চীন-আফ্রিকা সহযোগিতা ফোরাম প্রতিষ্ঠিত হবার পর ১৮ বছর কেটে গেছে। এই ১৮ বছরে চীন-আফ্রিকা দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ১ হাজার কোটি ডলার থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার কোটি মার্কিন ডলারে এবং আফ্রিকায় চীনের বিনিয়োগ দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার কোটি ডলারে। আজকের পুবের জানালা অনুষ্ঠানে আমরা চীন ও আফ্রিকার কয়েকটি সহযোগিতা-প্রকল্প নিয়ে কথা বলব।
কেনিয়ার বন্দরশহর মোম্বাসা থেকে রাজধানী নাইরোবি পর্যন্ত একটি আধুনিক রেলপথ আছে। এটা চীন-কেনিয়া সার্বিক সহযোগিতামূলক অংশীদারিত্বের সম্পর্কের অন্যতম প্রতীকা। এই রেলপথ পূর্ব আফ্রিকা উন্নয়নের পরিবহন-বাধা ভেঙে দেয় এবং উক্ত পথে ১০ ঘন্টার যাত্রা ৪ ঘন্টায় কমিয়ে আনে। রেলপথের নির্মাণের ফলে স্থানীয় অর্থনীতি এগিয়ে যায়। কেনিয়ার জিডিপি ১.৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। প্রকল্প নির্মাণে যেসব কর্মী অংশ নেয় তাদের ৯২ শতাংশ ছিল স্থানীয়। এই প্রকল্পের ফলে ৫০ হাজার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। প্রকল্পের জন্য ৫ সহস্রাধিক পেশাদার কর্মীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। হ্যারিসন কিমানি তাদের একজন। তিনি এখন মোস্বাসা-নাইরোবি রেলপথে চলাচলকারী ট্রেনের কন্ডাকটর। তিনি মনে করেন, এ রেলপথ তার মতো অনেক যুবকের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি করেছে এবং দেশের উন্নয়নে সৃষ্টি করেছে নতুন সুযোগ। তিনি বলেন,
"রেলপথটি স্থানীয় যুবক-যুবতীদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে। এই প্রকল্পের প্রতিটি বিভাগে বহু স্থানীয় কর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়। এখানে প্রত্যেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছে এবং নতুন জীবন শুরু করতে সক্ষম হয়েছে। কেনিয়ার রেলপথ আরও উন্নত হতে হবে এবং চীন আমাদেরকে সেক্ষেত্রেও প্রযুক্তিগত সহায়তা দেবে। অনেক কৃষকও এ রেলপথ দ্বারা উপকৃত হচ্ছে। তারা এখন নাইরোবির বাইরে গিয়ে চাষবাসের কাজ করতে পারে। কৃষি খাতে উত্পাদনব্যয় অনেক কমেছে। এখানে উত্পাদিত কৃষিপণ্য রেলপথের মাধ্যমে নাইরোবি পাঠানো হয়া।"
রেলপথ, সড়কপথ, স্থলবন্দর, বিমানবন্দর, জলবিদ্যুত-কেন্দ্র ইত্যাদি অসংখ্য অবকাঠামো আফ্রিকায় গড়ে উঠেছে চীনের উদ্যোগে। এসব প্রকল্প যেমন স্থানীয় অর্থনীতির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছে, তেমনি সার্বিকভাবে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের টেকসই উন্নয়নেও ইতিবাচক ভূমিকা রেখে চলেছে। দক্ষিণ আফ্রিকার 'দি কোয়েগা স্পেশাল ইকনোমিক জোন (কোয়েগা এসইজেড)'-এ অবস্থিত বেইজিং অটোমোটিভ গ্রুপের একটি ব্যস্ত কারখানা আছে। চীন-আফ্রিকা ক্যাপাসিটি সহযোগিতার দৃষ্টান্ত হিসেবে এই গ্রুপ দক্ষিণ আফ্রিকায় একটি গবেষণাকেন্দ্র, ক্রয়কেন্দ্র, উত্পাদনকেন্দ্র, ও আর্থিক সেবাকেন্দ্রসহ সার্বিক শিল্প চেন বেস গড়ে তুলেছে। তারা চীনা গাড়ির ব্র্যান্ড ও উন্নত প্রযুক্তি আফ্রিকায় নিয়ে এসেছে এবং গাড়ির খুচরা যন্ত্রাংশসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছে। গ্রুপ চায়, আগামী ৫ বছরের মধ্যে সেখানে স্থানীয়ভাবে প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশের ৬০ শতাংশ উত্পদান করতে। চলতি বছরের জুলাই মাসে কারখানায় প্রথম গাড়ি উত্পাদিত হয়। এ-প্রসঙ্গে কোম্পানির মুখপাত্র তু রং বলেন, "আমাদের কারখানার কিছু কাজ স্থানীয় কোম্পানি করে। আমাদের উত্পাদিত গাড়ির কিছু খুচরা যন্ত্রাংশও স্থানীয় মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয়ে থাকে।"
আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের উন্নয়নেও চীন সহায়তা দিয়ে আসছে। সি অ্যান্ড এজ পোশাক কারখানা রুয়ান্ডার বৃহত্তম পোশাক কোম্পানি এবং দেশটির প্রথম পোশাক রফতানিকারক কোম্পানি। এ কোম্পানি চীনের বিনিয়োগে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এর আগে রুয়ান্ডায় এতো বড় পোশাক কারখানা ছিল না।
বর্তমানে আধুনিক এই পোশাক কারখানার ৫টি অ্যাসেম্বলি লাইন আছে এবং ১২০০ জন স্থানীয় কর্মী এখানে কাজ করেন। তাদের উত্পাদিত পোশাকের ২০ শতাংশ দেশে বিক্রি করা হয় এবং বাকি ৮০ শতাংশ বিদেশে রফতানি করা হয়। এ কারখানার সাহায্যে 'মেড ইন রুয়ান্ডা' ব্র্যান্ড বিশ্ববাজারে পরিচিত হয়েছে এবং স্থানীয় পোশাক শিল্পও দিন দিন উন্নত হচ্ছে। কোম্পানির সিইও মা সিয়াও মেই বলেন, "আমাদের প্রভাবে এখানকার বেশ কয়েক ডজন স্থানীয় কারখানা 'মেড ইন রুয়ান্ডা' পণ্য উত্পাদন শুরু করেছে। তারা আমাদের কারখানা পরিদর্শন করতে আসে; দেখতে আসে আমরা কী ধরনের মেশিন ব্যবহার করি এবং কীভাবে ব্যবহার করি। আমরাও সরবরাহকারীর তথ্য তাদেরকে জানাই।"
আরেকটি দৃশ্য। কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবির পশ্চিম উপকণ্ঠে একটি গ্রামে কয়েকজন শিশু একসঙ্গে বসে টিভি দেখছে। আগে তাদের টিভি ছিল, কিন্তু কোনো অনুষ্ঠান দেখতে পারতা না। গত জুন মাস থেকে তারা স্যাটেলাইট চ্যানেল দেখতে পারছে। ২০১৫ সালে চীন-আফ্রিকা ফোরামে উত্থাপিত হয় '১০ হাজার গ্রামে স্যাটেলাইট চ্যানেল' প্রকল্প। নাইজেরিয়া, জাম্বিয়া ও কেনিয়াসহ ২৫টি আফ্রিকান দেশ এই প্রকল্পের আওতায় এসেছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে গ্রামের বাসিন্দারা বিনামূল্যে স্যাটেলাইন টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠান দেখতে পারছে।
কৃষি খাতেও চীন-আফ্রিকা সহযোগিতা চলছে। যেমন, রুয়ান্ডায় এখন অনেক কৃষক মাশরুম চাষ করেন। আগে তারা মাশরুশ খেতেন না এবং চাষও করতেন না। এখন মাশরুম স্থানীয় জনপ্রিয় একটি খাবার। এর পেছনে মজার গল্প আছে। ২০০৮ সালে, ফুচিয়ান কৃষি ও বনবিদ্যা বিশ্ববিদ্যালয় 'রুয়ান্ডা কৃষি প্রযুক্তি দৃষ্টান্ত কেন্দ্র' নামে এক প্রকল্পের দায়িত্ব গ্রহণ করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল রুয়ান্ডার কৃষিশিল্পকে সাহায্য দেওয়া। চেন সিয়াও বিন ও তার সহকর্মী অনেক গবেষণার পর আবিষ্কার করেন যে, রুয়ান্ডার আবহাওয়া মাশরুম চাষের উপযোগী। তবে তখনও রুয়ান্ডার গ্রামে কেউ মাশরুশ খেতেন না, চাষও করতেন না। কারণ কিংবদন্তি অনুযায়ী, মাশরুশ খেলে তাদের গরু মারা যাবে! রুয়ান্ডার লোকসংখ্যার ৭০ শতাংশ কৃষক এবং গরু তাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। ২০১১ সাল থেকে দৃষ্টান্ত কেন্দ্র ধান, শুষ্ক ধান ও মাশরুমসহ ৫ ধরনের শস্য চাষের জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করে। মাশরুম প্রশিক্ষণ ক্লাসে চীনা বিশেষজ্ঞ নিজে মাশরুম রান্না করেন এবং স্থানীয় শিক্ষার্থীদের খাওয়ান। প্রতি প্রশিক্ষণ ক্লাসে তারা নানা ধরনের মাশরুশ রান্না করতেন। এভাবে স্থানীয়রা মাশরুম খাওয়া শেখে। একসময় মাশরুশ রুয়ান্ডায় জনপ্রিয় খাবারে পরিণত হয়। এ পর্যন্ত কেন্দ্র ৪৫ বার মাশরুম চাষ প্রশিক্ষণ আয়োজন করে এবং ১৬৭৯ জন এতে অংশগ্রহণ করেন। চেন সিয়াও বিন বলেন, মাশরুশ চাষে ব্যয় কম, প্রযুক্তি সহজ, ফলন হয় দ্রুত। তিনি বলেন, চাষ শুরুর ১০ দিনেই ফসল পাওয়া যায় এবং একবারেই খরচ উঠে আসে। দ্বিতীয়বারে মুনাফা হয়।
স্থানীয় কৃষকরা ৩০০ রুয়ান্ডা ফ্রাংক বা প্রায় ২.৩ ইউয়ান দিয়ে একটি মাশরুম প্যাক কিনতে পারেন এবং এই প্যাক সরাসরি মাঠিতে বুনতে পারেন। একটি প্যাক থেকে ২০০-৩০০ রুয়ান্ডা ফ্রাংক লাভ হয়। এক বর্গমিটার মাটিতে ৮০-১০০টি মাশরুম প্যাক চাষ করা যায়। প্রতিবছর তিন বার চাষ করা যায়। হিসেব মতে, প্রতি বর্গমিটারে প্রতিবছর মুনাফা হয় প্রায় ৮০০-৯০০ ইউয়ান।
মাবামারিয়া ৫টি শিশুর মা। তিনি প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর মাশরুশ চাষ শুরু করেন। মাশরুম চাষের মাধ্যমে তিনি আর্থিক স্বচ্ছলতা লাভ করেছেন। এমনকি দুটি শিশুসন্তানের শিক্ষার খরচ বহনেও তিনি সক্ষম। তিনি বলেন, "আমার কোনো প্রশ্ন থাকলে সরাসরি চীনা বিশেষজ্ঞদের ফোন করি এবং তারা আমাকে সাহায্য করেন। আগে আমি শুধু স্বামীর কাছ থেকে টাকা পেতাম। এখন নিজেও উপার্জন করি। মাশরুশ চাষ শুরুর পর গ্রামের মানুষের পুষ্টিসমস্যারও সমাধান হয়েছে।"
কোনো কোনো স্থানীয় কৃষক এখন মাশরুম প্যাক তৈরির প্রযুক্তিও আয়ত্ত করেছেন। আহিমানা এখন নিজেই মাশরুম প্যাক তৈরি করেন। তিনি বলেন, "চীনা বিশেষজ্ঞ আসার আগে আমাদের কাছে মাশরুশ ছিল বনের একটি উদ্ভিদ এবং এর সম্পর্কে কিছুই আমরা জানতাম না। চীনা বিশেষজ্ঞ আমাদেরকে মাশরুম চাষের পদ্ধতি শিখিয়েছেন। এখন আমরা সবাই মাশরুম পছন্দ করি। মাশরুশ আমাদের জীবনকে পুরোপুরি বদলে দিয়েছে।"
এক হিসেব মতে, বর্তমানে এখন রুয়ান্ডায় ১২ হাজার মানুষ মাশরুম চাষসংশ্লিষ্ট কাজে জড়িত আছেন এবং ২০০ জন যুবক নিজস্ব মাশরুম ব্যবসা দাঁড় করিয়েছেন। (শিশির/আলিম)