অমর একুশে বইমেলা: আয়োজন নিয়ে যতো বাদ-বিসম্বাদ
2022-02-20 19:40:50

জমে উঠেছে এবারের অমর একুশে বইমেলা। শনিবার মেলার পঞ্চম দিনে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেলো ছুটির দিনে মেলায় ব্যাপক দর্শনার্থীর ভিড়। শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে সব বয়সের মানুষ ভিড় করেছেন মেলায়। দলবেঁধে ঘুরে বেড়াচ্ছেন অনেকে, মা-বাবার হাত ধরে মেলায় এসেছে ছোট্টমণিরা। আগ্রহী পাঠকেরা নিমগ্ন হয়ে বই দেখছেন স্টলে স্টলে। প্রকাশক বিক্রেতাদের মুখে হাসি। মেলার শুরুতেই ভালো হচ্ছে বিক্রিবাট্টা! শেষের দিকে মেলা আরও জমে উঠবে বলে আশা তাদের। দৃশ্যত বইমেলা হয়ে উঠেছে সবার চিরচেনা সেই প্রাণের বইমেলা!

তবে, মেলার এই সুন্দর দৃশ্যপটের অন্তরালে কিছু নেতিবাচক বিষয় রয়েই গেছে। এর কিছু চলতি মেলা সংশ্লিষ্ট। আর কিছু মেলা নিয়ে বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ ও প্রকাশক সমিতির দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা বিরোধ-মতভিন্নতা। প্রাকশকদের পক্ষ থেকে বরাবরের মতোই বাংলা একাডেমির বিরুদ্ধে রয়েছে নানা অভিযোগ। আর একাডেমি কর্তৃপক্ষ বরাবরের মতোই আমলে নিতে রাজি নয় এ সব অভিযোগ। উপরন্তু কিছু পাল্টা অভিযোগও রয়েছে প্রকাশকদের বিরুদ্ধে।

সরেজমিন পরিদর্শন ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে দেখা যায়- মেলার দুটি স্থান বাংলা একাডেমি চত্বর ও সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের পরিবেশ দু’রকম। দেখে মনে হয় যেন দুটি মেলা চলছে! বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গনে প্রধানত সরকারি প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন সংস্থার স্টল। পরিবেশ ঝকঝকে-তকতকে! কিন্তু সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের অবস্থা অনেকটাই বিপরীত। মেলা শুরুর পঞ্চম দিনে এসেও মেলার সব স্টল তৈরি পুরোপুরি শেষ হয়নি সেখানে। বিভিন্ন স্থানে স্টল তৈরির আবর্জনা পড়ে থাকতে দেখা গেছে।

এ জন্য মেলার নকাশাকার ও প্রকাশকরা বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষের সমন্বয়হীনতা ও অব্যবস্থাপনাকে দুষছেন। তারা বলছেন, মেলার তারিখ ঘোষণায় বিলম্ব হওয়ায় প্রকাশকরা স্টল নির্মাণে যথেষ্ট সময় পাননি। মেলার দায়িত্বে থাকা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির বিরুদ্ধে যথেচ্ছাচারেরও অভিযোগ আনেন তারা।

কিন্তু বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ এ অভিযোগ মানতে একেবারেই নারাজ। একাডেমির মহাপরিচালক মুহম্মদ নূরুল হুদা বললেন, মেলা বিলম্বে শুরু হওয়ার জন্য একাডেমির কোনো দায় নেই। করোনা মহামারির প্রকোপ বাড়ায় সরকার মেলা কিছু দিনের জন্য স্থগিত করে। এতে তাদের করার কিছু নেই। তবে, প্রস্তুতির জন্য সময় যথেষ্ট ছিল না- এ কথা মানেন তিনি। আর মেলায় ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির যথেচ্ছাচারের অভিযোগও ঠিক নয় বলে মনে করেন বাংলা একাডেমি মহাপরিচালক।  তার বক্তব্য নকশাকারের নকশা অনুযায়ী স্টলসহ সব স্থাপনা নির্মাণ করা হয়। তবে কোনো কোনো প্রকাশক স্টল ও প্যাভিলিয়ন নির্মাণে নির্ধারিত উচ্চতা লঙ্ঘন করেছেন বলে অভিযোগ করেন তিনি। সংশ্লিষ্ট প্রকাশকদের এ বিষয়ে তাদের স্টল-প্যাভিলিয়ন পুনর্বিন্যাসের নির্দেশনা দেওয়ার কথাও জানান বাংলা একাডেমি মহাপরিচালক।

মেলার দুই অংশের চেহারা দুইরকম কেন- এমন অভিযোগের জবাবে নূরুল হুদা জানান, একাডেমি চত্বর আয়তনে ছোট এবং সেখানে মূলত সরকারি প্রতিষ্ঠানের স্টল থাকায় বাংলা একাডেমির পক্ষে তার ব্যবস্থাপনা সহজ। অন্যদিকে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে মূলত প্রকাশকরা স্টল দিয়েছেন। তারা অনেক সময় নিয়মনীতির তোয়াক্কা করেন না বলেও অভিযোগ তার।

মেলার প্রবেশপথে স্বাস্থ্যবিধি মানার কিছুটা চেষ্টা দেখা গেলেও ভিতরে অনেকেই স্বাস্থ্যবিধি মানেন না। যদিও মোবাইল কোর্টের টিমকে কখনো সখনো জরিমানা করতে দেখা গেছে। আর পাইরেটেড বইয়ের বিষয়েও একাডেমির টাস্কফোর্স সতর্ক রয়েছে বলে জানান তিনি।

বাংলা একাডেমির বইমেলা নিয়ে- সবচেয়ে পুরনো যে বিতর্ক- সেটা হলো মেলা আয়োজন করা একাডেমির কাজ বলেই মনে করেন না প্রকাশকসহ সংশ্লিষ্ট অনেকে। প্রকাশকদের বক্তব্য: বাংলা একাডেমির কাজ গবেষণা করা, মেলা আয়োজন নয়। আগে প্রকাশক সমিতিকে মেলা আয়োজনে সহযোগী করা হলেও এখন বলা হয় অংশগ্রহণকারী। কাগজে-কলমেও কোনো ভূমিকা নেই প্রকাশক সমিতির।

পুরনো এ বিতর্কেও মেলা আয়োজনে বাংলা একাডেমির কর্তৃত্বের বিষয়ে দৃঢ় অবস্থান মহাপরিচালকের। তার পাল্টা যুক্তি- মেলা আয়োজন বাংলা একাডেমিরই ঐতিহ্যগত একটি কাজ। আইন করে এ কাজটি সরকার বাংলা একাডেমিকে দিয়েছে বলে জানান তিনি। তাই কেউ চাইলেই সেটা পাল্টে ফেলা যাবে না।

নান বিষয়ে মতবিরোধ থাকলেও উভয়পক্ষ এ বিষয়ে একমত যে- বইমেলার মতো এত বড় একটা আয়োজন এক-দুমাসের প্রস্তুতিতে সম্ভব নয়। এ জন্য বছরব্যাপী কাজ করা দরকার। এ বিষয়ে একটি সমন্বয় সেল করার বিষয়ে সহমত উভয়পক্ষের। সরকার এ বিষয়ে ইতিবাচক সাড়া দিলে বছরধরে প্রস্তুতি নিয়ে সুন্দরভাবে মেলা আয়োজন করা সম্ভব বলে মনে করেন তারা।

মাহমুদ হাশিম

ঢাকা স্টেশন, চীন আন্তর্জাতিক বেতার।