পুবের জানালা: দারিদ্র্যবিমোচনের 'লং নান পদ্ধতি'
  2017-06-21 13:24:38  cri



কান সু প্রদেশের লং নান চীনের দূরবর্তী একটি শহর। দীর্ঘকাল ধরে এটি ছিল হতদরিদ্র। কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরে চলেছে অঞ্চলটিকে দারিদ্র্যমুক্ত করার প্রচেষ্টা। আর কাজটি করা হয়েছে ই-কমার্সকে জনপ্রিয় করার মাধ্যমে। লং নান'কে দারিদ্র্যমুক্ত করার পদ্ধতি পরিচিতি লাভ করেছে 'লং নান পদ্ধতি' নামে।

লং নান শহরের ওয়েন জেলার অন্তর্গত জুং মিউ উপজেলার মু চিয়া পা গ্রামের একজন বাসিন্দা রেন পো। তিনিই ছিলেন পরিবারের একমাত্র আয়ের উত্স। কিন্তু এক দুর্ঘটনায় তিনি কায়িক পরিশ্রম করার ক্ষমতা হারান। এই অক্ষমতা নিয়ে তিনি কর্মস্থল থেকে গ্রামে ফিরে আসেন। তার পরিবারের আয়ের একমাত্র উত্সটি বন্ধ হয়ে যায়। পরিবারটি পরিণত হয় হতদরিদ্রে। এ প্রসঙ্গে রেন পো বলেন,

"শারীরিক অক্ষমতার কারণে আমার পক্ষে কোনো চাকরি পাওয়া সম্ভব ছিল না। আমার অন্য কোনো আয়ের উত্সও ছিল না। একসময় মনে হলো, ইন্টারনেটের দোকান খুলে বসি। প্রথমে আমি ভার্চুয়াল প্রোডাক্ট, যেমন অনলাইন গেইম, মোবাইল রিচার্জ ইত্যাদির ব্যবসা শুরু করলাম। কিন্তু এতে আয় ভালো হচ্ছিল না। ২০১৪ সালের দ্বিতীয়ার্ধে সরকারের উদ্যোগে গ্রামে সার্বিকভাবে ই-কমার্স জনপ্রিয় করে তোলা হয় এবং আমি ভার্চুয়াল প্রোডাক্টের বদলে ইন্টারনেটে কৃষিপণ্য বিক্রি করতে শুরু করি।" বস্তুত, ই-কমার্সের মাধ্যমে দারিদ্র্যবিমোচনের ধারণা লং নান স্থানীয় সরকারের একটি বিশেষ উদ্যোগ, যা থেকে স্থানীয় বাসিন্দারা উপকৃত হচ্ছে এভাবেই।

লং নানের অবস্থান কান সুন, স্যান সি ও সি ছুয়ান—এই তিন প্রদেশের সীমান্তে। পাহাড়ের আড়ালে থাকা দুর্গম এই অঞ্চলটি জাতীয় প্রতিরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। কিন্তু এই দুর্গমতাই অঞ্চলটির উন্নয়নের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এখনও পর্যন্ত অঞ্চলের কোনো কোনো জেলায় হাইওয়ে চালু হয়নি। অঞ্চলটিতে এখনও দ্রুতগতির ট্রেন লাইন ও বিমানবন্দর নির্মাণকাজ শেষ হয়নি। পরিবহন খাতের এই সীমাবদ্ধতা অঞ্চলটির অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে বাধা হিসেবে কাজ করছে।

লং নানের প্রাকৃতিক পরিবেশ উন্নত। এখানে আছে প্রচুর সম্পদ। তবে এখানে উত্পন্ন কৃষিপণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে সমস্যা রয়ে গেছে। এদিকে, লং নান স্থানীয় সরকার উপলব্ধি করলো যে, শুধু জিডিপি বাড়ানোর চেষ্টা করে অঞ্চলটিকে সার্বিকভাবে দারিদ্র্যমুক্ত করা যাবে না। এতে স্থানীয় প্রাকৃতিক পরিবেশও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ প্রেক্ষাপটেই অঞ্চলটিতে ই-কমার্সের ধারণা গুরুত্ব পায়।

ইন্টারনেট হাজার হাজার কিলোমিটারের ব্যবধান দূর করে দিতে সক্ষম। ই-কমার্স মানুষের জীবনযাপন পদ্ধতির ওপরও গভীর প্রভাব ফেলে। লং নানে এখনও হাইওয়ে চালু হয়নি। কিন্তু এর প্রতিটি গ্রামে ইন্টারনেট এসেছে। এ অবস্থায় স্থানীয় সরকার ই-কমার্স শিল্পে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়।

গত বছরের অগাস্ট মাস পর্যন্ত লং নান অঞ্চলে চালু হয় দশ-বারো হাজার অনলাইন দোকান। এ দোকানগুলোর মাধ্যমে পণ্য বিক্রির পরিমাণ দাঁড়ায় ৪২০ কোটি ইউয়ান। এসব দোকানের মধ্যে ৪৪৫টির মালিক আবার দরিদ্র পরিবারগুলো। ই-কমার্স প্রায় ৫০ হাজার দরিদ্র মানুষকে দারিদ্র্যমুক্ত হতে সাহায্য করে। রেন পো তাদের একজন। দু'বছরে অনলাইন ও অফলাইনে রেন পোর দোকানে বিক্রি হয়েছে ৭ লাখ ইউয়ান মূল্যের পণ্য। এখন তার পরিবার দারিদ্র্যমুক্ত।

দারিদ্র্যমুক্তির এ প্রক্রিয়ায় সরকার নেতৃত্ব দেয় এবং প্রভাবকের কাজ করে। নীতিমালা তৈরি, অর্থ ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের যোগান, এবং প্রশিক্ষণ দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকার সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। লং নান অঞ্চলের ওয়েন জেলার অন্তর্গত ছিয়াও থো উপজেলার কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক ছাং ভেং বলেন,

"সরকার ই-কমার্সের পক্ষে জোর প্রচার-প্রচারণার পাশাপাশি, কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। প্রতিবন্ধীদের ঋণ ও শুল্ক সুবিধাসহ অন্যান্য সহযোগিতাও দিয়ে থাকে সরকার।"

লং নানের নানা জেলায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ই-কমার্স দারিদ্র্যবিমোচন কর্মগ্রুপ এবং ব্যবস্থাপনা কেন্দ্র। ই-কমার্স দারিদ্র্যবিমোচন কার্যক্রমের আওতায় বিভিন্ন শাখা-উদ্যোগও গ্রহণ করা হয়েছে। প্রতিবন্ধীদের জন্য চালু হয়েছে বিশেষ প্রশিক্ষণ কার্যক্রম। রেন পো'র দোকান সরকারি সহায়তায় চালু হয়। বর্তমানে দোকানটি দ্রুত উন্নতি করছে।

রেন পো বলেন,

"প্রথমে আমি নিজে শিখেছি কীভাবে ইন্টারনেটে দোকান খুলতে ও পরিচালনা করতে হয়। পরে সরকার ও প্রতিবন্ধী কমিটি যৌথভাবে একাধিক প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের আয়োজন করে। আমি তাতে অংশ নিই। চালুর ছয় মাসের মধ্যে আমার দোকান লং নান অঞ্চলের প্রথম পঞ্চাশটি দোকানের অন্যতমে পরিণত হয় এবং এর ফলে আমি সরকারের কাছ থেকে বোনাসও পেয়েছি। "

রেন পোর মতো হে চিয়া ফেংও একজন প্রতিবন্ধী। তিনি সরকারের সাহায্যে একটি অনলাইন দোকান খুলে আপেল বিক্রয় করছেন। সরকার তাকে একটি কম্পিউটার দিয়েছে। এর মাধ্যমে হে চিয়েন ফেং ইতোমধ্যে ২৭ টন আপেল বিক্রয় করেছেন। তার একটি পা নেই। কিন্তু তিনি আত্মনির্ভরশীল হয়েছেন।

রেন ফু ছুয়ান একজন অন্ধ মানুষ। আগে তিনি ছোট ব্যবসা করতেন। ২০১৪ সালে তিনি একটি কৃষিপণ্যের পাইকারি অনলাইন শপ খোলেন। তিনি কৃষকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করেন নানান কৃষিপণ্য এবং তারপর তা বিক্রয় করেন। তিনি জানান, আগে তার ব্যবসা থেকে আয় হতো ২-৩ লাখ ইউয়ান। কিন্তু ই-কমার্স চালু হবার পর তার আয় হচ্ছে ৭-৮ লাখ ইউয়ান।

২০১৬ সালে তার কোম্পানির আয় হয় ২৮০ লাখ ইউয়ান এবং মুনাফা ১৮ লাখ ইউয়ান। তার কোম্পানির কারণে স্থানীয় অনেক মানুষও দারিদ্র্যমুক্ত হয়েছে। কোম্পানি ৬০টি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে এবং ২০ হাজার কৃষক কোম্পানির দ্বারা উপকৃত হচ্ছে।

একটি কোম্পানির নেতৃত্বে কয়েকটি পরিবার, এমনকি গোটা গ্রাম দারিদ্র্যমুক্ত করাই 'লং নান পদ্ধতি'র কাজ। এ পদ্ধতি ২০১৫ সালে সরকার কর্তৃক পুরস্কৃত হয়েছে। ই-কমার্সের উন্নয়ন কৃষকদের আয় বাড়িয়েছে, স্থানীয় অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে, এবং রেন পোর মতো প্রতিবন্ধীদের আত্মনির্ভরশীল হতে শিখিয়েছে। (শিশির/আলিম)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040