0705
|
ছিংহাই-তিব্বত মালভূমি, বিশ্বের ছাদ। মালভূমির মধ্যাংশে অবস্থিত কুও লুও নামক একটি তিব্বত জাতির স্বায়ত্তশাসিত বিভাগ (শহর)। এখানে একটি বেসরকারি বৃত্তিমূলক স্কুল আছে। স্কুলটির নাম 'সুয়ে ইউয়ু তা চি লি জুং তিব্বতি চিকিৎসা স্কুল'। এটা কুও লুও এলাকায় প্রথম বেসরকারি বৃত্তিমূলক স্কুল এবং চীনে প্রথম বেসরকারি তিব্বতি চিকিত্সা বৃত্তিমূলক স্কুল। এ স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের অধিকাংশই গ্রামীণ এলাকার ও পশুপালন অঞ্চলের দরিদ্র পরিবারের সদস্য বা প্রতিবন্ধী। কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় সরকারের সহায়তায় অসংখ্য যুবক-যুবতী এখানে বিনামূল্যে তিব্বতি চিকিৎসাবিদ্যা শিখতে পারে।
'সুয়ে ইউয়ু তা চি লি জুং তিব্বতি চিকিৎসা স্কুল' ৩৭০০ মিটার উঁচু তুষারাবৃত পর্বতমালার পাদদেশে অবস্থিত। বিকেল ৫টায় একটি ভেষজ ক্লাসে তিব্বতি মেয়ে সুং মাও চুও সাদা রঙের অ্যাপ্রন পরে বক্তৃতামঞ্চে দাঁড়িয়ে আছে। তার সামনে রাখা আছে দশ-বারোটি ভেষজ। তিনি একটি ভেষজ হাতে নিয়ে বললেন, "আজ আমরা নানা রকমের ভেষজ তুলেছি। এটা স্নো লোটাস, ওষুধে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়। এ থেকে তৈরি ওষুধ রিউম্যাটিজম্ ও কিডনির রোগে ব্যবহার করা যায়।"
সুং মাও চুওরা ৫ ভাইবোন। তার বাবা ও বড় ভাই পরিবারের উপার্যনক্ষম ব্যক্তি। পরিবারটি দরিদ্র। ২০১৪ সালে সে ছিং হাই প্রদেশের হুয়াং নান শহর থেকে ৩৫০ কিলোমাটার অতিক্রম করে আসে কুও লুও। এক বছর পর সে এ স্কুল থেকে স্নাতক হবে।
স্কুলের ৫ শতাধিক তিব্বতি ছাত্রছাত্রীর মধ্যে ৯০ শতাংশই সুং মাও চুওর মতো দরিদ্র পরিবারের সদস্য বা অনাথ বা প্রতিবন্ধী। এখানে তারা হান ভাষা, তিব্বতি ভাষা, গণিতবিদ্যা, ইংরেজিসহ বিভিন্ন মৌলিক জ্ঞান অর্জন করে। এখানে তাদের আরও দেওয়া হয় তিব্বতি চিকিত্সাবিদ্যা, নার্সিংসহ বিভিন্ন বৃত্তিমূলক শিক্ষাও। স্কুলে পড়তে তাদের কোনো টাকা খরচ করতে হয় না। পুরো স্কুলটিই বিনামূল্যের।
কুয়ান ছুয়ে চিয়া ২০১৬ সালে স্কুলে ভর্তি হয়েছে। সে একজন ছাত্র। সে ছিং হাই প্রদেশের হাই নান শহরের মানুষ এবং এখন দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছে। সেও দরিদ্র পরিবারের ছেলে, তবে ছোটবেলা থেকে সে তিব্বতি চিকিত্সাবিদ্যা সম্পর্কে আগ্রহী ছিল। সে সাংবাদিকদের জানায়, 'সুয়ে ইউয়ু তা চি লি জুং তিব্বতি চিকিৎসা স্কুল' চালুর খবর শুনে সে এখানে এসেছে।
দ্বিতীয় বর্ষের একজন ছাত্র হিসেবে কুয়ান ছুয়ে চিয়া অনেক কিছুই শিখছে এখন। সে বলে, 'স্কুলের সব শিক্ষক আমাদেরকে সাহায্য করেন। কোনো একজন শিক্ষার্থীর সমস্যা হলে শিক্ষকরা তার যত্ন নেন। শিক্ষার্থীদের মধ্যে সম্পর্কও খুব ভালো। আমরা পরস্পরকে ভালবাসি।"
দারিদ্র্যবিমোচন এবং কৃষক ও পশুপালকদের চিকিত্সাসেবা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যেই ২০০২ সালে চীনের বিখ্যাত তিব্বতি চিকিত্সক জে চেন তা চিয়ে পেন স্থাপন করেন 'সুয়ে ইউয়ু তা চি লি জুং তিব্বতি চিকিৎসা স্কুল'।
বর্তমানে স্কুলের শিক্ষার্থীরা জাতীয় বৃত্তি ও ছিং হাই প্রদেশের শিক্ষাভাতা পেতে পারে। প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রছাত্রীরা প্রতিবছর ৪৭০০ ইউয়ান এবং তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা ৩৫০০ ইউয়ান করে শিক্ষাবৃত্তি পেতে পারে। এর মধ্যে শিক্ষা ও থাকার খরচ ২৭০০ ইউয়ান এবং বাকিটা ছাত্রছাত্রীদের জীবনযাত্রার খরচ।
চিয়া ইয়াং চিয়া চুও একজন শিক্ষক। ২০১১ সাল থেকে তিনি স্কুলে যোগ দেন। তাকে নিয়ে তখন স্কুলে মোট শিক্ষক ছিল ১৭ জন। তিনি স্কুলে তিব্বতি চিকিত্সাবিদ্যা ও ওষুধের বিশ্বকোষ 'দ্য ফোর মেডিকেল তন্ত্রজ' (The Four Medical Tantras') পড়ান। তিনি ভেষজ শিক্ষার দুটি ক্লাশও নেন। তিনিও মাঝে মাঝে শিক্ষার্থীদের নিয়ে পাহাড়ে যান এবং ভেষজ সংগ্রহ করেন। তিনি বলেন
"তিব্বতি চিকিত্সা একটি ঐতিহ্যিক চিকিত্সা পদ্ধতি এবং এখন এর প্রতি আকর্ষণ দিন দিন বাড়ছে। কেন্দ্রীয় সরকারও তিব্বতি চিকিত্সাব্যবস্থার উন্নয়নে কাজ করছে। আমার ছাত্রছাত্রীরা ফার্মাকোলজি ও রোগবিদ্যা শেখার পর জাতীয় যোগ্যতাপত্র অর্জনের জন্য পরীক্ষা দিতে পারবে এবং ভবিষ্যতে তিব্বতি চিকিত্সক হতে পারবে।"
বিগত ১৫ বছরে ১৪০০ জনেরও বেশি শিক্ষার্থীকে ভর্তি করেছে স্কুলটি। এদের মধ্যে ৭৫০ জন দরিদ্র বা অনাথ ও প্রতিব্ন্ধী ছাত্রছাত্রীকে বিনামূল্যে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। এখান থেকে যারা স্নাতক হয়ে বেরিয়ে যান, তাদের মধ্যে ১০০ শতাংশের কর্মসংস্থান হয়। এর মধ্যে স্কুলের সাহায্যে ৩০ শতাংশ স্নাতক নিজস্ব ব্যবসাও দাঁড় করিয়েছেন।
৩০ বছর বয়সী সুও নান চুও ২০০৮ সালে স্কুল থেকে স্নাতক হয়েছেন এবং এখন তিনি স্কুলের ক্লিনিকের একজন ফার্মাসিস্ট। স্কুলের সাহায্যে তিনি দরিদ্র ছাত্রী থেকে একজন ফার্মাসিস্টে পরিণত হন। এখন প্রতিমাসে তিনি ২৬০০ ইউয়ান আয় করেন এবং পরিবারকে আর্থিক সাহায্য দিতে পারেন।
স্কুলের উপ-প্রধান কুও ইয়াং সুং বলেন, গত ১৫ বছরে স্কুলটি নানান ক্ষেত্রে সামনে এগিয়েছে। অবকাঠামো যেমন উন্নত হয়েছে, তেমনি শিক্ষার মানও বেড়েছে। তিব্বতি অঞ্চলে এটি এখন বিখ্যাত একটি স্কুল। তিব্বতি অঞ্চল থেকে আসা ছাত্রছাত্রীরা স্নাতক হওয়ার পর তিব্বতি অঞ্চলে ফিরে জনগণকে চিকিত্সাসেবা দেয়।
ছিং হাই প্রদেশের কুও লুও শিক্ষা বিভাগের প্রধান আং পাও বলেন, এ স্কুল একদিকে পশুপালন অঞ্চলে চিকিত্সক ও ওষুধের অভাব দূর করেছে এবং অন্যদিকে দরিদ্র পরিবারের সদস্যদের জন্য শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। তিনি বলেন,
"শিক্ষা দেওয়াই আমাদের বড় কাজ। একজন শিক্ষার্থী পাহাড়ের বাইরে এসে স্কুলে শিক্ষা পায় এবং তার মনের দিগন্ত প্রসারিত হয়। শিক্ষিত একজন মানুষ তার পরিবারের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারে। আমি মনে করি, দারিদ্র্যবিমোচনের জন্য শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। একজন শিক্ষিত মানুষ তার পরিবার তথা গোটা অঞ্চলকে উন্নয়নের পথে পরিচালিত করতে পারেন।" (শিশির/আলিম/সুবর্ণা)