ইত্তেফাক: কি ছিল না অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে? সেটাই আগে খোঁজা উচিত। চমক দেখানোর জন্য যা যা করা উচিত, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে চীন সেই ক্যারিশমার সবটুকু প্রয়োগ দেখায়। ইতিহাস, ঐতিহ্য, প্রত্নতাত্ত্বিক সৌন্দর্য, প্রাচীনকালের চৈনিক যোদ্ধার সেই হুংকার, হাতের সুতোয় দোলানো পুতুল নাচের ছন্দ-চোখধাঁধানো আতশবাজির রোশনাই, লেজার আলোর ঝলকানি, হর্ষ-উল্লাস ধ্বনি, যুদ্ধ জয়ের আনন্দ, কারাতে ও মার্শাল আর্টের ছন্দময় প্রদর্শন-পুরো উদ্বোধনী অনুষ্ঠানকে এক কথায় যদি প্রকাশ করতে চান তবে একটা শব্দই শোনা যাবে সবার আগে 'অভূতপূর্ব।'
এমনটা আগে কখনো দেখা যায় নি। বেইজিংয়ের বার্ড নেস্ট স্টেডায়ামে তিন ঘন্টার এই আলো ঝলমল উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দেখা চীনের সবচেয়ে কঠোর সমালোচকের মুখেও প্রশংসা শুনবেন এখন! অলিম্পিক দিয়ে পেছনের সবকিছুকে বদলে দেয়ার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল চীন সেই চেষ্টার প্রথম ধাপেই কাল বিনা বাধায় 'ফুলমার্কস' পাচ্ছে চীন। ইতিহাস নাকি কাঠখোট্টা বিষয়? কিন্তু ২৯তম অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে চীন তাদের হাজার বছর পুরানো ইতিহাসও ঐতিহ্যকে যে অপরূপ কায়দায় উপস্থাপন করেছে তা যেন 'সুখপাঠ্য সাহিত্যেই' মর্যাদা পাচ্ছে। নৃত্য-গান ও ইতিহাস-ঐতিহ্যের বর্ণনা পর্বে পুরো স্টেডিয়াম জুড়ে ছিল মায়াবী নীলাভ আলোর দ্যুতি। গোটা মাঠকে মনে হচ্ছিল রঙ্গিন কার্পেট। সেই কার্পেট আবার ক্ষণে ক্ষণে রং বদলাচ্ছিল! যেন চীনের একেক যুগের একেক অধ্যায়ের একেক রং। ১৫ হাজার শিল্পী অপূর্ব দক্ষতায় সমানতালে নেচে যান।
চীনা ইতিহাসের অন্যতম প্রাচীন জিয়া ও স্যাং রাজবংশের সময় রাজদরবারে রাজ-রাজড়াদের মনোরঞ্জনের জন্য রাজবংশীরা ব্রোঞ্জ অথবা কাদামাটি দিয়ে তৈরি 'ফাউ' নামের একধরনের যন্ত্রে সুর তুলতেন। বেইজিংয়ের কাল রাতের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে হাজার বছর পুরানো সেই সুর ফিরিয়ে এনেছিলেন যন্ত্রীরা। সেই তিন হাজার বছর আগে গাছের বাকল কেটে তৈরি করা সুরেলা যন্ত্র গুকিনের মাদকতা ছড়ানো সুরের মূর্ছনায় মুগ্ধ হয়ে মাথা দুলিয়েছেন মোহিত দর্শকরা। ম্যান্ডারিন ভাষা বুঝতে না পারলেও হ্যামিলিনের বাঁশিওয়ালার পেছন পেছন যাবার মতো সেই সুরের সঙ্গে মাথা নেড়েছেন বার্ড নেস্ট স্টেডিয়ামে উপস্থিত ৯০ হাজার সৌভাগ্যবান দর্শক। আর টেলিভিশনের পর্দায় দুনিয়াজুড়ে প্রায় চার কোটি মানুষ উপভোগ করেছেন চীনের প্রাচীন ঐতিহ্যের এই অনুপম সৌকর্য।
জাঁকজমকপূর্ণ এবারের অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পুরো পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন চীনের সেলিব্রেটি সিনেমা নির্মাতা চাং ই মো। অ্যাক্রোবেটিক ডিসপ্লের মধ্য দিয়ে গ্রেট ওয়াল, সিল্ক রোডের ইতিহাস, মার্শাল আর্টের প্রতি চীনের মানুষের মমত্ব ইত্যাদি বিষয় দারুণ দক্ষতায় মঞ্চনাটকের আবহে ফুটিয়ে তুললেন চাং।
চীনা প্রেসিডেন্ট হু জিন থাওয়ের আনুষ্ঠানিক ঘোষণার মধ্য দিয়ে বেইজিং অলিম্পিক পাখা মেলল। বার্ড নেস্ট স্টেডিয়ামে অলিম্পিকের মশাল জ্বালেন চীনের তারকা জিমন্যাস্ট লি নিং। ১৯৮৪ সালের লস এঞ্জেলস অলিম্পিকে লি নিং তিনটি স্বর্ণপদক জিতেছিলেন। সেই জন্যই এবারের অলিম্পিকের মশাল প্রজ্বলনের দায়িত্বটা দিয়ে তাকে সম্মানিত করল চীন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের জন্য যদি কোন মেডেলের ব্যবস্থা থাকতো তবে নিশ্চিতভাবে ধরে নিতে পারেন সেই ইভেন্টের স্বর্ণপদকটা ঝুলত চীনের গলায়। অলিম্পিকের উদ্বোধন দিয়েই যে চীন বিশ্ব মাত করে দিয়েছে এবার। |