অবসর নেয়ার আগে ছেন চুং লিয়ে ছিলেন একজন অত্যন্ত দক্ষ আলোকচিত্র গ্রাহক ও সম্পাদক । ৫০ বছর আগে তিনি তিব্বত ডেইলি পত্রিকায় কাজ শুরু করেছিলেন। সেসময় তিব্বতের দক্ষিণ পর্বত অঞ্চলে এক সাক্ষাত্কার নেয়ার সময় "তসেরিং" নামে একজন ক্রীতদাসের সঙ্গে পরিচয় হয়। তিব্বতী ভাষায় "তসেরিং"-এর অর্থ হচ্ছে দীর্ঘায়ূ জীবন। তবে তসেরিং বলেন, নিজের এ নাম পুরনো তিব্বতে প্রায় প্রাণ হারানোর মত অবস্থায় ছিল। একদিন, তাঁর মালিক তাঁকে বলেছিলেন, 'হ্যাঁ! তসেরিং, তোমার নাম তসেরিং না? আমি দেখতে চাই যে , তুমি সত্যিকারভাবেই দীর্ঘায়ূ জীবন কাটাতে পারো কী না। সম্পাদক ছেন চুং লিয়ে তসেরিংয়ের সাথে দূর্ব্যহার করেছিলেন। এ সম্পর্কে ছেন চুং লিয়ে বলেন:
" ক্রীতদাসের মালিক কখনোই ক্রীতদাসদের একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে দেখতো না। এমন কি, তারা কৃতদাসের প্রাণ নিয়ে ছিনি মিনি খেলতে আগ্রহী ছিল। তসেরিংয়ের কাছ থেকে জানা গেছে, একবার তার মালিক নিজের শুটিং -এর মান যাচাই করতে চেয়েছিলে। যেমন ভাবা তেমন কাজ , ' তসেরিং এসো, তুমি এখানে দাঁড়াও, আমি দেখতে চাই যে, তোমার হাতে আমি গুলি লাগতে পারি কি না'।
সেসময় তসেরিংয়ের অনেক ভয় লেগেছিল। তবে কোন উপায় না দেখে তিনি শুধু সেখানে দাঁড়ানোটাকেই বেছে নিয়েছিলেন। " ঢুং…" মালিক বন্দুকের গুলি করার সঙ্গে সঙ্গেই তসেরিং চিরকালের জন্য নিজের বাম বাহুটি হারিয়েছেন।
তিব্বতে সাক্ষাত্কার নেয়ার সময় ছেন চুং লিয়ে তসেরিংয়ের মত এমন নিম্ন পর্যায়ের বহু ক্রীতদাসের ছবি তুলেছেন। তাহলে, একজন ব্যক্তি-স্বাধীন মানুষ কীভাবে একজন ক্রীতদাসে পরিণত হয়েছিল?
খৃষ্টীয় ১৩ শতাব্দীতে তিব্বত আনুষ্ঠানিকভাবে চীনের কেন্দ্রীয় রাজবংশের প্রশাসনে অন্তর্ভূক্ত হয়। ১৭ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় ছিং রাজবংশের রাজা বৌদ্ধ ধর্মের নেতাকে দালাই লামা নাম প্রদান করে। এভাবেই দালাই লামা পর্যায়ক্রমে তিব্বতের রাজনৈতিক ক্ষেত্রের শীর্ষ নেতায় পরিণত হয়ে তার অপরিহার্য ক্ষমতা প্রাপ্ত হয়। তিব্বতের আলি অঞ্চলের আয়তন ৩ লাখ ২০ হাজার বর্গকিলমিটার। যা সারা ইতালির আয়তনের চেয়েও বেশি। তবে ছিং রাজবংশে আলি এ অঞ্চলের শীর্ষ নেতা ছিলেন একজন ভিক্ষু। এটা অভাবনীয়।
সেসময় তিব্বতের প্রায় সকল ক্ষমতা ও ভূমি সম্পদ সামন্ততান্ত্রিক রাজবংশের রাজ পরিবারের হাতে থাকতো। তারা ছিলেন তথাকথিত বৌদ্ধ ধর্মের ভিক্ষু। অতীত রাজবংশের রাজ পরিবার ও বৌদ্ধ ধর্মীয় জাতির বংশোদ্ভূত হিসেবে তারা প্রচুর ভূমি পেয়েছে। তবে তাদের লোকসংখ্যা মাত্র তিব্বতের মোট লোকসংখ্যার ৫ শতাংশ। সুতরাং, অধিকাংশ কৃষকদের হাতেই ভূমি ছিল না। এ অবস্থার প্রেক্ষাপটে তিব্বতের সাধারণ কৃষকরা শুধু বর্গা নেয়া জমিতে চাষ করতো এবং তাদের প্রচুর ঋণ হয়ে যায়। ঋণ পরিশোধ করতে পারেনি এমন কৃষকরা পর্যায়ক্রমে ক্রীতদাসে পরিণত হয়েছে।
যদি একজন ক্রীতদাসে পরিণত হয়ে যায়, তাহলে এ ক্রীতদাসের কোন মানবাধিকার পাবে না। এমন কি, তাদের ছেলেমেয়েরাও চিরকাল ক্রীতদাস হবে। যে কোন কারণেই হোক না কেন, একজন কৃতদাস হলে, নিজে ছাড়াও, বংশোদ্ভূতরাও সরাসরিভাবে ক্রীতদাসের জীবন কাটবে। এ সম্পর্কে চীনের তিব্বতবিদ্যা গবেষণা কেন্দ্রের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিভাগের উপপরিচালক তেনজিন লহুনদ্রুপ বলেন:
" পুরনো তিব্বত ছিল একটি রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রের মিশ্র সমাজ ব্যবস্থা। আসল কথা হচ্ছে ভিক্ষু রাজ পরিবারের হাতে নিয়ন্ত্রিত তিব্বতের সকল রাজনৈতিক ক্ষমতা। প্রায় ৯৫ শতাংশ মানুষ নিজেদের পদমর্যাদা পরিবর্তনে কোন অধিকার ও সুযোগ ছিল না। অবশ্যই,রাজনৈতিক ব্যবস্থায়ও তাদের অংশ নেয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। কারণ তারা ছিল ক্রীতদাস পর্যায়ের মানুষ।"
১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে " বিশ্ব মানবাধিকার প্রস্তাব" গৃহীত হয়েছে। প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সন্তানের পর সবাই মুক্ত মানুষ। মর্যাদা ও অধিকারের ক্ষেত্রে সবাই সমান। কোন মানুষকেই ক্রীতদাস বলে মনে করা যাবে না।
১৯৪৯ সালের ১ অক্টোবর নয়া চীন প্রতিষ্ঠার পর, চীন সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে তিব্বতকে শান্তি আলোচনার আমন্ত্রণ জানায়। ১৯৫১ সালের মে মাসে দু'পক্ষ " শান্তিপূর্ণভাবে তিব্বতের মুক্তি পাওয়ার চুক্তি" স্বাক্ষর করে। এ চুক্তি অনুযায়ী, চীনের কেন্দ্রীয় সরকারের নেতৃতে তিব্বত জাতিগত আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। ১৯৫৬ সালে তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের প্রস্তুতিমূলক কমিটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি হচ্ছে তিব্বতের ক্রীতদাস প্রথা আনুষ্ঠানিকভাবে বাতিল করার প্রতীক।
১৯৫৯ সালের মার্চ মাসে তিব্বতের লাসা অলি-গলি রাস্তায় রাস্তায় সহিংসতার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। কিছু কিছু সশস্ত্র দালাই লামা তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের প্রস্তুতিমূলক কমিটির কয়েকজন কর্মকর্তাকে হত্যা করে। একই বছরের ১৬ মার্চ দালাই লামা বিদেশীদের সাহায্যে লাসা থেকে পারিয়ে গেল।
একই সময় সাবেক প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই রাষ্ট্রীয় পরিষদের নির্দেশ ঘোষণা করেন। এ থেকেই তিব্বতী অধিবাসীরা নিজেদের সুখী জীবন গ্রহণ করেছে । তারা সরকারের নতুন স্থাপিত বসতবাড়িতে স্থানান্তর করেছে । বিশেষ করে বর্গা জমির চুক্তিসহ সব স্বৈবাচার ধ্বংস হয়ে যায়। তিব্বতী জনগণ সত্যিকারভাবেই সুখী জীবনে দিন কাটাতে পারছে এখন । এ সম্পর্কে তিব্বতের মও চু জেলার কৃষক কেলজাং আনন্দের সঙ্গে বলেন:
" বর্গা জমি চুক্তি বাতিলের পর আমি নিজের চোখে এ অবস্থা দেখে বিশ্বাস করতে পারি নি। চুক্তি বাতিলের পর , আমি সত্যিকারভাবেই অনেক আনন্দ বোধ করি। সেই অনুভব কোন ভাষা দিয়ে বর্ণনা করা যায় না। ঐ দিন থেকে আমি সুখী জীবনে কাটিয়েছিলাম।"
উল্লেখ্য, কৃষকরা নিজেদের ভূমি সার্টিফিকেট গ্রহণ করেছে। একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকার তাদেরকে গবাদীপশু এবং উত্পাদন সাজ-সরঞ্জামও বিতরণ করেছে।
১৯৬১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিব্বতে প্রথমবারের মত গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। অতীতকালের ক্রীতদাসও প্রথমবারের মত নিজেদের রাজনৈতিক অধিকার পালন করতে পারছে। ১৯৬৫ সালে তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে প্রথম গণ সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। অতীতকালের ক্রীতদাসরা ক্যাডার পদে নির্বাচিত হন। তারা সত্যিকারভাবে নতুন তিব্বতের মালিকে পরিণত হয়েছেন। গণতান্ত্রিক সংস্কার চালু হওয়ার ৫০ বছরে তিব্বতের দ্রুত উন্নয়ন হয়েছে। তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন অর্জন করেছে। এখন তিব্বতী জনগণ সত্যিকারভাবেই সুখী জীবনে দিন কাটাচ্ছে।--ওয়াং হাইমান |