দীর্ঘকালের উত্পাদন ও সমাজের বাস্তব অনুশীলনের মধ্য দিয়ে তিব্বতী জাতি একটি বৈশিষ্টময় সংস্কৃতির সৃষ্টি করেছে। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ভাষা, অক্ষর, তিব্বতী চিকিত্সা পদ্ধতি ও ঔষধ, সংগীত ও নৃত্য এবং জ্যোতির্বিদ্যা ও পঞ্জিকা ইত্যাদিসহ অনেক কিছু। তিব্বতের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের ইতিহাস সুদীর্ঘকালের। গণতান্ত্রিক সংস্কার চালু হওয়ার ৫০ বছরে তিব্বতের সংস্কৃতি ক্ষেত্রে নতুন অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে।
এখন আপনারা তিব্বতের শিকাজ অঞ্চলের ঐতিহ্যিক নৃত্য 'তুয়েসিয়ে' নামে 'জাতীয় পর্যায়ের অবৈষয়িক সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার তালিকায়' অন্তর্ভুক্ত অনুষ্ঠানটির অংশ বিশেষ শুনছেন। 'তুয়েসিয়ে' হচ্ছে তিব্বত অঞ্চলে প্রচলিত এক ধরনের লোকনৃত্য। শিকাজ অঞ্চলের লাজ জেলায় এ নৃত্য সবচেয়ে জনপ্রিয়। ২২ বছর বয়সী সোনাম চোপেল হচ্ছেন লাজ জেলার একজন কৃষক। তিনি এ জেলার 'তুয়েসিয়ে' সাংস্কৃতিক দলের একজন অন্যতম সদস্য। তিনি বলেন, 'আমি ছোট বেলা থেকেই গান শেখা শুরু করি। কৃষক শিল্পী দলের প্রতিষ্ঠার সময় আমি আমার নাম দলে তালিকাভুক্তি করি। আমার গাওয়ার কৌশল অপেক্ষাকৃত ভালো বলে আমাকে নিয়োগ দেয়া হয়। আমি জেলার এক জন প্রতিনিধি হিসেবে অনুষ্ঠান পরিবেশনের সুযোগ পেয়ে খুব খুশি। তুয়েসিয়ে'র জন্মস্থান একজন সদস্য হিসেবে আমি মনে করি, তুয়েসিয়ে'র শিল্পকলার সম্প্রচারে আমার দায়িত্ব অনেক।'
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এখন তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে 'তুয়েসিয়ে'সহ জাতীয় পর্যায়ের অবৈষয়িক সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের প্রতিনিধিত্ব কর্ম ৬০টি আর এ উত্তরাধিকার প্রকল্পের সংশ্লিষ্ট উত্তরসূরী রয়েছেন ৩১ জন। প্রতি বছর চীন সরকার এ অবৈষয়িক সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার সংরক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য কিছু অর্থ বরাদ্দ করে এবং সংশ্লিষ্ট উত্তরসূরীদের আর্থিক ভাতা প্রদান করে।
এখন আপনারা তিব্বতী জাতির একজন বৃদ্ধ শিল্পীর পরিবেশিত 'গেসার রাজা' নামে মহাকাব্যের বিশেষ অংশ শুনছেন। গণতান্ত্রিক সংস্কারের আগে তিব্বতের লোকশিল্পীরা সামন্ততান্ত্রিক কৃতদাসের মালিকদের বৈষম্যের শিকার ছিলেন। তাদের সামাজিক মর্যাদা ছিল অতি নিম্ন মানের। এখন স্থানীয় লোকশিল্পীরা তিব্বতী সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার সংরক্ষণের উত্কৃষ্ট উত্তরসূরীতে পরিণত হয়েছেন। তাঁরা 'রাষ্ট্রীয় সম্পদ' হিসেবে মর্যাদা পান। তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের সংস্কৃতি বিভাগে কর্মরত নিমা বলেন, 'গণতান্ত্রিক সংস্কারের আগে জনসাধারণের সাংস্কৃতিক অধিকার উপভোগের অধিকার ছিল না। লোকশিল্পীদের মর্যাদা বলতে গেলে ছিলই না আর জীবনযাপনের মানও ছিল তথৈবচ। তারা শ্রদ্ধাটুকুও পেতেন না। এখন সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের উত্তরসূরী স্থাপন আর কৃষি ও পশুপালন অঞ্চলে সাংস্কৃতিক দলের প্রশিক্ষণের ওপর গুরুত্ব দেয়ার পাশাপাশি কৃষক ও পশুপালকদের সাংস্কৃতিক গঠনকাজে অংশগ্রহণের সক্রিয়তা অনেক বেড়েছে।'
লাসা শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত জমকালো পোতালা প্রাসাদ প্রায় সাত বছর মেরামতের পর আবার নতুন ও দৃষ্টিনন্দন মজবুত চেহারায় প্রকাশ পেয়েছে। পোতালা প্রাসাদে প্রবেশ করে আপনারা রঙিন ও চমত্কার প্রাচীর চিত্রাঙ্কন, তিব্বতী জাতির ঐতিহ্যিক স্থাপত্যের কৌশল আগাতু দিয়ে তৈরি সমতল মাটি ও ছাদ এবং ঝলমলে উঁচু পিলার দেখা যায়। সব জায়গায় এই প্রাসাদের প্রাণবন্ত আমেজ ও শক্তি অনুভব করা যায়।
পোতালা প্রাসাদ সংরক্ষণ প্রকল্পে জড়িত তিব্বতী জাতির প্রাচীন স্থাপত্যকর্ম বিশেষজ্ঞ, চারুকলা ক্ষেত্রের প্রবীন ব্যক্তি মাস্টার নাওয়াং লোদ্রো বলেন, পোতালা প্রাসাদের প্রাচীর চিত্রাঙ্কন আর অন্যান্য প্রাচীর চিত্রাঙ্কনের মধ্যে পার্থক্য আছে। এ কারণে তারা পুনরানয়নের সময় খুব যত্নশীল ছিলেন। যাতে পুনরানয়নের পর এখানকার প্রাচীর চিত্রাঙ্কন দেখতে একদম আগের মতোই। তিনি বলেন, 'পিলারের ওপর চিত্রাঙ্কন করার সময় অনেক সোনা ব্যবহার হয়েছে। আমরা প্রথমে মূলভূভাগের সোনার তবক কারখানায় সোনাকে বিভিন্ন আকারের সোনার পাত প্রক্রিয়াকরণ করি। তা ছাড়া পোতালা প্রাসাদের প্রধান ভবন, লাল ভবন আর ভূগর্ভস্থ বড় হলে চার রকমের রং ব্যবহার করা হয়েছে। বিভিন্ন রং বিভিন্ন উপাদান থেকে সৃষ্ট। উত্তরাংশ ও উপরের পিলারগুলোর বাইরে সোনার পাত দিয়ে সাজানো। দক্ষিণাংশের পিলারের ওপর পান্নার সবুজ রঙের প্রলেপ দেয়া।'
চীনের রাষ্ট্রীয় পরিষদের তথ্য কার্যালয়ের ২০০৮ সালে প্রকাশিত 'তিব্বতের সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও উন্নয়ন' সংক্রান্ত শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে, বিশ্ব সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত পোতালা প্রাসাদসহ চীন সরকার তিব্বতে ৩২৯টি বিভিন্ন পর্যায়ের সংরক্ষিত সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার স্থাপন করেছে। এভাবে তিব্বতের বিভিন্ন ধরনের প্রাচীনকালের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার ও ধ্বংসাবশেষ ভালোভাবে সংরক্ষিত হয়েছে।
তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার ব্যুরোর মহাপরিচালক ইয়ুদাওয়া জানিয়েছেন, গত শতাব্দীর আশির দশক থেকে বিশ বছরে চীন সরকার পোতালা প্রাসাদ, দাচাও মন্দির, বৃটিশ বিরোধি ধ্বংসাবশেষ চিয়াংজিচোশান এবং গুগে রাজ্যের ধ্বংসাবশেষসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ পুরাকীর্তি উদ্ধার করার উদ্দেশ্যে পুনরানয়ন প্রকল্পের জন্য ১৪০ কোটি ইউয়ান বরাদ্দ করেছে। ইযুদাওয়া বলেন, 'গত পাঁচ বছরে চীন চাবুলুন মন্দিরসহ ২২টি সংরক্ষণ ইউনিট ও বিপ্লবী উত্তরাধিকার স্থান সংরক্ষণের জন্য আরো ৫৭ কোটি ইউয়ান বরাদ্দ করেছে। যেমন চাবুলুন মন্দির মেরামতের জন্য ১০ কোটি ইউয়ান রেনমিনপি ব্যয় করেছে। এ প্রকল্প গত বছর আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছে। এর কার্যমেয়াদ ৩ থেকে ৫ বছর।'
এখন তিব্বতের বিভিন্ন জাতির জনগণ নিজের ঐতিহ্যিক সংস্কৃতি সংরক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য নিরন্তরভাবে প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। তিব্বতের ঐতিহ্যিক সংস্কৃতি ধাপে ধাপে সমৃদ্ধি হয়ে যাচ্ছে। তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের সরকারী কর্মকর্তা চাং ছিং লি বলেন, 'ভবিষ্যতে আমরা ধারাবাহিক পদ্ধতিতে সকল সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক ইউনিটকে সুসম্পন্ন করার পরিকল্পনা করেছি। যাতে তিব্বতের ঐতিহাসিক ও সমুজ্জ্বল সংস্কৃতি সুদীর্ঘকাল সংরক্ষিত থাকে।' (ইয়ু কুয়াং ইউয়ে) |