0614
|
গত কয়েকটি অনুষ্ঠানে আমরা চীনের একাধিক উন্নয়নশীল গ্রামের কথা বলেছি। এসব গ্রামের কোনো কোনোটি ইতোমধ্যেই দারিদ্র্যমুক্ত হয়েছে, কোনো কোনোটি রীতিমতো স্বচ্ছল হয়ে গেছে। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেবে চীনের ধনী ও উন্নত গ্রামগুলোর একটির সাথে। এ গ্রামের নাম হুয়া সি। গ্রামটি চিয়াংসু প্রদেশের চিয়াংই শহরের পূর্ব উপকণ্ঠে অবস্থিত।
হুয়া সি গ্রামের স্থায়ী লোকসংখ্যা ৩০ হাজার; আয়তন ৩৫ বর্গকিলোমিটার। গ্রামের প্রবেশদ্বারে একটি সাইনবোর্ডে লেখা আছে: নাম্বার ওয়ান গ্রাম। গ্রামের মূল রাস্তার দু'পাশে সুন্দর সুন্দর ভবন; রাস্তায় চলছে বড় বড় গাড়ি। ৩২৮ মিটার উঁচু ৭২ তলা একটি ভবন আছে গ্রামের একেবারে কেন্দ্রে। ভবনটির নীচ তলার বিশাল হলরুমে আছে স্বর্ণের তৈরি একটি গাভীমূর্তি। মূর্তিটি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়েছে এক টন সোনা। গ্রামের জিডিপি ৫০০০ কোটি ইউয়ান। ৫০ বছরের পরিশ্রমের ফলে আজ এটি চীনের অন্যতম ধনী ও উন্নত গ্রামে পরিণত হয়েছে।
কিছুদিন আগে, দু'জন বিদেশি সিআরআইয়ের সাংবাদিকদের সঙ্গে হুয়া সি পরিদর্শন করেন। এফ্রাত পেরি তাদের মধ্যে একজন। তিনি বলেন,
"হুয়া সি নিজেকে নিজে গড়ে তুলেছে। শুধু বর্তমান বাসিন্দাদের জন্য নয়, আগামী প্রজন্মের জন্যও এ গ্রাম সৃষ্টি করেছে এক সুন্দর ও সম্ভাবনাময় ভবিষ্যত। হুয়া সি একটি অনন্য গ্রাম।"
এফ্রাত পেরি বেইজিংয়ে ইসরাইলি দূতাবাসের একজন মুখপাত্র। হুয়া সি গ্রাম পরিদর্শনের পর তিনি উদ্বেলিত কণ্ঠে জানালেন, হুয়া সি গ্রামে তিনি এক নতুনত্ব অনুভব করেছেন। হুয়া সি গ্রামের উন্নয়ন পদ্ধতির সাথে ইসরাইলের কিবুতজ্য়ের পদ্ধতির মিল আছে। তা ছাড়া, এখানে ব্যবহৃত ড্রিপ ইরিগেশান প্রযুক্তিও ইসরাইল থেকে আমদানি করা। এ প্রযুক্তির ব্যবহার এখানকার মরা পাহাড়ে সবুজের চাদর পরিয়েছে।
পেরি বলেন, "হুয়া সি গ্রাম আমার মনে গভীর ছাপ ফেলেছে। এখানে এসে আমি ভাগাভাগির অর্থনীতির প্রতি আগ্রহী হয়েছি। আমি কিবুত্জয়-এ বড় হয়েছি। দুটি জায়গার মধ্যে মিল আছে। সবাই অভিন্ন লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য প্রচেষ্টা চালায় এবং একসাথে উন্নয়নের ফল ভোগ করে।"
হুয়া সি গ্রামে যৌথ পদ্ধতিতে উন্নয়ন প্রক্রিয়া চলছে বিগত ৫০ বছর ধরে। গ্রামের কেন্দ্রে অবস্থিত একটি বিনোদন পার্ক এবং ৩২৮ মিটার উঁচু একটি হোটেল। গত বছর এখানে প্রতিষ্ঠিত হয় একটি সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়াকেন্দ্র ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র।
সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়াকেন্দ্রে আছে ইয়োগা রুম, জিম, ব্যাডমিন্টন হল, বাস্কেটবল হল এবং সিনেমা থিয়েটার। এখানে আছে একটি অডিটোরিয়াম। প্রতিমাসে গ্রামের বাসিন্দারা এখানে অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ সম্মেলনে অংশ নেয়। এটা একটি নিয়মে পরিণত হয়েছে। এখানে পর্যটকদের সামনে তুলে ধরা হয় হুয়া সি গ্রামের উন্নয়নপ্রক্রিয়া ও অভিজ্ঞতার কথা। তুরস্কের আহমেত ইয়েসিলতেপি বলেন,
"হুয়া সি গ্রামের উন্নয়ন অসাধারণ। এর উন্নয়নের পেছনে আছে একটি চমত্কার গল্প। আমি মনে করি, চীনা কমিউনিষ্ট পার্টির নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার ফসল এটি।"
একসময় হুয়া সি গ্রামের আয়তন ছিল মাত্র এক বর্গকিলোমিটার। তখন লোকসংখ্যা ছিল মাত্র ৬০০ জন। গ্রামের সবাই ছিল দরিদ্র, ঋণগ্রস্ত। এখন, গ্রামের সবকিছু বদলে গেছে। জীবনমান উন্নত হয়েছে; সাংস্কৃতিক ও চিকিত্সাসহ নানা ক্ষেত্রে গ্রামটি এগিয়েছে অনেকদূর। তবে হুয়া সি গ্রামের মানুষের প্রচেষ্টা এখনও থেমে নেই। তারা অবিরাম পরিশ্রম করে চলেছেন। কারণ, যাকিছু অর্জিত হয়েছে, তা ধরে রাখতে হবে এবং উন্নয়নের পথ ধরে এগিয়ে যেতে হবে। গ্রামের কমিউনিষ্ট পার্টির সম্পাদক উ রেন পাও ২০১৩ সালে মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু তার রেখে যাওয়া আদর্শ অনুসরণ করছেন গ্রামবাসীরা।
গ্রাম ও গ্রামের নেতৃবৃন্দ সম্পর্কে আহমেতের মনোভাব খুবই ইতিবাচক। তিনি বললেন,
"হুয়া সি গ্রাম অনেক উন্নত ও ধনী। অথচ গ্রামের নেতারা এ নিয়ে অযথা গর্ব করেন না। তারা বরং অনেক অমায়িক ও আন্তরিক। তারা এখনও অবিরাম কাজ করে চলেছেন।"
গত শতাব্দির সত্তুরের দশকে চীনের সংস্কার ও উন্মুক্তকরণ নীতি চালু হয়। তখন থেকেই হুয়া সি গ্রামের উন্নয়নের পথে যাত্রা শুরু। একবিংশ শতাব্দিতে এসে গ্রামটিকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে কাজ শুরু হয়। হুয়া সি গ্রামের উপ-পরিচালক চৌ লি বলেন,
"হুয়া সি গ্রামে বিগত দশ-বারো বছরে তৃতীয় শিল্পের উন্নয়ন ঘটেছে। বর্তমানে গ্রামের মোট আয়ে তৃতীয় শিল্পের অবদান ৬৫ শতাংশ।"
২০১৬ সালে হুয়া সি গ্রামে সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এর আওতায় নিয়োগ ও শেয়ারের ক্ষেত্রে চালু হয় নতুন ব্যবস্থা। এখানকার প্রতিটি নিয়োগের জন্য প্রতিযোগিতা করতে হয়। পারফরমেন্স অনুসারে এখানে মূল্যায়িত হন সবাই। আধুনিক এ ব্যবস্থা গ্রামের জন্য নতুন প্রাণশক্তির যোগান দেয়।
বর্তমানে হুয়া সি গ্রাম থেকে দেশের বাইরেও পুঁজি যাচ্ছে। মোজাম্বিকের আকরিক ক্ষেত্র, জাপানের ধান চাষ, মালয়েশিয়ার বন্দর নির্মাণ এবং যুক্তরাষ্ট্রের লেজার চিপ গবেষণায় হুয়া সি গ্রাম বিনিয়োগ করেছে।
যে-কোনো উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় চ্যালেঞ্জ যেমন থাকে, তেমনি থাকে সুযোগ। হুয়া সি গ্রামের অভিজ্ঞতা বলছে, মানসিক দৃঢ়তা থাকলে ও পরিবর্তনের জন্য পরিশ্রম করা গেলে সাফল্য আসবেই। এ অভিজ্ঞতা শুধু চীনের জন্য নয়, গোটা বিশ্বের জন্যই সম্পদস্বরূপ। (শিশির/আলিম)