ভারতীয় চলচ্চিত্র 'ছিছোরে'
  2020-01-02 15:19:44  cri

মাঝেমাঝে আমরা পত্র-পত্রিকায় এমন-সব খবর পড়ি, যা আমরা কখনওই দেখতে চাই না। যেমন স্কুলের এক পরীক্ষায় আশানুরূপ ফল না পেয়ে, আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে কোনো সম্ভাবনাময় শিক্ষার্থী! এমন খবর আমরা কেউ দেখতে চাই না।

এমন খবর নিয়ে কিছু দিন আলোচনা চলে। তারপর আবার সব আগের মতো চলতে থাকে। অভিভাবকেরা বুঝতেই পারেন না, পরীক্ষায় হেরে যাওয়ার ভয়ে তাদের প্রাণচঞ্চল সন্তানরা কেন বাসায় ফিরতে চায় না! এই বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার আগে আমরা একসঙ্গে 'ছিছোরে' নামে ভারতীয় এই চলচ্চিত্রের ওপরে দৃষ্টি দেবো।

হয়তো অনেক শ্রোতাবন্ধুই 'ছিছোরে' চলচ্চিত্রের সঙ্গে পরিচিত। আসলে গত বছর এ চলচ্চিত্র মুক্তি পাওয়ার পরপরই কোটি কোটি মানুষের কাছে তা বার্ষিক শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়।

এ চলচ্চিত্র পরিচালকও অনেক চীনাদের পরিচিত। তিনি হচ্ছেন ২০১৬ সালে চীনে প্রদর্শিত দারুণ জনপ্রিয় ভারতীয় চলচ্চিত্র 'দঙ্গল'-এর পরিচালক নিতেশ তিওয়ারি।

'দঙ্গল' চলচ্চিত্রের পর পরিচালক নিতেশ তিওয়ারি আর কোনো নতুন চলচ্চিত্রের কাজে হাত দেন নি। তিন বছর পর তিনি 'ছিছোরে' নামে চলচ্চিত্র নিয়ে দর্শকদের সামনে হাজির হন।

বলিউডে বেশ কিছুদিন ধরে এমন-সব ছবি বক্স অফিসে রাজত্ব করছে, যে ছবির গল্প সাধারণ মানুষের কাহিনী শোনায়। এমনই এক সাধারণ অথচ খুবই প্রাসঙ্গিক একটি গল্প বলছে 'ছিছোরে'।

ছবিটি শুরু হয় এমন এক ছাত্রকে দেখিয়ে, যে তার জীবনের একমাত্র টার্গেট করে ফেলেছে ইঞ্জিনিয়ার হাওয়ার। নাহলে তাকে 'হেরো' বলবে সবাই। কারণ, তার পিতা-মাতা দু'জনেই স্কলার। পরীক্ষার রেজাল্টের দিন নিজের ব্যর্থতাকে কীভাবে সামাল দেবে, তা বুঝতে না পেরে নিজের জীবনকে শেষ করার চেষ্টা করে সে। সে ছাদ থেকে লাফ দেয়। এরপর মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে ভর্তি করা হয় আইসিইউতে। তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডক্টর তার বাবাকে বলেন, সন্তানের বেঁচে থাকার ইচ্ছাটা মরে গেছে। ছেলেকে বাঁচাতে বাবা মরিয়া হয়ে যায়। ছেলের মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে এবার কী করবে বাবা-মা? এক অভিনব উপায় বের করে তার বাবা। ছেলেকে বাবা নিজের কলেজের হোস্টেল জীবনের গল্প বলেন।

এবারই শুরু হয় ছবির গল্প যেখানে ছেলেটির অভিভাবক নিজের জীবনের সেই সময়কে মনে করতে থাকেন যেখানে নিজেদের কলেজ জীবনে নিজেরাই 'লুজার' নামে পরিচিত ছিলেন। হস্টেলে বাবার বন্ধু হলেন 'সেক্সা', 'মাম্মি', 'বেওড়া', 'ডেরেক' এবং 'অ্যাসিড'। এমনতরো নাম ব্যবহারেই এই চরিত্রগুলির গতিবিধি কিঞ্চিত্ আন্দাজ করা সম্ভব। কলেজে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তেন বাবা। হস্টেলে তাকে এবং তার পাঁচ জন সঙ্গীদের বলা হতো 'লুজার্স'। কারণ তারা একসঙ্গে থাকতো সব থেকে খারাপ হস্টেলে, কোনও কাজ করতে পারত না এবং বার্ষিক খেলায় অবরাধিতভাবে হেরে যেত। বাবা ও তার সঙ্গীরা একবার শেষ চেষ্টা করার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা কি জিততে পারবে? তাদের 'লুজার্স' তকমা কি ঘুচবে? গল্প শেষে ছেলে কী বেঁচে উঠবে?

এক কথায় বলতে গেলে, এটি একটি অসাধারণ ছবি! এই গল্প দর্শকদের হাসাবে, কাঁদাবে, নতুন প্রজন্মকে বাঁচার তাগিদ দেবে, সেই সঙ্গে প্রবীণদের নস্টালজিক করে তুলবে।

যারা 'ছিছোরে' চলচ্চিত্র দেখেছেন, তারা নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারেন যে, চলচ্চিত্রটি দর্শকদের যে বার্তা দিতে চায় তা হলো, ব্যর্থতার সামনে সন্তানকে শিক্ষা দেওয়ার কৌশল।

এ চলচ্চিত্রের পরিচালক নিতেশ তিওয়ারি তার চলচ্চিত্র সম্পর্কে বলেন, 'আমি মনে করি, এই ছবিটি দেশের নতুন প্রজন্মের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, এই ছবি তাদের এন্টারটেইন তো করবেই, সঙ্গে সঙ্গে জীবন সম্পর্কে তাঁদের নতুন দৃষ্টিভঙ্গিও দেবে। তাই নতুন প্রজন্মকেই দেখাতে চেয়েছি ছবিটি।'

ছবির নামকরণ সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য এমন, 'যারা হোস্টেল জীবন কাটিয়েছেন, তাঁরা অল্প-বিস্তর দুষ্টুমি করেছে। কেউ প্রথম দিকে অথবা কেউ কলেজের শেষ দিকে। এই দুষ্টুমিটা নিজের মনের মধ্যে থেকে গিয়েছে গোটা জীবনে। তাই আমার মনে হয়েছে, এই ছিছোরে নামটাই কলেজ জীবনের বন্ধুত্বকে প্রকৃতভাবে তুলে ধরবে।'

ছবির ট্রেলার দেখে যারা এই ছবি দেখতে যাবেন তাঁদের মনে হতেই পারে, শুধুমাত্র কলেজ জীবনের কিছু দুষ্টুমি, প্রেম, বন্ধুত্বের সঙ্গে নস্টালজিয়ার মিশেল। তবে, ছবি শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এক নির্মম সত্যের সঙ্গে পরিচিত হবে দর্শক। তারা বুঝতে পারবেন, নিজের অজান্তেই অভিভাবকেরা তাদের সন্তানদের মানসিক চাপ দিয়ে থাকেন; যা কখনওই ঠিক নয়।

এই সমাজে বাবা মা যথেষ্ট চাপে থাকেন, তাঁরা নিজেরাও কোথাও ব্যর্থতার সম্মুখীন হতে চান না। তাঁদের উচিত্ বাচ্চাদের ব্যর্থতার সম্মুখীন হতে শেখানো, জীবনে 'না' বলতে ও শুনতে শেখাতে হবে। কারণ, কারও জীবনে সবকিছু মনের মতো হয় না। তাই ব্যর্থতাকে জয় করে এগোতে শেখাতে হবে, নিজেদেরকেও কেরিয়ার কাউন্সেলিং করতে হবে। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ছাড়াও, নতুন অনেক কিছু হওয়ার আছে; নতুন কী কী কেরিয়ার তৈরি হচ্ছে তার খোঁজ রাখতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, শুধুমাত্র মার্কশিট দিয়েই সন্তানের বিচার না করে তার প্রতিভাগুলোকে খুঁজে দেখে সে দিকগুলোকে উত্সাহ দিতে হবে। হয়তো, এভাবে সন্তানের আত্মহত্যা রোধ করার মতো বিষয় এড়ানো সম্ভব।

'ছিছোরে' ছবিটি নতুন প্রজন্মের দর্শকদের জীবন সম্পর্কে নতুন কিছু শেখাবে। অনাবিল আনন্দের মাধ্যমে সমাজের এক ভয়াবহ সত্য হাসির ছলেই পরিচালক দর্শকদের মনের মধ্যে গেঁথে দিয়েছেন।

আসলে জীবন মনে কি? দেশের সর্বোত্কৃষ্ট ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়বার সুযোগ পাওয়াই কি তাহলে জীবনের প্রকৃত অর্থ? জীবন মানে কেবলই কি অঙ্কে 'ফুল মার্কস' পাওয়ার লড়াই? লুজার আর উইনার, এই দুই বিভাজনের মূল সূত্রটি আদতে কী? এবং সেগুলোকে এভাবে নির্দিষ্টই বা করে দিলো কে?

ব্যর্থতা কাকে বলে? যে ক্লাসে ফেল করে, তাকে? যে তার প্রেমিক বা প্রেমিকার কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়, তাকে? আজকের এই সমাজে সবাই অন্যকে মাপে তার সাফল্য দিয়ে। কি সেই সাফল্য? অনেক বড় চাকরি পাওয়া, অনেক বেশি টাকা উপার্জন? অনেক টাকা কামালেই সে সফল? আর এসব না হলে সে ব্যর্থ? নাকি চেষ্টাটাই আসল? 'ছিছোরে' ছবিটি দেখার পর এই সব সহজ কিন্তু জটিল বাস্তব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেন সবাই।

বরুণ শর্মা, সুশান্ত সিং রাজপুত, শ্রদ্ধা কাপুর, তাহির রাজ ভাসিনও নাবীন পলিশেটি, তুষার পান্ডে, সাহার্য কুমার শুক্লা এবং প্রতীক বাব্বার 'ছিছোর' ছবিতে বেশ ভালো অভিনয় করেছেন। অভিনয়ের পাশাপাশি ছবির গানগুলো বেশ সুন্দর, বারবার শোনার মত গান হয়েছে। ছবির ক্লাইম্যাক্স অন্যান্য ছবির চেয়ে আলাদা যা বেশ ভালো লেগেছে।

সিনেমা হিসেবে 'ছিছোরে' যথেষ্ট ভালো ছিলো। বন্ধুত্বের গল্প নিয়ে যারা দেখতে পছন্দ করেন, তাদের জন্য মাস্টওয়াচ।

বন্ধুত্ব প্রসঙ্গে ভারতের আরো অনেক জনপ্রিয় ছবি আছে, যেমন, থ্রি ইডিয়টস, সোনো কি টিটু কি সুইটি, পেয়ার ক্যা পাঞ্চনামা সিরিজ প্রভৃতি।

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040