বন্ধুরা, ছিংহাই-তিব্বত মালভূমিতে অবস্থিত তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হচ্ছে চীনের পাঁচটি সংখ্যালঘু জাতি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের মধ্যে অন্যতম। এর লোকসংখ্যার অধিকাংশই তিব্বতী জাতির। তারা বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী। সাধারণত অনেকের জন্য তিব্বতী মন্দির একটি রহস্যময় স্থান। মন্দিরে ভিক্ষুরা কীভাবে জীবনযাপন করছেন, দিন কাটাচ্ছেন এবং মন্দিরে সংশ্লিষ্ট পুরাকীর্তির রক্ষা ব্যবস্থা কেমন হয়েছে ? প্রিয় বন্ধুরা আজকের " তিব্বতের কথকতা" অনুষ্ঠানে আমরা এ বিষয় নিয়েই আলোচনা করবো।
তিব্বতের রি কা জে শহরের পশ্চিমাঞ্চলের ' জা সি লুন পু' মন্দির হচ্ছে তিব্বতের বিখ্যাত মন্দিরগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি । ১৪৪৭ সালে জা সি লুন পু মন্দির নির্মাণের কাজ শুরু হয় এবং ১৪৫৯ সালে নির্মাণের কাজ সম্পন্ন হয় বলে এর নির্মাণের কাজ শেষ করতে ১২ বছরের মত সময় লেগেছে। ৭০ বছর বয়সী সালুং ফুনলহা হচ্ছেন এ মন্দিরের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা কমিটির পরিচালক। ১৯৫১ সালে তিনি একজন ভিক্ষু হিসেবে এ মন্দিরে কাজ শুরু করেন। তিনি আমাদেরকে বলেন, ' জা সি লুন পু' মন্দিরে ভিক্ষুদের চলমান জীবন-যাত্রার মান আগের চেয়ে অনেক বেশি উন্নত হয়েছে। এ সম্পর্কে তিনি বলেন:
" পুরানো তিব্বতে মন্দির ছিল প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় একটি উপায়। ভিক্ষুরা যেন ক্রীতদাস তাদের কোনো মুক্তি ছিল না। সেসময় প্রায় প্রতিদিনই যথেষ্ট খাবার খেতে পারতাম না। এমন কি, শীতকালে সারা পরিবারের জন্য একটি গরম কাপড়ও ছিল না। সে সময়ের জীবন-যাত্রার কথা বর্ণনা করার কোন ভাষা আমার নেই। ১৯৫৯ সালে গণতান্ত্রিক সংস্কার শুরু হওয়ার পর তিব্বতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। সে সময় থেকে ভিক্ষুরা আনুষ্ঠানিকভাবে মন্দিরের একজন সত্যিকার ভিক্ষুতে পরিণত হয়েছে। আমাদের জীবন-যাত্রার মান এবং অবস্থানেরও উন্নতি হচ্ছে "।
গত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় পুরানো তিব্বতের অবস্থা রাজনীতি ও ধর্মের মিশ্রণে থাকা প্রাচীণ সামাজিক ব্যবস্থা ছিল। সেসময় তিব্বতের ৯৫ শতাংশ লোক ছিল ক্রীতদাস। ক্রীতদাসের মালিক কখনোই ক্রীতদাসদের একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে দেখতো না। তাহলে, একজন ব্যক্তি-স্বাধীন মানুষ কীভাবে একজন ক্রীতদাসে পরিণত হয়েছিল?
খৃষ্টীয় ১৩ শতাব্দীতে তিব্বত আনুষ্ঠানিকভাবে চীনের কেন্দ্রীয় রাজবংশের প্রশাসনে অন্তর্ভূক্ত হয়। ১৭ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় ছিং রাজবংশের রাজা বৌদ্ধ ধর্মের নেতাকে দালাই লামা উপাধি প্রদান করে। এভাবেই দালাই লামা পর্যায়ক্রমে তিব্বতের রাজনৈতিক ক্ষেত্রের শীর্ষ নেতায় পরিণত হয়ে অপরিহার্য ক্ষমতা প্রাপ্ত হন। তিব্বতের আলি অঞ্চলের আয়তন ৩ লাখ ২০ হাজার বর্গকিলমিটার। যা সারা ইতালির আয়তনের চেয়েও বেশি। তবে ছিং রাজবংশে আলি এ অঞ্চলের শীর্ষ নেতা ছিলেন একজন ভিক্ষু। এটা অভাবনীয়।
সেসময় তিব্বতের প্রায় সকল ক্ষমতা ও ভূমি সম্পদ সামন্ততান্ত্রিক রাজবংশের রাজ পরিবারের হাতে থাকতো। তারা ছিলেন তথাকথিত বৌদ্ধ ধর্মের ভিক্ষু। অতীত রাজবংশের রাজ পরিবার ও বৌদ্ধ ধর্মীয় জাতির বংশোদ্ভূত হিসেবে তারা প্রচুর ভূমি পেয়েছিল। তবে তাদের লোকসংখ্যা মাত্র তিব্বতের মোট লোকসংখ্যার ৫ শতাংশ। সুতরাং, অধিকাংশ কৃষকদের হাতেই ভূমি ছিল না। এ অবস্থার প্রেক্ষাপটে তিব্বতের সাধারণ কৃষকরা শুধু বর্গা নেয়া জমিতে চাষ করতো এবং তাদের প্রচুর ঋণ হয়ে যায়। ঋণ পরিশোধ করতে পারেনি এমন কৃষকরা পর্যায়ক্রমে ক্রীতদাসে পরিণত হয়েছে। আসল কথা হচ্ছে ভিক্ষু রাজ পরিবারের হাতে নিয়ন্ত্রিত তিব্বতের সকল রাজনৈতিক ক্ষমতা। প্রায় ৯৫ শতাংশ মানুষ নিজেদের পদমর্যাদার পরিবর্তনে কোন অধিকার ও সুযোগ ছিল না। অবশ্যই,রাজনৈতিক ব্যবস্থায়ও তাদের অংশ নেয়ার কোনো কোন সুযোগ ছিল না। কারণ তারা ছিল ক্রীতদাস পর্যায়ের মানুষ।
গণতান্ত্রিক সংস্কার হওয়ার পর, ১৯৬১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিব্বতে প্রথমবারের মত গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। অতীতকালের ক্রীতদাসরাও প্রথমবারের মত নিজেদের রাজনৈতিক অধিকার পালন করতে এসেছে। একই সঙ্গে মন্দিরের ভিক্ষুদের কেবল যে জীবন-যাত্রার মান ব্যাপকভাবে উন্নত হয়েছে তা নয়, বরং তাদের হাতেও রাজনৈতিক নির্বাচনের অধিকার এসেছে। মন্দিরে একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা কমিটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর সকল সদস্য ভিক্ষুদের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হন। মন্দিরের যে কোন কাজ সব এ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা কমিটির আলোচনার পর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সালুং ফুনলহা হচ্ছেন এ কমিটির পরিচালক । এ সম্পর্কে তিনি বলেন:
" গণতান্ত্রিক সংস্কার শুরুর আগে মন্দিরের সাধারণ ভিক্ষুরা সরকারের কর্মকান্ডে অংশ নিতে পারতো না। এখন ভিক্ষুরাও দেশ গঠনে নিজেদের মতামত উত্থাপন করতে সক্ষম । আমি ইতোমধ্যেই চীনের জাতীয় রাজনৈতিক পরামর্শ সম্মেলনের শাখা তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের স্থায়ী রাজনৈতিক পরামর্শ সম্মেলনের ভাইস-চেয়ারম্যান এবং ' জা শি লুন পু' মন্দিরের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা কমিটির পরিচালক হয়েছি। মন্দিরের সকল ভিক্ষু দেশ ও মন্দিরের প্রতিষ্ঠায় অংশ নেয়ার অধিকার পেয়েছে বলে সত্যিকারভাবে দেশের একজন মালিকে পরিণত হয়েছেন।
এ ছাড়াও, মন্দিরের পুনর্গঠন ও মন্দিরের মূলবান পুরাকীর্তি রক্ষার লক্ষ্যে প্রতিবছর কেন্দ্রীয় সরকার বিশেষ করে এর বরাদ্দ বড়ানোর ব্যবস্থা নিচ্ছে।২০০৬ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ' জা শি লুন পু'সহ ২২টি পুরাকীর্তি ইউনিট পুনর্গঠন ও রক্ষার লক্ষ্যে চীন সরকার মোট ৫৭ কোটি ইউয়ান বরাদ্দ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ সম্পর্কে সালুং ফুনলহা বলেন:
" গণতান্ত্রিক সংস্কার শুরু হওয়ার পর বিশেষ করে সংস্কার ও উন্মুক্তকরণের পর, চীন সরকার মন্দিরের পুনর্গঠন ও পুরাকীর্তি রক্ষার ওপর বেশ গুরুত্ব আরোপ করে যাচ্ছে। 'জা শি লুন পু' মন্দিরকে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ পুরাকীর্তি রক্ষার ইউনিটে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। ১৯৮০ সালে 'জা শি লুন পু' মন্দির পুনর্গঠনের লক্ষ্যে চীন সরকার মোট ৮ কোটি ইউয়ান বরাদ্দ করেছে। এখন'জা শি লুন পু'সহ অন্য ২০টি মন্দির পুনর্গঠনের জন্যও চীন সরকার আরও ৫০ কোটিরও বেশি ইউয়ান বরাদ্দ করেছে। বৌদ্ধ ধর্ম বিশ্বাসীদের একটি স্থান হিসেবে মন্দিরের দুয়ার সবসময় সবার জন্য খোলা থাকে।
মন্দির রক্ষা ছাড়াও, তিব্বতের বিভিন্ন মন্দির সক্রিয়ভাবে কেবল যে ধর্মীয় তত্ত্ব প্রচার জন্য তা নয়, তা তিব্বতের ঐতিহাসিক সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। উচ্চ পর্যায়ের জ্ঞানী ভিক্ষু প্রযুক্তিবিদকে লালন-পালনের ব্যবস্থা নিচ্ছে। বৌদ্ধ ধর্মের চারটা সম্প্রদায়ের অন্যতম হিসেবে 'সা চিয়া' সম্প্রদায়ের মসজিদ ' সা চিয়া' মন্দির তিব্বতের রি খা জে অঞ্চলের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সা চিয়া জেলায় অবস্থিত। এখানে কেবল যে ' সা চিয়া' সম্প্রদায়ের বৌদ্ধ ধর্ম রয়েছে তা নয়, তা সংশ্লিষ্ট কম্পিউটার শেখার ব্যবস্থা ও নিজের ওয়েব-সাইটও তুলে ধরেছে। এ সম্পর্কে সা চিয়া মন্দিরের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা কমিটির পরিচালক দপাল ইদান দনইয়ুস বলেন:
" ১৯৯৯ সালে আমাদের মন্দিরে কম্পিউটার প্রশিক্ষণের ক্লাস শুরু হয়। এখন আমাদের নিজেদের সা চিয়া ওয়েব-সাইটও চালু হয়েছে। ওয়েবসাইটে সা চিয়া সম্প্রদায়ের ইতিহাসিক সংস্কৃতি সব লিপিবদ্ধ রয়েছে। এভাবেই সারা বিশ্বের ভিক্ষুরা আমাদের সা চিয়া ইতিহাসের সব দিক জানতে সক্ষম হয়েছেন"।
তিব্বতের মন্দিরগুলো ইতোমধ্যেই কেবল যে বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসীদের জন্য একটি স্থান তা নয়, তা একটি বিখ্যাত পর্যটন স্থান ও জাতীয় পুরাকীর্তি রক্ষার ইউনিটে পরিণত হয়েছে।
সুপ্রিয় শ্রোতাবন্ধুরা, আজকের "তিব্বতের কথকতা " এখানেই শেষ করছি। এতক্ষণ আমাদের সঙ্গে থেকে অনুষ্ঠানটি শোনার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। শ্রোতাবন্ধুরা, " তিব্বতের কথকতা " অনুষ্ঠান সম্পর্কে আপনাদের মতামত আমাদের অনুষ্ঠানকে আরো সমৃদ্ধ করবে। বন্ধুরা, " তিব্বতের কথকতা " অনুষ্ঠানটি প্রযোজনা করেছেন আমার সহকর্মী ওয়াং হাইমান। আপনারা সবাই সুস্থ থাকুন, সুন্দর থাকুন, পরবর্তী আসরে আবার কথা হবে।----ওয়াং হাইমান |