জমজমাট একুশে বইমেলা: প্রকাশনা শিল্পের ঘুরে দাঁড়ানোর আশা
2022-03-13 19:18:14


বাংলা একাডেমির অমর একুশে বইমেলা শেষ হতে বাকি আর মাত্র চারদিন। প্রথম দফায় ২৮ ফেব্রুয়ারির পর মেলার সময় বাড়ানো হয় ১৭ মার্চ পর্যন্ত। মার্চের গরম এবং ঝড়বৃষ্টির আশঙ্কা মাথায় নিয়েই দ্বিতীয় অর্ধে চলছে মেলা। আশঙ্কা ছিল মার্চে মেলায় দর্শনার্থী সমাগম খুব একটা হবে না। কিন্তু সে আশঙ্কা অমূলক প্রমাণিত হয়েছে। মেলায় দর্শনার্থীরা ভালো সংখ্যায় এসেছেন এবং বেচাবিক্রিও ভালো হয়েছে। গত দুবছরের করোনা মহামারির ধাক্কা সামলে দেশের প্রকাশনা শিল্প এবার কিছুটা হলেও ঘুরে দাঁড়াবে বলে আশা দেখা দিয়েছে।

বাংলা একাডেমির বইমেলায় এবার প্রথম তিন সপ্তাহে নতুন বই এসেছে প্রায় আড়াই হাজার। শেষ সপ্তাহে যদি শ’পাঁচেক নতুন বই আসে তবে সে সংখ্যা তিন হাজারের এদিক-ওদিক থাকবে। তবে স্বাভাবিক সময়ে মেলায় নতুন বই আসে অনেক বেশি। যেমন ২০১৮ সালে মেলায় নতুন বই এসেছিল ৪ হাজার ৯১৯টি। অর্থাৎ এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, গতবারের চেয়ে বইমেলা এবার বেশ খানিকটা জমলেও নতুন বই কিন্তু এসেছে কম। স্পষ্টই বোঝা যায় নতুন বই প্রকাশে প্রকাশকদের স্বাভাবিক সময়ের মতো আগ্রহ বা সক্ষমতা ছিল না।

তা ছাড়া নতুন যে সব বই প্রকাশিত হয়েছে তার মান নিয়েও ছিল অসন্তোষ। কিছু ভালো বইয়ের বিপরীতে বেশির ভাগ বই যেনতেন রকমে প্রকাশ করা হয়েছে। ছিল পাইরেটেড বইয়ের ছড়াছড়ি। প্রকাশকরা অভিযোগ করেছেন, এ বিষয়ে বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ যথেষ্ট ব্যবস্থা নেয়নি।

বইমেলায় প্রকাশিত বইয়ের মান নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন ওঠে থাকে। যেমন ২০১৮ সালে মেলায় ৪ হাজার নতুন বই প্রকাশিত হয়। কিন্তু তার মধ্যে মানসম্পন্ন বলা যায় এমন বইয়ের সংখ্যা মাত্র ৪৮৮টি। এর ফলে পাঠকরা নিম্নমানের বই কিনে প্রতারিত হচ্ছেন। এ ক্ষেত্রেও বাংলা একাডেমি যথেষ্ট করছে না বলে অভিযোগ রয়েছে লেখক-প্রকাশকের তরফে। তারা বলছেন- বাংলা একাডেমি শুধু নতুন বইয়ের নাম ঘোষণা করেই দায়িত্ব শেষ করছে। যদি তারা মানসম্পন্ন বইগুলো শনাক্ত করে সেগুলো মেলায় ডিজিটাল বোর্ড বা অন্য কোনো উপায়ে প্রচারের ব্যবস্থা করতো তবে লেখক-প্রকাশকদের পাশাপাশি পাঠকরাও উপকৃত হতেন।

বইমেলায় বেচাবিক্রি এবার ভালো হলেও সঙ্গত কারণেই তা স্বাভাবিক সময়ের মতো হবে না বলে ধারনা করা যায়। ২০২১ সালে করোনায় বইমেলা বিঘ্নিত হয় এবং বিক্রি খুবই কম হয়েছে। এর সঠিক কোনো পরিসংখ্যানও আমাদের হাতে নেই। তবে গতবছরের কথা বাদ দিলে পরিসংখ্যানে দেখা যায় গত কয়েক বছর ধরে বইমেলায় বিক্রি ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। ২০১৪ সালে যেখানে মাত্র ১৬ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে সেখানে ২০২০ সালে বই বিক্রি হয়েছে ৮২ কোটি টাকার। তবে, এবার বিক্রি ভালো হলে গত কয়েক বছরের চেয়ে কম হবে বলেই ধারনা করা যায়।

এবারের মেলায় এ সব ইতিবাচক দিকের বিপরীতে অব্যবস্থাপনার অভিযোগটা মেলার শেষ অব্দিই থেকে গেছে। মেলামাঠে খানাখন্দ থাকায় এবং চলার পথে ইট না বিছানোয় দর্শনার্থীদের সমস্যায় পড়তে হয়েছে। এতবড় মেলায় পর্যাপ্ত শৌচাগার না থাকায়ও অসুবিধায় পড়তে হয়েছে দর্শনার্থী ও  মেলায় বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থার কর্মীদের। একাডেমির মূলমঞ্চ এবং লেখক বলছি মঞ্চে অনুষ্ঠানের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দে লেখক নির্বাচন এবং আলোচক হিসেবে বাংলা একাডেমির সাধারণ কর্মীদের অংশ নেওয়ার অভিযোগ এসেছে গণমাধ্যমে। মেলায় সঠিক জায়গায় বইয়ের স্টল না দেওয়া এবং মাত্রাতিরিক্ত খাবারের দোকান বরাদ্দ নিয়েও কথা উঠেছে। মেলার পরিসর বেশি বড় করার বিরুদ্ধেও কথা বলেছেন অনেকে।

এ বিষয়গুলোতে বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ নিশ্চয় সামনে নজর দেবে। তবে, অন্য সব অভিযোগের ক্ষেত্রে কমবেশি সত্যতা থাকলেও মেলার পরিসর বড় করায় সমস্যার বিষয়টি ধোপে টেকে না। পরিসর বড় হওয়ায় মেলায় একটা খোলামেলা ভাব ছিল- যেটা দর্শনার্থী, লেখক-প্রকাশক সবার জন্যই ভালো ছিল।

মেলায় অব্যবস্থাপনা, কম বই প্রকাশ বা আগের তুলনায় কিছু কম বিক্রি হবার বিষয়টি মেনে নিয়েও বলা যায়- এটা আশার কথা যে এবার বইমেলা ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাস নিয়ে পুরো সময়জুড়ে হয়েছে। এটা লেখক-পাঠকদের জন্য যেমন আনন্দের ছিল তেমনি এতে প্রকাশকরাও কিছুটা হলেও ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন। এটি দেশের প্রকাশনা শিল্পের জন্য খুব বড় একটা স্বস্তির বিষয়।

মাহমুদ হাশিম

ঢাকা স্টেশন, চীন আন্তর্জাতিক বেতার।