সেই দ্বীপ, সেই মানুষ, সেই বিশেষ চিঠি
2021-04-09 14:18:34

সেই দ্বীপ, সেই মানুষ, সেই বিশেষ চিঠি_fororder_TVXF15631920002431n

 

‘তোমার চলে যাওয়ার পর ৩২ মাস পার হয়েছে। প্রতিটি দিন আমি তোমাকে মিস করেছি। কিন্তু তুমি আর আমাকে সাড়া দাও না।’

চলতি বছরের ছিংমিং দিবস বা সমাধি পরিষ্করণ দিবসের সময়, ওয়াং সি হুয়া নামে একজন নারী খাই শান দ্বীপে এসেছেন, তিনি তাঁর মৃত স্বামী ওয়াং জি ছাই-কে উদ্দেশ্য করে বিশেষ একটি ‘চিঠি’ লিখেছেন।

খাই শান দ্বীপ হল চিয়াং সু প্রদেশের লিয়ান ইয়ু কাং শহরের কুয়ান ইয়ু জেলার একটি সামুদ্রিক দ্বীপ। ওয়াং জি ছাই এবং তাঁর স্ত্রী ওয়াং সি হুয়া ৩২ বছর ধরে এই দ্বীপে থেকেছেন। দেশ রক্ষায় তাদের কাহিনী অসংখ্য মানুষকে মুগ্ধ করেছে।

 

এখনকার দ্বীপটি আসলে সেই দ্বীপ; তবে সেই দ্বীপরক্ষীর মৃত্যু হয়েছে। দ্বীপের পানি, বিদ্যুত্ ও ইন্টারনেটসব বিভিন্ন ব্যবস্থা অব্যাহতভাবে উন্নত হচ্ছে, দফায় দফায় তরুণ মানুষ দ্বীপ রক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করছে। তারা নতুন দ্বীপরক্ষী হয়েছেন। চীনের বিভিন্ন মহলের লোকজনও এই দ্বীপে এসে সংগ্রাম ও সামনে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি ও চেতনা অনুশীলন করছে।

 

সেই দ্বীপ, সেই মানুষ, সেই বিশেষ চিঠি_fororder_MRAR15631919962491n

তোমার সঙ্গে দ্বীপে থাকার সময়গুলোুলতে পারি না

‘এত দিন পর, আমার আরও অনেক কথা তোমাকে বলার আছে। তুমি তা শুনতে পারলেও আমাকে জবাব দিতে পারো না, তবুও আমি তোমাকে কিছু বলতে চাই’।

কলমের আঁচড়ে চিঠিতে অল্প কয়েকটি লাইন লেখা। তবুও স্ত্রী ওয়াং সি হুয়ার চোখ দিয়ে পানি পড়তে থাকে। স্বামী ওয়াং জি ছাই-এর সঙ্গে দ্বীপ রক্ষার সময় অতীতের সময়গুলো আমার চোখের সামনে ভেসে উঠে।

দ্বীপটি বহিঃসমুদ্রের খুব কাছাকাছি। এর কৌশলগত অবস্থানও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৩৯ সালে জাপানি বাহিনী এই দ্বীপের মাধ্যমে সমুদ্র পার হয়ে চিয়াংসু প্রদেশের লিয়ান ইয়ুন কাং শহর দখল করেছিল। গণচীন প্রতিষ্ঠার পর খাই শান দ্বীপে শানতুং প্রদেশের জিনান বাহিনীর একটি দল মোতায়েন করা হয়। গত শতাব্দীর ৮০’র দশক থেকে মিলিশিয়া ফাঁড়িতে পরিণত হয় দ্বীপটি। দশ/বারো জন মিলিশিয়া সেখানে মোতায়েন থাকত। তবে, দ্বীপে খাবার পানি নেই, বিদ্যুত্ নেই, ইঁদুর যেন দ্বীপের একচ্ছত্র মালিক! আর্দ্রতাপূর্ণ ও নিঃসঙ্গ একটি দ্বীপ। ইঁদুরগুলো ১৩ বছর পর্যন্ত বাঁচতো। এর বেশি টিকতো না!

 

১৯৮৬ সালের ১৪ জুলাই, ওয়াং জি ছাই স্ত্রী ওয়াং সি হুয়াকে না জানিয়ে খাই শান দ্বীপ রক্ষা করতে যান। এরপর ওয়াং জি ছাই অনেক দিন ধরে বাসায় ফিরেন নি। এতে ওয়াং সি হুয়া খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। পরিচিত অনেক মানুষজনের কাছে খোঁজ নিয়ে তিনি জানতে পারেন যে, তাঁর স্বামী দ্বীপ রক্ষায় সেই সমুদ্রের মাঝে একাকী বাস করছেন।

 

স্বামী ওয়াং জি ছাই দ্বীপে মোতায়েনের ৪৮তম দিন ভোরে স্ত্রী ওয়াং জি হুয়া জাহাজে উঠে দ্বীপে যান। সমুদ্রে ঘন কুয়াশা! চারদিকে কিছুই দেখা যায় না! তার ভীষণ রাগ হতে থাকে। দেড় ঘণ্টা পর তিনি দ্বীপে পৌঁছান।  তিনি দেখেন, তাঁর স্বামী ওয়াং জি ছাই একাই জেটিতে বসে আছেন, দাড়িও কাটা হয়নি তার। তখন স্বামীর ওপর থেকে সব রাগ হঠাত্ মিলিয়ে যায়। তার বুক ফেটে কান্না বেরিয়ে আসে।

 

স্বামী ওয়াং জি ছাই স্ত্রী ওয়াং সি হুয়াকে নিয়ে দ্বীপে একবার ঘুরে আসেন। তার ঘরের চার দিকে দেখা যায় মদের বোতল, চপস্টিক্স ও নোংরা কাপড়-চোপড়। বাসায় ফিরে যাওয়ার আগে স্ত্রী ওয়াং সি হুয়া তার স্বামীকে বলেন: দ্বীপ ছেড়ে বাসায় চলো। কেউ এখানে থাকতে চায় না, তুমি কেন এখানে থাকবে!’

তবে ওয়াং জি ছাই যান নি, তিনি স্ত্রীকে শুধু বলেন: ভালোভাবে শিশুদের শিক্ষা দাও, মেয়ের যত্ন নাও, আমাকে নিয়ে চিন্তা কোরো না’।

 

স্ত্রী ফিরে যাওয়ার পর স্বামী ওয়াং জি ছাই হাউ মাউ করে কাঁদেন!

 

স্ত্রী ওয়াং সি হুয়া বাসায় ফিরে যাওয়ার পর প্রতিদিন মাথায় ঘুরতে থাকে স্বামীর কালো ও শুকনো দেহ। তিনি সিদ্ধান্ত নেন, আবারও দ্বীপে ফিরে স্বামীর সঙ্গে থাকবেন। স্বামীর যত্ন নিতে হবে। তারপর এক মাসের মধ্যে স্ত্রী ওয়াং সি হুয়া আবারও পার্সেল ও লাগেজ নিয়ে দ্বীপে গিয়ে ওঠেন। তবে এইবার তিনি আর ফিরে আসেন নি।

 

ওয়াং জি ছাই মারা যাওয়ার আগে একটি ভিডিও রেকর্ড করেছিলেন। ভিডিওতে ওয়াং জি ছাই দ্বীপে থাকার শুরুর সময়ের কথা স্মরণ করে বলেন: তখন, এখানে থাকতে খুব ভয় লাগত। এখানে আমি ছাড়া কেউ নেই। দরজায় একটু শব্দ হলে ভয় লাগত! ভীষণ ভয়! না-জানি দরজার বাইরে কী আছে!’

 

প্রচুর বাতাস, ঝড়বৃষ্টি, তীব্র সূর্যের আলো, খাবার পানি নেই, বিদ্যুত্ সমস্যা...খাই শান দ্বীপ যদিও ছোট, তবে কঠিনতা কিন্তু অনেক বড়।

ওয়াং জি ছাই দম্পতি খাই শান দ্বীপে আসার আগে দশ/বারোজন মিলিশিয়া দ্বীপ রক্ষার কাজ করেছিলেন। তবে সর্বোচ্চ ১৩ দিনের বেশি কেউ দ্বীপে ছিলো না। কিন্তু, তারা ৩২ বছর ধরে এই দ্বীপ রক্ষা করেছেন।

 

ওয়াং সি হুয়া বলেন, শুরুর দিকে কল্পনা করতে পারি নি যে, এত লম্বা সময় থাকতে পারবো। তবে সময় পার হয়ে যায়, আমরা আস্তে আস্তে দ্বীপের জীবনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছিলাম। পরে আর যেতে ইচ্ছে করত না। ওয়াং সি হুয়া বলেন, আমার স্বামী কিন্তু খুব দায়িত্বশীল একজন মানুষ, দেশের দায়িত্ব ও কর্তব্য, সে নিশ্চয় ভালোভাবে সম্পন্ন করবে। ওয়াং সি হুয়া বলেন, তাদের মনে দ্বীপ রক্ষা করার অর্থ, একটি ‘সীমিত সময়ের কর্তব্য’ থেকে ‘চিরদিনের দায়িত্ব’ পালনের কাজ করা।

 

১ অক্টোবর দ্বীপে প্রথম ওঠেন তারা। অর্থাত্ চীনের জাতীয় দিবসের দিন। সেদিন ওয়াং জি ছাই ও ওয়াং সি হুয়া জাতীয় পতাকা উত্তোলনের সিদ্ধান্ত নেন। ‘তারকাখচিত জাতীয় পতাকা বাতাসে উড়লে দ্বীপে অন্তত কিছু রং দেখা যাবে! এই দ্বীপ রক্ষার কাজটি অর্থপূর্ণ হবে। জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা তাদের প্রতিদিনের প্রথম কাজে পরিণত হয়েছিল।

 

২০০৩ সালের ১০ অক্টোবর, কুয়ান ইয়ুন জেলা ওয়াং জি ছাই একজনের জন্য কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হওয়ার শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান আয়োজন করে। সিপিসি’র পতাকার সামনে, ওয়াং জি ছাই গুরুগম্ভীর কণ্ঠে ঘোষণা করেন: আমি সিপিসি ও জনগণের জন্য নিজের সবকিছু উত্সর্গ করতে প্রস্তুত’।

৩২ বছর ধরে স্বামী দ্বীপ রক্ষা করেছে, স্ত্রী স্বামীর সঙ্গে থেকেছে,... স্বামীর জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত।

 

আধুনিক সভ্যতা এই দ্বীপ থেকে অনেক দূরে রয়ে গেছে!

 

দীর্ঘসময় ধরে ওয়াং সি হুয়া দম্পতি বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ করতেন শুধু চিঠির মাধ্যমে। ২০০৮ সালেও খাই শান দ্বীপে বিদ্যুত্ সরবরাহ ছিল না! বাইরের তথ্য জানার জন্য ওয়াং সি হুয়া দম্পতি শুধুই রেডিও শুনতেন।

দ্বীপ রক্ষার জন্য ওয়াং সি হুয়া দম্পতি অনেক ত্যাগ স্বীকার করেন। ওয়াং জি ছাই নিজের মেয়ের জন্য খুব জাঁকজমক একটি বিয়ের অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তবে, দ্বীপ রক্ষার জন্য তিনি নিজের মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে যেতে পারেন নি। সেদিন ওয়াং সি হুয়া মেয়েকে বলেন, তুমি তোমার বাবার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। বাবা তোমাকে খুব ভালোবাসে। তবে তোমার বাবা একজন সেনা। দ্বীপ রক্ষা করা তার নিজের জীবনের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। পরে, তার মেয়ের বিয়ের দিনে, নিজের বাসার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বহুদূর থেকে দ্বীপের দিকে তাকিয়েছিলেন।

 

দ্বীপে সুপেয় পানির সমস্যা সমাধানের জন্য কর্তৃপক্ষ দ্বীপে জাহাজের মাধ্যমে পানি সরবরাহ করার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে যখন ওয়াং জি ছাই জানতে পারেন যে, একবার পানি পাঠাতে ৫ হাজার ইউয়ান লাগে। তিনি আর তা গ্রহণ করেন নি, বরং নিজেই দ্বীপে পানি বিশুদ্ধ করার কাজ শুরু করে দেন।

তাদের দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম হয় দ্বীপে। তখন সমুদ্রে টাইফুন চলছিল। উথাল-পাথাল ঢেউ দ্বীপে আছড়ে পড়ছিল! চারদিক প্রচণ্ড ঝড়। সমুদ্রের আবহাওয়া এত খারাপ ছিল যে, কোনো জাহাজ দ্বীপে যেতে পারছিল না। সন্তান প্রসবের সময় প্রচণ্ড কষ্ট হয় ওয়াং সি হুয়ার। তিনি বলেন, তখন সত্যি স্বামীর ওপর প্রচণ্ড রাগ ও ঘৃণা তৈরি হয়।’ কোথাও কোনো সাহায্য পাওয়ার উপায় নেই। ওয়াং জি ছাই নিজের কাপড়কে গজ হিসেবে ব্যবহার করেন, নিজেই কাঁচি দিয়ে নাড়ী কেটে শিশুর জন্ম দেন!

 

সৌভাগ্যের বিষয় হলো, মা ও শিশু দুজনই সে যাত্রায় রক্ষা পায়। পাঁচ দিনের পর শাশুড়ি দ্বীপে এসে এমন বিপদের কথা শুনে খুব তিরস্কার করেন।

 

অনেকেই ওয়াং জি ছাইকে ‘দ্বীপের মালিকা’ হিসেবে ডাকেন। কারণ খাই শান দ্বীপে তারা অনেক মানুষকে উদ্ধার করেছেন। তারা বলেন: এটি খুব সাধারণ ব্যাপার, মানুষ বিপদে পড়ে, তাকে তো অবশ্যই সাহায্য করা উচিত, তাই না?

 

২০০৮ সালে খাই শান দ্বীপে প্রথম ছোট আকারের জেনারেটর স্থাপন করা হয়। ওয়াং সি হুয়া ও ওয়াং জি ছাই জীবনের প্রথম টিভি অনুষ্ঠান দেখতে পারেন। তবে শুধু ছয় মাস! কারণ, এরপর সেই জেনারেটর নষ্ট হয়ে যায়। তা আর ঠিক করা হয়নি। তারা আবারও বিদ্যুত্হীন জীবনে ফিরে যান। শুধু দ্বীপে চীনের জাতীয় পতাকাটিই সবসময় নতুন থাকে। ৩২ বছরের মধ্যে তারা প্রায় ২ শ’টি জাতীয় পতাকা কিনেছেন। এর দাম আগের কয়েক ইউয়ান থেকে কয়েক ডজন ইউয়ান বেড়েছে, তবে তাদের বেতন ৩২ বছর ধরে সবসময় ৩৭০০ ইউয়ানই ছিল। এর কোনো পরিবর্তন হয় নি।

 

কেউ জিজ্ঞেস করে, তোমরা এমন করো কেন? কেউ কেউ তাদেরকে বোকা বলে!

ওয়াং জি ছাই বলেন, তোমাদের জীবন কাটানোর পদ্ধতি আছে, আমার নিজের জীবন কাটানোরও পদ্ধতি আছে, জীবন সম্বন্ধে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি তোমাদের চেয়ে ভিন্ন।

তিন বছর আগে, ওয়াং জি ছাই এবং ওয়া সি হুয়ার প্রতি বছরের ভর্তুকি ২০ হাজার ইউয়ান বাড়ে। তাদের আর্থিক অবস্থা দেখতে দেখতে ভালো হয়। তবে ওয়াং জি ছাই এমন সময়ই মারা যান। ২০১৮ সালে একবার টহলের সময় আকস্মিক ঘটনায় তিনি মারা যান। তার বয়স হয় মাত্র ৫৮ বছর!

সেই দ্বীপ, সেই মানুষ, সেই বিশেষ চিঠি_fororder_RFQI15631920066981n

দ্বীপের পরিবর্তন তুমি কল্পনাও করতে পারো না

স্ত্রী ওয়াং সি হুয়া মৃত স্বামী ওয়াং জি ছাইকে চিঠিতে লেখেন: আমি জানি তুমি দ্বীপের সব কিছু মনে রেখেছো। তুমি চিন্তা করো না, দ্বীপের সব কিছুই ভালো আছে। গত কয়েক বছরে দ্বীপের আকাশ-পাতাল পরিবর্তন ঘটেছে। সমুদ্রের পানিকে পানীয় জলে পরিণত করার ব্যবস্থা চালু হয়েছে ও দ্বীপে বিদ্যুত্ চলে এসেছে। এখন রাতের বেলা দ্বীপে বাতি জ্বলে।

 

ওয়াং সি হুয়া বলেন, আমাদের ছেলে তোমার ইচ্ছা অনুযায়ী বাহিনীতে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমাদের দ্বীপ রক্ষা কাজের উত্তরসূরি আছে এখন অনেক। দ্বীপ রক্ষার কাজ আরো সুসংহত হয়েছে। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো।