বাংলাদেশে চীনা দড়াবাজি
  2018-07-06 19:04:32  cri

 

অ্যাক্‌রব্যাটিকস বা দড়াবাজির চীনা সংস্করণের ইতিহাস দুই হাজার বছরের। আধুনিক কালে এসে দড়াবাজি চীনের সঙ্গে অন্যান্য দেশের সাংস্কৃতিক যোগাযোগের মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। চীনের দড়াবাজি গ্রুপগুলোর পরিবেশনা বাংলাদেশেও খুবই জনপ্রিয়। আজকের অনুষ্ঠানের শুরুতে এ-সম্পর্কে খানিকটা আলোচনা করব।

বাংলাদেশের মানুষের একসময় ধারণা ছিল যে, উচ্চমানের দড়াবাজি কেবল চীন ও রাশিয়ায় দেখা যায়। এখন চীন সরকারের সহায়তায় বাংলাদেশেও গড়ে উঠেছে দড়াবাজি গ্রুপ। বিগত দুই বছরে চীনা দড়াবাজি গ্রুপগুলো বাংলাদেশের ৬৪টি জেলায় ৩৫০-এর বেশি বার পারফর্ম করেছে। বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী চীনা শিল্পীদের অনেক প্রশংসা করেছেন; দর্শকরাও চীনা শিল্পীদের পারফরমেন্স অনেক পছন্দ করেন।

বাংলাদেশে দড়াবাজি গ্রুপ প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া সম্পর্কে বাংলাদেশের জাতীয় শিল্পকলা একাডেমির পরিচালক লিয়াকাত আলি লাকি বলেন, "২০০৪ সালে বাংলাদেশ সরকার প্রথম দড়াবাজির প্রশিক্ষণ-ক্লাশ চালু করে। এরপর দড়াবাজি প্রশিক্ষণকেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু শিক্ষার্থীরা কেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজ নিজ এলাকায় ফিরে যাওয়াতে আমাদের এ-সংক্রান্ত প্রাথমিক পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি।"

২০১১ সালে লিয়াকত আলি লাকি ২৫ জন শিক্ষার্থী নিয়ে নতুন দড়াবাজি গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু গ্রুপের সদস্যদের বয়স ছিল বেশি এবং তারা পর্যাপ্ত সময় ধরে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেনি। সেজন্য তারা মঞ্চে আনুষ্ঠানিকভাবে দড়াবাজির কলা-কৌশল প্রদর্শন করতে পারতেন না। তখন তিনি বাংলাদেশে চীনা দূতাবাসের সাহায্য নেওয়ার কথা চিন্তা করেন। চীনা দূতাবাসের সঙ্গে বরাবরই বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি'র সহযোগিতামূলক সম্পর্ক ছিল। লিয়াকত আলি লাকি চীনা দূতাবাসের সংস্কৃতি বিভাগকে বাংলাদেশিদের দড়াবাজি প্রশিক্ষণ দেওয়ার অনুরোধ জানান। চীনা দূতাবাস ইতিবাচক সাড়া দেয়। ২০১৫ সালের মে মাসে তত্কালীন চীনা উপপ্রধানমন্ত্রী লিউ ইয়ান তুং বাংলাদেশ সফর করেন। সফরকালে চীন সরকার বাংলাদেশের ২০ জন দড়াবাজি-শিক্ষার্থীকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে।

২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ থেকে প্রথম দফায় ১০ জন শিক্ষার্থী বেইজিং আন্তর্জাতিক শিল্পকলা বিদ্যালয়ে পৌঁছায়। তাঁরা পেশাদার শিক্ষকদের কাছে দড়াবাজির প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন করে।

২০১৭ সালের জুলাই মাসে প্রথম দলটি প্রশিক্ষণের পর বাংলাদেশে ফিরে আসে। বাংলাদেশে চীনা দূতাবাসে চীনা জাতীয় দিবসের উদযাপনী অনুষ্ঠানে এসব বাংলাদেশি শিক্ষার্থী চীনা শিল্পীদের সঙ্গে মিলে চমত্কার পারফর্ম করে। বাংলাদেশে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা তাঁদের পারফর্মমেন্সের ভূয়সী প্রশংসা করেন। এরপর তাঁরা বাংলাদেশ জাতীয় থিয়েটার, জাতীয় শিল্পকলা একাডেমি ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পারফর্ম করে। এ-সম্পর্কে লিয়াকত আলি লাকি বলেন, "আমাদের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী দুইবার তাঁদের পরিবেশনা দেখেছেন। প্রেসিডেন্ট তাঁদের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। পরিবেশনার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁদের সঙ্গে ছবি তুলেছেন। এরপর দড়াবাজি গ্রুপ সারা বাংলাদেশে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সরকারি কর্মকর্তাবৃন্দ ও সাধারণ মানুষ তাঁদের পরিবেশনা পছন্দ করেন। চীনা দূতাবাস ও বেইজিং আন্তর্জাতিক শিল্পকলা বিদ্যালয়ের সহায়তা না-পেলে বাংলাদেশে এত চমত্কার দেশীয় শিল্পীদের দড়াবাজির পরিবেশনা দেখা যেত না।"

২০১৭ সালের ডিসেম্বরে দ্বিতীয় দফায় ১০ জন বাংলাদেশি শিক্ষার্থী বেইজিং আন্তর্জাতিক শিল্পকলা বিদ্যালয়ে আসেন। তাদের সবার বয়স ১১ থেকে ১৬ বছর। শুরুতে চীনে তাদের খাদ্যগ্রহণের সময়সূচি নিয়ে সমস্যা হচ্ছিল। বাংলাদেশের মানুষ সাধারণত রাত ৮ থেকে ৯টার মধ্যে ডিনার খান। অনেকে আরও দেরিতে ডিনার সারেন। অথচ চীনারা সন্ধ্যা ৬টা থেকে ৭টার মধ্যে ডিনার খায়। তো, ছোট শিক্ষার্থীদেরকেও চীনে এসে সন্ধ্যায় ডিনার করতে হতো এবং যথারীতি রাতে তাদের ক্ষুধা লাগত। অবশ্য, তারা খুব দ্রুতই এই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়। তা ছাড়া, চীনা শিক্ষকদের যত্নআত্তিতে কয়েক মাসের মধ্যে তারা কঠিন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে; শেখে দড়াবাজির বিভিন্ন কলা-কৌশল। এ-সম্পর্কে বেইজিং আন্তর্জাতিক শিল্পকলা বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছেন চেন বলেন, "যখন তারা প্রথম আসে, তখন তারা তো চীনা ভাষা কিছুই বুঝতো না। আমরা আস্তে আস্তে তাদেরকে চীনা ভাষা ও দড়াবাজির কৌশল শিখিয়েছি। এসব শিক্ষার্থী ছিল খুবই বুদ্ধিমান। তারা দ্রুত সবকিছু শিখেছে, যা আমাদের জন্য ছিল আনন্দদায়ক ব্যাপার।"

দড়াবাজি একটি কঠিন বিষয়। বিশেষ করে প্রাথমিক পর্যায়ে। এ-পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা প্রায়ই আঘাতপ্রাপ্ত হয়। দ্বিতীয় গ্রুপের প্রধান ও বাংলাদেশের শিল্পকলা একাডেমি'র দড়াবাজি প্রশিক্ষণকেন্দ্রের শিক্ষক মুহাম্মাদ জালাল উদ্দিন বলেন, "চীন সরকার ও বাংলাদেশের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতা প্রকল্পের মাধ্যমে আমরা এখানে দড়াবাজি শিখেছি। আমাদের প্রশিক্ষণ-কার্যক্রম ছিল খুবই কঠিন। কিন্তু এটি দড়াবাজি। পরিশ্রম না-করে দড়াবাজি শেখা যায় না।"

বেইজিং আন্তর্জাতিক শিল্পকলা বিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে বাংলাদেশের জাতীয় শিল্পকলা একাডেমি'র পরিচালক লিয়াকত আলি লাকি গত এপ্রিলে বেইজিংয়ে আসেন এবং বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি দেখলেন, মাত্র চার মাসে শিক্ষার্থীরা অনেককিছু শিখেছে; তাদের পারফরমেন্স অনেক উন্নত হয়েছে। আসলে দ্বিতীয় দফার শিক্ষার্থীরা প্রথম দফার শিক্ষার্থীদের চেয়ে আরও দ্রুত ও ভালভাবে শিখতে পেরেছে। চীনে থাকাকালে তারা নিজেদের বাড়ি ও স্বজনদের মিস্‌ করেছে। তবে, পরিশ্রম করা ত্যাগ করেনি। লিয়াকত আলি লাকি বলেন, "আমি শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন করেছিলাম: তিন বছর চীনে প্রশিক্ষণের সুযোগ পেলে কে কে আসতে রাজি আছো? উত্তরে তারা সবাই হাত তুলেছিল। কারণ, তারা বুঝেছে যে, এটি তাদের জন্য একটি বড় সুযোগ।"

লিয়াকত আলি লাকি জানান, দড়াবাজি বাংলাদেশে এখন খুবই জনপ্রিয়। যখন ঢাকায় পরিবেশনা হয়, তখন ৭০০ থেকে ৮০০ দর্শকের সমাগম ঘটে। ঢাকার বাইরে একেকটি পরিবেশনা কয়েক হাজার দর্শককে আকর্ষণ করে।

বাংলাদেশের বিভিন্ন মন্ত্রী ও সংসদসদস্যরা প্রতিবার বাংলাদেশি দড়াবাজি শিল্পীদের পরিবেশনা দেখে তাদের প্রশংসা করার পাশাপাশি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিরও প্রশংসা করেছেন। এটা লিয়াকত আলি লাকির জন্য আনন্দের বিষয়। তিনি এ-জন্য বিশেষভাবে চীন সরকারকে ধন্যবাদ জানান। লাকি বলেন, "ঢাকায় বিভিন্ন দেশের সংস্থাগুলোর মধ্যে চীনা দূতাবাসের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ। চীনা দূতাবাস সবসময় আমাদেরকে অর্থ, সরঞ্জাম ও মানবসম্পদ দিয়ে সাহায্য করে এসেছে। আমরা আগামী তিন বছরের মধ্যে আরও ১৬ জন শিক্ষার্থীকে চীনে দড়াবাজি শিখতে পাঠাব। আমি বিশ্বাস করি, তারা বাংলাদেশে দড়াবাজি শিল্পের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।"

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040