শিক্ষা কর্তব্যের উন্নয়নে ব্যাপক পরামর্শ
এনপিসি'র প্রতিনিধি ও চীনের শিক্ষা সমিতির উপ-প্রধান, ছাংচিয়াং শিক্ষা গবেষণাগারের প্রধান অধ্যাপক চৌ হুং ইউ ১৬ বছরের মতো প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি গত ১৬ বছরের মধ্যে তিন শতাধিক প্রস্তাব ও পরামর্শ জমা দিয়েছেন। তিনি চীনের শিক্ষা কর্তব্যের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।
২০০৩ সালে প্রথমবারের মতো এনপিসি'র প্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি রাষ্ট্রীয় শিক্ষা ব্যয় ও বাধ্যতামূলক শিক্ষার উন্নয়ন অবস্থা অনুযায়ী গ্রামাঞ্চলে ৯ বছরের বিনা বেতনে বাধ্যতামূলক শিক্ষার প্রস্তাব করেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন,
'আমার মনে হয় ওই বছর রাষ্ট্রীয় শিক্ষা ব্যয় ছিলো ৩৮৫ বিলিয়ন ইউয়ান। আমি হিসাব করে দেখি যে, বাধ্যতামূলক শিক্ষার প্রাথমিক পর্যায়ে মাথাপিছু বার্ষিক খরচ ৫০০ ইউয়ান, মাধ্যমিক পর্যায়ে মাথাপিছু খরচ ১০০০ ইউয়ান, তাই বিনা বেতনে বাধ্যতামূলক শিক্ষা প্রদানে ১৫০ বিলিয়ন ইউয়ানের বেশি দরকার। নির্ধারিত বরাদ্দের সঙ্গে তুলনা করলে ১৫০ বিলিয়ন ইউয়ান বাতিল করা অসম্ভব।'
চীন সরকার ও সিপিসি'র গুরুত্বে বাধ্যতামূলক শিক্ষায় ব্যাপক অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। ২০০৭ সালের শরত্কালীন সেমিস্টারে চীনের গ্রামাঞ্চলে বাধ্যতামূলক শিক্ষায় বই ও লেখাপড়ার ভর্তুকিসহ বিভিন্ন খরচ বাতিল করা হয়। সেই সঙ্গে ২০০৮ সালের শরত্কালীন সেমিস্টারে শহর ও গ্রামাঞ্চলের খরচ বাতিল করা হয়। ২০১৭ সালে চীনের বাধ্যতামূলক শিক্ষায় সব বই বিনা খরচে প্রদান করা হয়।
চলতি বছরের দুই অধিবেশনে 'সার্বিকভাবে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের ১৫ বছর মেয়াদি বিনা বেতনে শিক্ষাগ্রহণ প্রস্তাব' পেশ করেন চৌ। তিনি বলেন,
'প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য বিনা বেতনে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ প্রদান করা তাদের উন্নয়ন ও সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয়। প্রেসিডেন্ট সি সার্বিক সচ্ছল সমাজ গড়ে তোলার কথা বারবার ঘোষণা করেন। অর্থাত্ কোনো লোক আর অভাবের মধ্যে থাকবে না, তাদের মধ্যে অবশ্যই প্রতিবন্ধীরা অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন।'
অধ্যাপক চৌ'র চোখে এনপিসি'র প্রতিনিধিদের প্রস্তাব ও পরামর্শ গঠনমূলক হতে হবে। কারণ তা থেকে এনপিসি'র ব্যবস্থার প্রাধান্য প্রতিফলিত হয়। এনপিসি'র অধিকাংশ প্রতিনিধি বিভিন্ন শিল্পের অবস্থার সঙ্গে পরিচিত, তাই সম্পূর্ণভাবে রাষ্ট্রীয় অবস্থা বিবেচনা করে প্রস্তাবের বাস্তবায়ন ও সম্ভাবনার চিন্তা করতে হবে। তাঁর এবারের প্রস্তাব ও পরামর্শ এ ভিত্তিতে পেশ করা হয়। তিনি বলেন,
'আমার প্রস্তাব আর্থিক ব্যয়ের সাথে জড়িত হলে আমি মৌলিক স্তরে গিয়ে গবেষণা করি। যেমন এবার 'প্রতিবন্ধীদের ১৫ বছর মেয়াদি বিনা বেতনে শিক্ষাগ্রহণ' প্রস্তাব জমা দেওয়ার আগে আমি অনেক প্রদেশের স্কুলে গবেষণা করেছি। বেইজিংয়ে যাওয়ার আগে উহান শহরের বিভিন্ন এলাকা ও জেলায় গবেষণা করেছি, সেখানকার প্রতিবন্ধীদের স্কুল পরিদর্শন করি আর শিক্ষক ও প্রতিবন্ধি শিক্ষার্থীদের সাথে আলোচনা করি। তাছাড়া, সরকারি বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্ম-ব্যবস্থা জেনে নিতে হবে। ত্রয়োদশ পাঁচসালা পরিকল্পনা চলাকালে প্রতিবন্ধীদের জন্য ১২ বছরের মতো বিনা বেতনে শিক্ষাগ্রহণ পরিকল্পনা প্রণয়ন করে চীন সরকার। আমার জানা মতে এ পরিকল্পনা দ্রুতভাবে চালু হয়। এছাড়া, কিছু কিছু এলাকায় ১২ বছর মেয়াদি বিনা বেতনে শিক্ষাগ্রহণ বাস্তবায়ন করার পাশাপাশি ১৫ বছর মেয়াদি বিনা বেতনের সম্ভাবনা গবেষণা করা হয়।'
চলতি বছরের দুই অধিবেশনে শিক্ষার আইন প্রণয়ন সম্পর্কেও প্রস্তাব জমা দেন চৌ। আইন প্রণয়ন ও শিক্ষার আইন প্রয়োগকারী তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা গড়ে তোলা অতি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন,
'শিক্ষার আইন প্রশাসন শিক্ষা উন্নয়নের ভিত্তি ও দীর্ঘকালীন নিশ্চয়তা। যদিও বর্তমানে শিক্ষা সম্পর্কিত ৭টি আইন রয়েছে এবং অপ্রাপ্তবয়স্কদের সুরক্ষা আইনও চালু হয়েছে, তবে অন্যান্য খাতের আইন প্রণয়নের তুলনায় শিক্ষার আইন একটু কম।'
গত ১৬ বছরে অধ্যাপক চৌ'র প্রস্তাবের ৭০ শতাংশ সরকারি বিভাগ গ্রহণ করেছে। জনগণের স্বার্থকে ভিত্তি করে পেশাগত পরামর্শ দেওয়া এনপিসি'র প্রতিনিধিদের দায়িত্ব বলে মনে করেন তিনি।
শিক্ষাদানে 'মাথায় বরফ জমে থাকা' বাচ্চাদের ভাগ্য পরিবর্তন হবে
গত বছরের অনুষ্ঠানে আমরা চীনের ইউয়ুননান প্রদেশের চাওথুং শহরের একজন ছেলের গল্প তুলে ধরেছি। তার নাম ওয়াং ফু মান। ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় কয়েক কিলোমিটার পথ হেঁটে স্কুলে যাবার কারণে তার মাথায় বরফ জমে যায়। এ ঘটনা চীনের ওয়েবসাইটে প্রচারিত হবার পর সে লোকজনের ব্যাপক মনোযোগ লাভ করে।
এ সম্পর্কে ২০১৮ সালে এনপিসি'র প্রতিনিধি জেন লান ফাং চীনের প্রচণ্ড শীত-কবলিত পাহাড়ি অঞ্চলে হিটিং ব্যবস্থা ও সরঞ্জাম এবং বোর্ডিং স্কুল স্থাপনের প্রস্তাব দেন, যাতে পাহাড়ি অঞ্চলে ফুমানের মতো বাচ্চারা ভালোভাবে লেখাপড়া করতে পারে।
চলতি বছর তিনি আবার ফুমানের বাসায় যান। তিনি খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন যে, ফুমান ও তার বোন হিটিং ব্যবস্থাসম্পন্ন হোস্টেল থাকে এবং তার পরিবারও নতুন বাসায় বাস করেন। ফুমান গোপনে তাঁকে জানায় যে, সে বোর্ডিং স্কুলে থাকতে পছন্দ করে এবং ক্যান্টিনের খাবার তার অনেক প্রিয়। সে প্রতি মিলে মাংস ও দু'টি সবজি খাতে পারে।
প্রতিনিধি চেন মনে করেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে লুতিয়ান জেলা ও চাওথুং শহরের শিক্ষার পরিবেশ ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। শিক্ষার মাধ্যমে দারিদ্র্যমুক্তকরণের কারণে গ্রামাঞ্চলের শিক্ষা ব্যাপক উন্নত হয়েছে। ওয়েনপিং জেলার ৭টি স্কুলে নতুন অফিস ভবন, গ্রন্থাগার, বিজ্ঞান পরীক্ষাগার ও মিউজিক স্টুডিও নির্মিত হয়েছে। এখানে দরিদ্রতার কারণে কোনো বাচ্চার লেখাপড়া বন্ধ হয়নি ।
স্কুলে পিতামাতাদের সাথে না থাকা পাঁচ শতাধিক বাচ্চাদের জন্য বড় বাসা স্থাপন করে শিক্ষকরা বাবা মায়ের মতো বাচ্চাদের যত্ন নেন।
অবকাঠামো ব্যবস্থা উন্নয়ন করার পর সফ্টওয়্যারের ওপর মনোযোগ দেন ম্যাডাম চেন। চলতি বছরের দুই অধিবেশনে 'দরিদ্র এলাকার শিক্ষার দুর্বলতা পূরণ' সম্পর্কিত প্রস্তাব জমা দেন তিনি। চীনের ইউয়ুননান প্রদেশের দূরবর্তী পাহাড়ি অঞ্চলের অর্থনৈতিক অবস্থা দুর্বল এবং দারিদ্র্য-বিমোচনের দায়িত্বও জটিল। পেশাদার ও দক্ষ ব্যক্তিদের অঞ্চলটি ছেড়ে চলে যাওয়া স্থানীয় শিক্ষার জন্য একটি বড় সমস্যা।
অনেক স্কুলের সংগীত বা শিল্পকর্মবিষয়ক শিক্ষক অন্যান্য বিষয়ে স্বল্প প্রশিক্ষণ নিয়ে বিভিন্ন বিষয় পড়ান। তাই পাহাড়ি অঞ্চলের শিক্ষক সংকট সমাধানে বিশেষ সুবিধাজনক নীতি প্রদান করা হবে বলে আশা করেন তিনি।
শ্রেষ্ঠ শিক্ষক শ্রেষ্ঠ শিক্ষার্থী প্রশিক্ষণ দিতে সক্ষম বলে বিশ্বাস করেন প্রতিনিধি চেন। ফুমানের মতো বাচ্চারা শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করবে বলে আশা করেন তিনি।
দুই অধিবেশনের শেষ দিকে প্রতিনিধি চেন সবচেয়ে দ্রুত ফিরে যাওয়ার ফ্লাইট বাছাই করেন। তিনি বলেন, গত ২৭ বছরের মধ্যে আমি কখনো ক্লাসরুম ত্যাগ করি নি। এ কয়েক দিনে ক্লাসরুমে না যাওয়ায় মনে হচ্ছে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি। চলতি বছরের দুই অধিবেশন চলাকালে আমাদের স্কুল অন্যান্য জেলার শতাধিক বাচ্চা গ্রহণ করেছে। গতকাল ভিডিও'র মাধ্যমে সবাই আমাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছে।
আমি যত দ্রুত সম্ভব স্কুলে ফিরে বাচ্চাদের সাথে দেখা করতে চাই। বাচ্চাদেরকে দুই অধিবেশন সম্পর্কে জানাবো। সেই সঙ্গে জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে পাহাড়ি অঞ্চলের বাচ্চাদের গল্প প্রেসিডেন্ট সি'কে জানাবো আর এ ভালোবাসার চেইন হস্তান্তর করবো।'
যখন প্রথমবারের মতো এনপিসি'র প্রতিনিধি নির্বাচিত হন, তখন ম্যাডাম চেন অনেক ভয় পান। তিনি বলেন, এটা কি সম্ভব! তবে পরে বেইজিংয়ে আসার পর ২৯০০জনেরও বেশি প্রতিনিধিদের সাথে দেখে তিনি বুঝতে পারেন যে, তাঁর মতো অনেক শিক্ষক, চিকিত্সক ও গ্রামাঞ্চলের সরকারি কর্মকর্তা রয়েছেন। তখন তিনি মনোযোগ দিয়ে প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করা শুরু করেন।
দুই অধিবেশন চলাকালে তিনি প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের অনেক বই কেনেন। তিনি বই পড়তে অনেক ভালোবাসেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, লোকজন আমার উপর আস্থা রেখেছেন, আমি গ্রামাঞ্চলের মেয়ে থেকে এনপিসি'র প্রতিনিধিতে পরিণত হয়েছি, যা ছোট গল পাখি (শঙ্খচিল জাতীয় সামুদ্রিক পাখি) আকাশে উড়ার মতো!
সুপ্রিয় শ্রোতা, এতক্ষণ আপনারা চীনের আধুনিক পেশাগত শিক্ষার দ্রুত উন্নয়ন এবং দরিদ্র এলাকায় শিক্ষার মাধ্যমে দারিদ্র্যমুক্তকরণ সম্পর্কে প্রতিবেদন শুনলেন। আমাদের আজকের অনুষ্ঠান এখানেই শেষ করতে হবে। এ অনুষ্ঠান সম্পর্কে কোনো মতামত থাকলে আমাদের চিঠি লিখতে ভুলবেন না। আমাদের যোগাযোগ ঠিকানা ben@cri.com.cn,caoyanhua@cri.com.cn
সময় মতো আমাদের অনুষ্ঠান শুনতে না পারলে বা শুনতে মিস করলে আমাদের ওয়েবসাইটে তা শুনতে পারবেন। ওয়েবসাইটের ঠিকানা: www.bengali.cri.cn
তাহলে এবার বিদায় নিচ্ছি, সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। থাকুন সুন্দর ও আনন্দে। আগামী সপ্তাহের একই দিনে একই সময় আবারো কথা হবে। যাই চিয়ান। (সুবর্ণা/টুটুল/স্বর্ণা)