২০০৯ সালে চীনের তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের গণতান্ত্রিক সংস্কারের ৫০তম বার্ষিকী পূর্তি হয়েছে। গত ৫০ বছরে তিব্বতের কৃষক ও পশুপালকদের জীবন তিব্বতের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন হয়েছে। আজকের অনুষ্ঠানে আমি আপনাদের তিব্বতের জনসাধারণের গত ৫০ বছরের জীবনের পরিবর্তন সম্পর্কে কিছু বলবো।
১৯৫৯ সালে গণতান্ত্রিক সংস্কারের আগে পুরনো তিব্বত সামন্ততান্ত্রিক কৃতদাস প্রথা প্রচলিত ছিল। ১৯৪৬ সালে উত্তর তিব্বত তৃণভূমিতে জন্মগ্রহন বৃদ্ধ সো ছুয়ে চোল গার সামন্ততান্ত্রিক কৃতদাস প্রথায় ১৩ বছর জীবন কাটালেন। তাঁর কৈশোর ক্রীতদাস ও কষ্টকর। তিনি মনে করেন, সেই যুগে তিনি কেবল কথা বলতে এমন একটি যন্ত্রপাতি ছিলেন।
সামন্ততান্ত্রিক বংশানুক্রমিক প্রথা অনুযায়ী সো ছুয়ে চোল গার ৮ বছর বয়সে মালিকের পশুপালনের কৃতদাসে পরিণত হন। মালিকের হিংস্র মুখ ও নিরন্তর বকাবকি ছিল তাঁর কৈশোরের অবিস্মরণীয় স্মৃতি। ১৯৫৩ সালে উত্তর তিব্বত তৃণভূমিতে মারাত্মক ভূমিকম্প ঘটেছে। এটা সো ছুয়ে চোল গারের মনে অবিস্মরণীয় দেবনা রয়েছে। তিনি বলেন,
'১৯৫৩ সালে আমার জন্মস্থানে সংঘটিত ভূমিকম্পে অনেক তাঁবু বিধ্বস্ত হয়েছে। ব্যাপক পশুপালক ও কৃষকদের জীবনযাত্রা আরো কঠিন হয়েছে। তত্কালীন সামন্ততান্ত্রিক সরকার কোন শুল্ক মওকুফ ব্যবস্থা করে নি। বরং আমার বাসার একমাত্র ঘি নিয়ে গেছে।'
পুরনো তিব্বতে সরকারী কর্মকর্তা, অভিজাত সম্প্রদায় আর মন্দিরের উর্ধতন বৌদ্ধভিক্ষুদের হাতে বিরাট শক্তি ও বহু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশেষ অধিকার আছে। ১৯৫৯ সালে তিব্বতের ২ লাখ ২০ হাজার হেক্টর আবাদী জমির মধ্যে ৩৬.৮ শতাংশ মন্দির ও উর্ধতন বৌদ্ধভিক্ষুদের হাতে। অভিজাত সম্প্রদায় আর সরকার যথাক্রমে ২৪ ও ৩৮.৯ শতাংশ দখল করে। ব্যাপক কৃতদাস সীমাহীন কাজ আর নানা কর আদায় করতে হয়। তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের সমাজ বিজ্ঞান একাডেমির গবেষক কোলচাং ইয়েশে বলেন, 'দশ লাখ কৃতদাস বংশপরম্পরায় সামন্ততান্ত্রিক কৃতদাস প্রথায় বসবাস করে। মালিকরা তাদেরকে জীবিত যন্ত্রপাতির মতো ব্যবহার করে, তাদেরকে মানুষ হিসেবে মনে করে না। তিব্বতের গণতান্ত্রিক সংস্কারের আগে বলা যায়, জমি, বন ও পানি সম্পদসহ সব উত্পাদন সম্পদ তিব্বতের জনসংখ্যার ৫ শতাংশের বৌদ্ধভিক্ষু ও অভিজাত সম্প্রদায়ের হাতে ছিল। ব্যাপক জনগণের কিছু ছিল না।'
গত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় তিব্বতে মোট ২৭০০টিরও বেশি মন্দির ছিল। এ মন্দিগুলোতে ১ লাখ ২০ হাজার বৌদ্ধভিক্ষু ছিল, এ সংখ্যা তত্কালীন তিব্বতের মোট জনসংখ্যার ১২ শতাংশ। তিব্বতের প্রায় এক চতুর্থাংশ পুরুষ মন্দিরে বৌদ্ধভিক্ষু হতেন। বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থিত মন্দির, বহু বৌদ্ধভিক্ষু আর নানা ধর্মীয় কর্মসূচী বিপুল পরিমাণ মানবসম্পদ আর অধিকাংশ বস্তুগত সম্পদ সংগ্রহ ও ব্যয় করেছে। এর ফলে তিব্বত দীর্ঘকাল ধরে অচলাবস্থায় ছিল। আধুনিক শিল্প ও বাণিজ্য, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, শিক্ষা, সংস্কৃতি আর স্বাস্থ্য শিল্প একেবারে নেই বলা যায়। অসংখ্য কৃতদাস ক্ষুধা ও রোগ আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে।
১৯৪৯ সালে গণ চীন প্রজাতন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৫১ সালের ২৩ মে চীনের কেন্দ্রীয় গণ সরকার ও তত্কালীন তিব্বতের স্থানীয় সরকারের মধ্যে 'শান্তিপূর্ণ তিব্বতকে মুক্তি করার উপায় সংক্রান্ত চুক্তি' স্বাক্ষর করে এবং তিব্বতের শান্তিপূর্ণ মুক্তি বাস্তবায়িত হয়। কেন্দ্রীয় গণ সরকার তিব্বতের ইতিহাস ও বাস্তবের বিশেষ অবস্থা বিবেচনা করে 'চুক্তি'-তে তিব্বতের সমাজ ব্যবস্থা সংস্কার করার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করার পাশাপাশি সংস্কারের ওপর যত্নশীল মনোভাব নিয়েছে। চুক্তিতে লিপিবদ্ধ করা হয়ে যে, 'তিব্বতের স্থানীয় সরকার স্বতঃস্ফুর্ত সংস্কার করা উচিত। জনগণ সংস্কার করার অনুরোধ করলে তিব্বতের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনা করে নিষ্পত্তি উপায় খুঁজে বের করতে হয়।'
কিন্তু তত্কালীন তিব্বতের উর্ধতন প্রশাসন গোষ্ঠীর মধ্যে কিছু লোক সংস্কার বিরোধিতা করে এবং চিরকালে সামন্ততান্ত্রিক কৃতদাস প্রথা বজায় রাখার অপচেষ্টা করে। ১৯৫৯ সালের ১০ মার্চ তারা চীন বিরোধী বিদেশী শক্তির সঙ্গে আঁতাত করে সশস্ত্র বিদ্রোহ করে এবং মাতৃভূমি থেকে তিব্বতকে বিচ্ছিন্ন করার অপচেষ্টা করে। দেশের পুনরেকীকরণ আর তিব্বতের জনগণের মৌলিক স্বার্থ রক্ষা করার জন্য কেন্দ্রীয় গণ সরকার তিব্বতী জনগণের সঙ্গে দৃঢ় ব্যবস্থা নিয়ে বিদ্রোহ উপশমিত করেছে এবং তিব্বতে সমাজ ব্যবস্থার গণতান্ত্রিক সংস্কার চালু করেছে। তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের সমাজ বিজ্ঞান একাডেমির গবেষক কেলচাং ইয়েশে বলেন'প্রথমে কেন্দ্রীয় সরকার বিদ্রোহ উপশমিত করার পাশাপাশি গণতান্ত্রিক সংস্কার করার নীতি উত্থাপন করেছে। বিদ্রোহী অঞ্চলে প্রথমে সংস্কার চালু হয়। রাজনীতি ও ধর্মকে বিচ্ছিন্ন করার ব্যবস্থা নিয়েছে। এর পাশাপাশি স্বাভাবিক ধর্মীয় কর্মসূচী রক্ষা করে। বিদ্রোহী কৃতদাসের মালিক ও তাদের প্রতিনিধিদের আঘাত হানা শুরু করে এবং তাদের উত্পাদন সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে এবং ব্যাপক কৃতদাসকে ভাগ করে। যারা বিদ্রোহ করেছে, তারা যদি প্রতিক্রিয়াশীল অবস্থান পরিত্যাগ করে, গণতান্ত্রিক সংস্কার ও কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি সমর্থন করে এবং দেশের পুনরেকীকরণ রক্ষা করে, তাহলে তাদেরকে রাজনীতিতে মুক্তি দেয়া হয় এবং জীবনযাপনের সংশ্লিষ্ট বন্দোবস্তু করা হয়। কেন্দ্রীয় সরকারের এ সব ব্যবস্থা তিব্বতের বাস্তব অবস্থার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ বলে তিব্বতের জনসাধারণ ও মন্দিরের বৌদ্ধভিক্ষুদের সমর্থন পেয়েছে। ফলে তিব্বতের গণতান্ত্রিক সংস্কার দু'বছরেরও কম সময়ের মধ্যে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে।'
১৯৫৯ সালে ১৩ বছর বয়সী সো ছুয়ে চোল গার তাঁর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ অর্ভ্যথনা করেছেন। তিনি মুক্তি হয়ে সরকারের সাহায্যে প্রথম বারের মতো স্কুলে ভর্তি হয়ে একজন প্রাথমিক স্কুলের ছাত্রী পরিণত হয়েছেন। তিনি বলেন, '১৯৫৯ সালে আমার স্বদেশে সংস্কার ও বিদ্রোহ উপশমিত করা মুক্তি ফৌজ আমাকে লেখাপড়ার জন্য লাসায় পাঠিয়েছেন এবং পরে মূলভূভাগেও পাঠিয়েছেন। আমি আর অনেক মুক্তি পাওয়া কৃতদাস ছেলেমেয়ের সঙ্গে স্কুলে প্রবেশ করেছি, কর্মসংস্থান পেয়েছি, ক্যাডারে পরিণত হয়েছি, এমন কি পরে আমি আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন নেতা হয়েছি। এটা হলো আমার কাহিনী, স্বপ্নের কথা নয়।'
এখন বৃদ্ধ সো ছুয়ে চোল গার অবসর নিয়েছেন। তিনি সন্তানদের সঙ্গে সুখী জীবন কাটাচ্ছেন।
গণতান্ত্রিক সংস্কার গভীরতর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিব্বতী জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়েছে, আরো ব্যাপক গণতান্ত্রিক অধিকার পেয়েছেন। |