাই। সে বছরেই আমি জন্মভূমি থেকে লাসায় আসি। তারপর চীনের গণ মুক্তি ফৌজের ট্রাকে করে লাসা থেকে ছিং হাই প্রদেশের রাজধানী সি নিংয়ে যাই এবং সেখানকার থেকে আবার সি নিং থেকে ট্রেনে করে সি ছুয়ান প্রদেশের ছেং তু শহরে যাই।
চীনের গণ মুক্তি ফৌজের সাহায্যে একটি দরিদ্র তিব্বতী পরিবারের সন্তানের ভাগ্য পরিবর্তন ঘটেছে। ১৯৮০ সালে চিয়াং পিয়ান চিয়া ছুও নিজের লেখাপড়ার খুবই চমত্কার ফলাফল নিয়ে চীনের সামাজিক ও বৈজ্ঞানিক কলেজের জাতীয় সংস্কৃতি গবেষণা বিভাগের একজন গবেষক হিসেবে নির্বাচিত হন।এখানে কাজে লাগানোর পর, তিনি তিব্বতী ভাষা নিয়ে উপন্যাস লেখা শুরু করেছেন। তিনি লিখেছেন খুবই বিখ্যাত এবং সবার জনপ্রিয়কবি " কে সার রাজা" । তিনি বলেন, এ বই-এ আন্তরিকভাবে গণতান্ত্রিক সংস্কারের পর তিব্বতে আমুল পরিবর্তন ঘটানোর বিষয়টি প্রতিফলিত হয়েছে। এ সম্পর্কে তিনি বলেন:
" ক্রীতাদাস ব্যবস্থা বাতিল হওয়ার পর, তিব্বতের লাখ লাখ ক্রীতদাস সত্যিকারভাবে সমাজের একজন মালিকে পরিণত হয়েছে। সবাই পড়াশুনা পড়তে পারতেন।"
নয়া চীন প্রতিষ্ঠার পর বিশেষ করে সংস্কার ও উন্মুক্তকরণের পর, চীন সরকার তিব্বতের শিক্ষা উন্নয়নের ওপর বেশ গুরুত্ব আরোপ করে এসেছে। গত শতাব্দির ৫০ দশকে তিব্বতের শান্তিপূর্ণ মুক্তির আগে সামন্ততান্ত্রিক কৃতদাস ব্যবস্থা থাকায় তিব্বত দীর্ঘকাল ধরে রাজনীতি ও ধর্মের মিশ্রণে থাকার প্রাচীন সামাজিক ব্যবস্থা ছিল। তখন তিব্বতে কেবল ছিল মন্দির ও স্থানীয় সরকারের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত স্কুল । সেখানে শুধু সন্নাসী কর্মকর্তা ও অভিজাত পরিবারের ছেলেমেয়েরা পড়াশুনা করতো । সেসময় তিব্বতে স্কুলের বয়সী ছেলেমেয়েদের স্কুলে ভর্তির হার ছিল মাত্র ২ শতাংশ এবং যুবক-যুবতী ও মধ্যবয়সীদের নিরক্ষরতার হার ছিল ৯৫ শতাংশ ।
গত ৫০ বছরের উন্নয়নের পর তিব্বতে এখন একটি পূর্ণাংগ শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে । এ শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে শিশুদের শিক্ষা , প্রাথমিক শিক্ষা , মাধ্যমিক শিক্ষা , মাধ্যমিক পেশাগত ও কারিগরি শিক্ষা , উচ্চ শিক্ষা , বয়স্কদের শিক্ষা এবং টেলিভিশন শিক্ষা ।বর্তমানে তিব্বতে রয়েছে ৬টি সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় , মাধ্যমিক পেশাগত বিদ্যালয় , ১১৯টি মাধ্যমিক স্কুল ও ৮৮৫টি প্রাথমিক স্কুল । বিভিন্ন স্তরের বিভিন্ন ধরণের স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সংখ্যাও ৫ লাখ ৪০ হাজারেরও বেশি ।
গত শতাব্দির ৮০ দশকের পর চীনের কেন্দ্রীয় সরকার ও স্থানীয় সরকার তিব্বতের শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বিপুল মাত্রায় বাড়িয়ে চলেছে এবং যথাক্রমে বেশ কিছু সুবিধাজনক নীতি প্রবর্তন করেছে । যেমন প্রাথমিক স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষ পর্যন্ত সরকার তিব্বতী ছাত্রছাত্রদের লেখাপড়ার লক্ষ্যে সব খরচ বহন করে থাকে । প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলের কিছু সংখ্যক তিব্বতী ছাত্রদের খাওয়া , পরা ও থাকার খরচও সরকার বহন করে থাকে । তিব্বতের গ্রামাঞ্চল ও পশু পালন অঞ্চলের কোনো কোনো স্কুলে ছাত্রছাত্রদের আবাসিক ব্যবস্থা চালু রয়েছে । তাছাড়া দেশের অন্যান্য স্তানে যেখানে শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নত , সেখানে তিব্বত মাধ্যমিক স্কুল ও তিব্বত ক্লাস চালু করা হয় এবং লেখাপড়া ও জীবনযাপনের দিক থেকে সেখানে অবস্থানরত তিব্বতী ছাত্রছাত্রীদেরকে বিশেষ সুযোগ সুবিধা দেয়া হয় । তিব্বতী জাতির বিশেষ বিশেষ পেশার যোগ্য ব্যক্তিদের গড়ে তোলার জন্যে তিব্বতের বিভিন্ন বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে তিব্বতী ভাষা ও সাহিত্য , তিব্বতী পদ্ধতির চিকিত্সা , তিব্বতী শিল্পকলা ও তিব্বতী ইতিহাস বিভাগ খোলা হয় ।
তিব্বতের প্রগাঢ় ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রয়েছে বলে তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত সরকার তিব্বতে বিশেষ অর্থ বরাদ্দ করে বৌদ্ধ বিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠা করেছে । এ সম্পর্কে চিয়াং পিয়ান চিয়া ছুও আনন্দের সঙ্গে বলেন:
" দীর্ঘকাল ধরে মানুষ যদি তিব্বতী সংস্কৃতির কথা বললে নিশ্চিতভাবে বৌদ্ধ ধর্মের সংস্কৃতি বলা যায়। নিঃসন্দেহ বৌদ্ধ ধর্মের সংস্কৃতি হচ্ছে তিব্বতী জাতির সংস্কৃতি পদ্ধতিগুলোর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্য । তবে সেটাও এর মধ্যে শুধু একটি গঠিত অংশ"।
১৯৫১ সালে তিব্বতের ছাং তু প্রাথমিক স্কুল আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় । এটি হচ্ছে নয়া চীন প্রতিষ্ঠার পর তিব্বতে প্রতিষ্ঠিত প্রথম নতুন আধুনিক স্কুল । এ স্কুলে প্রধানত তিব্বতী ভাষা শেখানো হয় এবং পছন্দ হলে ছাত্রছাত্রীরা চীনা ভাষাও শিখতে পারে । ছাং তু প্রাথমিক স্কুলের প্রতিষ্ঠা তিব্বতের পরবর্তী আধুনিক স্কুলের জন্যে একটি উন্নত নমুনার সূচনা সৃষ্টি করেছে । ---ওয়াং হাইমান
সুপ্রিয় শ্রোতাবন্ধুরা, আজকের "তিব্বতের কথকতা " এখানেই শেষ করছি। এতক্ষণ আমাদের সঙ্গে থেকে অনুষ্ঠানটি শোনার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। শ্রোতাবন্ধুরা, " তিব্বতের কথকতা " অনুষ্ঠান সম্পর্কে আপনাদের মতামত আমাদের অনুষ্ঠানকে আরো সমৃদ্ধ করবে। বন্ধুরা, " তিব্বতের কথকতা " অনুষ্ঠানটি প্রযোজনা করেছেন আমার সহকর্মী ওয়াং হাইমান। আপনারা সবাই সুস্থ থাকুন, সুন্দর থাকুন, পরবর্তী আসরে আবার কথা হবে।----ওয়াং হাইমান
|