0719
|
১০ বছর আগে, ৭২ বছর বয়সী একজন প্রবীণ তার দামি মার্সিডিজ-বেঞ্জ গাড়ি চালিয়ে এসেছিলেন মরুভূমিতে; শুরু করেছিলেন বৃক্ষরোপণ। মানুষ তখন তাকে 'নির্বোধ' 'পাগল' ইত্যাদি বিশেষণে বিশেষায়িত করেছিল। ১০ বছর পর তিনিই হলেন বীর, যার প্রচেষ্টা এলাকার বালি-সংকট দূর করে।
বর্তমানে ৮২ বছর বয়সী এই ব্যক্তির নাম ওয়াং হেং সিং। তিনি চীনের নিং সিয়া প্রদেশের সি চুই শান শহরের একজন সফল ব্যবসায়ী। বুড়ো বয়সে তিনি মরুভূমিতে রাস্তা নির্মাণ করেন, বিদ্যুত নিয়ে আসেন, বৃক্ষরোপণ করেন। ১০ বছরে তিনি ৮০০ হেক্টর মরুভূমিকে মরুদ্বীপে পরিণত করেন। বর্তমানে এলাকাটি পরিণত হয়েছে প্রাকৃতিক পর্যটনকেন্দ্রে।
২০১৭ সালের গ্রীষ্মকাল। মাও উ সু মরুভূমির সীমান্তে সি চুই শান শহরের পিং লুও জেলার মিয়াও মিয়াও হ্রদ প্রাকৃতিক পর্যটন এলাকায় দেখা যায় পর্যটকদের ভীড়। মিয়াও মিয়াও হ্রদ প্রাকৃতিক পর্যটন এলাকার দায়িত্বশীল ব্যাক্তি ওয়াং চিন সাংবাদিকদের জানান, চলতি বছরের পয়লা মে জাতীয় শ্রম দিবসের তিন দিনের ছুটিতে এখানে আসে ৪০ হাজার পর্যটক। সব রেস্টুরেন্টের সামনে তখন দেখা গেছে মানুষের দীর্ঘ লাইন।
সাম্প্রতিকালে, মিয়াও মিয়াও হ্রদে প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হচ্ছে মরুভুমি পিচ ফুল উত্সব। জায়গাটিকে এখন ডাকা হয় 'মরুভূমির পিচ ফুলের বাগান' নামে। বসন্তকালে এখানে হাজার হাজার পিচ ফুল ফোটে। অথচ মাত্র ১০ বছর আগে এখানে বালি ছাড়া আর কিছুই ছিল না!
গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে ওয়াং হেং সিং নিং সিয়া প্রদেশ ও ইনার মঙ্গোলিয়ার সীমান্তে কয়লা ব্যবসা শুরু করেন। পরে ২০ বছরের চেষ্টায় তিনি ও তার ৫ ছেলে-মেয়ে ১০ কোটি ইউয়ান মূল্যের একটি বড় কম্পানি গড়ে তোলেন। ২০০৭ সালে ৭২ বছর বয়সী ওয়াং হেং সিং অবসরের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। পাশাপাশি তিনি সিদ্ধান্ত নেন, মাও উ সু মরুভূমিতে গিয়ে প্রাকৃতিক পরিবেশ উন্নত করার।
তার ছেলে ওয়াং চিন বলেন, "আমার বাবা সারাজীবন পরিশ্রম করেছেন। আমরা তাকে একটা দামি গাড়ি উপহার হিসেবে দেই। আশা করেছিলাম, তিনি গাড়ি চালিয়ে এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়াবেন। আমরা যেটা আশা করিনি সেটা হচ্ছে, তিনি গাড়ি চালিয়ে মরুভূমিতে যাবেন এবং সেখানে ১০ বছর কাটিয়ে দেবেন!"
১০ বছর ধরে ওয়াং হেং সিং মরুভূমির বিরুদ্ধে লড়াই করেন। বর্তমানে মিয়াও মিয়াও হ্রদকে ঘিরে দশ-বারো লাখ গাছের একটি প্রাকৃতিক সবুজ বেড়া আমরা লক্ষ্য করি। এই বেড়া বালুঝড় থেকে জলাশয়কে রক্ষা করছে। এটা ওয়াং হেং সিংয়ের কীর্তি।
এখানে যতদূর চোখ যায়, শুধু গাছ আর গাছ। রোদে হ্রদ দেখতে সুন্দর, চাকচিক্যময়। অদূরে ক্ষেতে কাজ করছে কৃষক। এখানে ফল ও সবজি চাষ করা হয়; লালনপালন করা হয় হাস, মুর্গি, গরু ও মেষ।
দর্শনীয় স্থানের একটি ছোট প্রাঙ্গণে সাংবাদিকের সঙ্গে দেখা হয় প্রবীণ ওয়াং হেং সিংয়ের। সাদা চুলের ওয়াং হেং সিংয়ের মুখে মৃদু হাসি। তিনি বিগত ১০ বছরে অর্জিত তার অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন। শুরুতে স্থানীয় বাসিন্দারা এবং তার নিজের পরিবারের সদস্যরা তার কাজের কোনো মর্ম উদ্ধার করতে ব্যর্থ হয়। কেউ কেউ তখন বলেছিলেন, টাকা খরচ করার জায়গা পাচ্ছেন না বলেই তিনি এসব করছেন। তার সন্তানেরাও চিন্তিত হয়েছিল। অবসরে যাবার পর কেউ এমন পাগলাটে কাজ করে!
ওয়াং হেং সিং সহজভাবে বললেন, তিনি 'ঋণ' শোধ করতে চেয়েছেন মাত্র! তিনি জানান, কয়লার ব্যবসা করার মাধ্যমে তিনি প্রথম অর্থ উপার্জন করেন। নিজের চোখেই দেখেছেন, কয়লা নিষ্কাশন পরিবেশের জন্য কতোটা ক্ষতিকর। তিনি একসময় ভাবলেন, তাকে এ 'ঋণ' শোধ করতে হবে।
২০০৭ সালে একদল কর্মী নিয়ে ওয়াং হেং সিং আসেন মরুভূমিতে। তখন এখানে দু'টি পুরাতন তাঁবুঘর ছাড়া আর কিছুই ছিল না; বিদ্যুত, রাস্তা, পানি—কিছুই না। ওয়াং হেং সিংয়ের নেতৃত্বে শুরু হয় কঠোর ও কঠিন কাজ। দিনের অধিকাংশ সময় তারা ব্যয় করতে থাকেন রাস্তা ও খাল নির্মাণকাজে। রাতে ঘুমাতেন তাঁবুঘরে।
মরুভূমিতে বৃক্ষরোপণ করে তা টিকিয়ে রাখা সহজ কাজ নয়। ওয়াং হেং সিং বলেন, প্রায়ই ঘুম থেকে জেগে দেখতেন আগের দিনের রোপিত গাছ মরে গেছে। রাতে বালুঝড়ে রোপিত চারা ধ্বংস হয়। একবার তো রাতে ৩০ সেন্টিমিটার বালুঝড় হলো! তারা নিজেরাও বালুঝড়ের শিকার হতেন।
একবার বৃষ্টি কম হয় বলে গাছগুলো মারা যাচ্ছিল। ওয়াং হেং সিং স্থানীয় কৃষকদের কাছ থেকে কিছু পানি কিনলেন এবং গাছগুলোর গোড়ায় ঢেলে সেগুলোকে বাঁচালেন। তিনি জানালেন, শুরুতে মানুষ তার কাজের কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পেতো না; তাকে বিশ্বাসও করতো না। তিনি সবার সামনে নিজের আবেগকে সংযত রাখতেন। কিন্তু আড়ালে তিনি বহুবার কেঁদেছেন।
১০ বছরে এ মরুভূমিকে মরুদ্যানে পরিণত করতে ওয়াং হেং সিং ২০ কোটি ইউয়ান ব্যয় করেছেন। তার অর্থ আর পরিশ্রম সৃষ্টি করে ৮০০ হেক্টর আয়তনের একটি মরুদ্যান। বালি প্রতিরোধ কাজের জন্য সার্বক্ষণিক অর্থের যোগান প্রয়োজন। আর সেই প্রয়োজন মেটাতে তিনি পর্যটনশিল্পের আশ্রয় নেন।
তিনি জানান, গাছপালা লালন-পালনের অভিজ্ঞতা তার আগেই হয়েছিল। সন্তানদের কীভাবে শিক্ষিত করে তুলতে হয়, সেটাও তার জানা। তিনি কখনই সন্তানদের অনেক টাকা দিতেন না। তিনি সবসময় চাইতেন, সন্তানরা আত্মনির্ভরশীল মানুষ হিসেবে গড়ে উঠুক।
আরামদায়ক জীবন ছেড়ে ওয়াং হেং সিং হাঁটেন কঠিন এক পথে। ৮০ বছর বয়সী হলেও, তিনি সমাজে নিজের অবদান রাখছেন। তার নেতৃত্বে একটি পর্যটনকেন্দ্র গড়ে উঠেছে এবং স্থানীয়দের জন্য বহু কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। স্থানীয়রা এখন দারিদ্র্যমুক্ত।
ওয়াং হেং সিং তার ছেলে ওয়াং চিনকে তার গড়ে তোলা নতুন এলাকার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব গ্রহণে রাজি করিয়েছেন। ওয়াং চিন বুঝতে পারেন যে কাজটা কঠিন। কিন্তু তিনি চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন। তিনি মরুভূমিতে এসে দায়িত্ব নেন। তিনি বলেন, "বাবা সবসময় আমাদের বলেন, কখনও নিজের দায়িত্ব ভুলে যাওয়া চলবে না। সমাজ, পরিবার, ও বংশের প্রতি আমাদের দায়িত্ব আছে। আমরা যত বেশি পাই, তত বেশি সমাজকে ফিরিয়ে দেওয়া উচিত।"
ওয়াং হেং সিং সমাজকে যথার্থই ফিরিয়ে দিয়েছেন। তিনি যা সমাজের কাছ থেকে পেয়েছেন, তারচেয়ে বেশি দিয়েছেন নাকি কম, সেটা অবশ্য হিসেব-নিকেশের ব্যাপার। তবে, তার প্রচেষ্টা যে আন্তরিক ও সফল তাতে কোনো সন্দেহ নাই। (শিশির/আলিম/সুর্বণা)