গ্রিসের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের বন্দর পিরাওয়ে ও  চীনের 'এক অঞ্চল, এক পথ' প্রস্তাব
  2017-05-17 15:36:26  cri



দুই হাজার বছর আগে, সামুদ্রিক রেশমপথ দক্ষিণ-পূর্ব চীন থেকে ভারত মহাসাগর অতিক্রম করে লোহিত সাগরে প্রবেশ করে পৌঁছে যায় পূর্ব আফ্রিকা ও ইউরোপে। চীনের সাথে অন্যান্য দেশের বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের একটি মহাপথ ছিল সামুদ্রিক রেশমপথ।

বর্তমানে গ্রিসের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের বন্দর পিরাওয়ে চীনের 'এক অঞ্চল, এক পথ' প্রস্তাবের গুরুত্বপূর্ণ একটি পয়েন্ট। বলকান উপদ্বীপের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত পিরাওয়ে গ্রিসের বৃহত্তম বন্দর এবং ভূমধ্যসাগরের পূর্বাঞ্চলের বৃহত্তম পণ্যবন্দর। ২০১৬ সালের অগাস্টে 'চায়না কসকো শিপিং গ্রুপ' পিরাওয়ে বন্দরের ৬৭ শতাংশ শেয়ার কিনে নেয়। ৯ মাস পর সিআরআই'র একজন সাংবাদিক পিরাওয়ে বন্দর পরিদর্শনে যান।

২০০৮ সালে চায়না কসকো শিপিং গ্রুপ ও গ্রিস চুক্তি স্বাক্ষর করে। চুক্তি অনুসারে শিপিং গ্রুপটি ৩৫ বছর বন্দর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পায়। ২০১০ সালের পয়লা অক্টোবর থেকে গ্রুপটি আনুষ্ঠানিকভাবে বন্দরের দুই টার্মিনাল ব্যবস্থাপনার কাজ শুরু করে।

তবে চায়না কসকো শিপিং গ্রুপ-এর ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠুভাবে চলেছে, তা নয়। ২০০৯ সালে আন্তর্জাতিক সংকট ও গ্রিসের ঋণ সংকটের প্রভাব দেশটির অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তখন পিরাওয়ে বন্দরের অবস্থাও তথৈবচ হয়ে পড়ে। একদিকে বন্দরের নৌ-পরিবহন ব্যবসা হ্রাস পায়, এবং অন্যদিকে বন্দরকর্মীদের ঘন ঘন ধর্মঘট বন্দর কার্যক্রমকে বলতে গেলে অচল করে দেয়।

পিরাওয়ে বন্দর কোম্পানির সিইও ওয়াং চিয়ান বন্দর পরিচালনার সাথে জড়িত চীনাদের মধ্যে সবার আগে গ্রিসে এসেছিলেন। তিনি ২০০৯ সালের অবস্থা স্মরণ করে বলেন,

"২০০৯ সালে যখন আমি এখানে আসি তখন বন্দরের অবস্থা ভাল ছিল না। এখানকার সব সাজ-সরঞ্জাম ছিল পুরাতন ও সেকেলে। এ অবস্থা পরিবর্তনে আমরা অনেক প্রচেষ্টা চালিয়েছি। তা ছাড়া, স্থানীয় আইন, সংস্কৃতি ও নীতির আলোকে আমরা স্থানীয় কর্মীদের নিয়েও অনেক কাজ করি।"

ওয়াং চিয়ান জানান, স্থানীয় সমাজের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে তারা আন্তরিকভাবে চেষ্টা করেছেন। বন্দরের কাছাকাছি কোথাও রেস্তোরাঁ নেই, কর্মীদের অফিসে আসার সময় খাবার নিয়ে আসতে হতো। চায়না কসকো শিপিং গ্রুপ কর্মীদের মধ্যে বিনামূল্যে দুপুরের খাবার সরবরাহ করা শুরু করে। এ ধরনের কিছু উদ্যোগের মাধ্যমে কোম্পানি কর্মীদের আস্থা ও ভালোবাসা অর্জনে সক্ষম হয়।

বন্দরের কর্মী দিমিত্রিস বলেন,

"২০০০ থেকে আমি এখানে কাজ করছি। ২০১০ সালের পর বন্দরের চেহারা পাল্টে যায়। সাজ-সরঞ্জাম, যানবাহন, চাকরির মান, ক্লায়েন্ট—সব দিক দিয়েই এ বন্দরটি অন্যান্য বন্দরের চেয়ে আলাদা এখন। আমাদের বেতনও আগের চেয়ে বর্তমানে বেশি।"

২০১০ সালে চায়না কসকো শিপিং গ্রুপের সামনে একটি বড় চ্যালেঞ্জ আসে। চ্যালেঞ্জটি হচ্ছে: বিশ্ব নৌ-পরিবহন বাজারে মন্দা পরিস্থিতিতে পিরাওয়ে বন্দরকে লাভজনক করা।

তখন পিরাওয়ে বন্দর কোম্পানির প্রেসিডেন্ট ফু ছেং ছিও এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় একটি সাহসী প্রস্তাব দেন। তিনি প্রস্তাব দেন, গোটা বন্দরের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব তাদের হাতে ন্যাস্ত করা হোক।

দীর্ঘ আলোচনার পর ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে চায়না কসকো শিপিং গ্রুপ ও গ্রিস উন্নয়ন তহবিল একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। চুক্তির আওতায় ৩৬.৮৫ কোটি ইউরো দিয়ে পিরাওয়ে বন্দর বিভাগের ৬৭ শতাংশ শেয়ার কিনে নেয় কোম্পানিটি। জুন মাসে গ্রিসের সংসদও এ চুক্তিটি অনুমোদন করে। চুক্তিতে বলা হয়, পরবর্তী পাঁচ বছরে চায়না কসকো শিপিং গ্রুপ ৩০ কোটি ইউরো বিনিয়োগ করবে বন্দরের অবকাঠামো নির্মাণে।

এ চুক্তির মাধ্যমে চায়না কসকো শিপিং গ্রুপ বন্দরের বৃহত্তম অংশীদারে পরিণত হয়। এর মাধ্যমে কোনো চীনা কোম্পানি প্রথমবারের মতো বিদেশে সার্বিকভাবে একটি বন্দর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পায়। তবে শুরুতে এ অধিগ্রহণকে অসম্ভব মনে করা হচ্ছিল এবং আলোচনার প্রক্রিয়াও ছিল অনিশ্চয়তা ও সমস্যায় পূর্ণ। বিশেষ করে পিরাওয়ে শহরে এ চুক্তির বিরুদ্ধে জনমত গড়ে ওঠে। অবশ্য শেষ পর্যন্ত সব বাধা কাটিয়ে উঠে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়। পিরাওয়ে শহরের মেয়র মনে করেন, চুক্তিটি উইন-উইন পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। অন্যভাবে বললে, এতে সকল পক্ষই লাভবান হয়েছে। তিনি বলেন,

"এ ইস্যুতে বির্তক ছিল অনিবার্য। এটি ছিল বড় ধরনের একটি বিনিয়োগ প্রকল্প এবং দেশের জন্য বড় ধরনের একটি পরিবর্তন। সংসদের ৯০ শতাংশ সদস্য এ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। আমার মতে, এটা ইতিবাচক একটি প্রস্তাব এবং কসকো, গ্রিস ও স্থানীয় সরকার এ থেকে উপকৃত হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী আমাদের পারস্পরিক সহযোগিতা অব্যাহতভাবে চলবে।"

কসকোর ব্যবস্থাপনায়, আন্তর্জাতিক নৌ-পরিবহন বাজারের মন্দাবস্থার মধ্যেই, ২০১৬ সালে পিরাওয়ে বন্দরে মাল বোঝাই ও খালাসের পরিমাণ দশ-বারো শতাংশ বৃদ্ধি পায় এবং এ ক্ষেত্রে বন্দরটির অবস্থান দাঁড়ায় ইউরোপের বন্দরগুলোর মধ্যে ৮ নম্বরে। কসকো বন্দর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নেওয়ার আগে পিরাওয়ে বন্দরের অবস্থান ছিল বিশ্বে ৯৩ নম্বরে। আর বর্তমানে এ বন্দরের অবস্থান বিশ্বে ৩৮ নম্বরে।

পিরাওয়ে বন্দর একুশ শতকের সামুদ্রিক রেশমপথের গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত হয়েছে। চীন-ইউরোপ এক্সপ্রেস নৌ-পরিবহন ব্যবস্থা ও রেল পরিবহন ব্যবস্থা এ বন্দরের সাথে যুক্ত হয়েছে। এ বন্দরে পণ্য পৌঁছানোর পর এখান থেকে তা রেলপথে মাত্র ৩ থেকে ৫ দিনের মধ্যেই স্থানান্তরিত হয় হাঙ্গেরি, অস্ট্রিয়া, চেক প্রজাতন্ত্র, স্লোভাকিয়াসহ মধ্য ইউরোপের বিভিন্ন দেশে।

১৪ ও ১৫ মে 'এক অঞ্চল, এক পথ' আন্তর্জাতিক সহযোগিতা শীর্ষফোরাম বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত হয়। তাসোস ভামভাকিদিস গ্রিসের কর্মী। তিনি বেইজিংয়ে এসে তার অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন। তিনি বলেন,

"আমরা আশা করি, 'এক অঞ্চল, এক পথ' উদ্যোগ গ্রিসের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ সৃষ্টি করবে। পিরাওয়ে বন্দর সুয়েজ খালের উত্তরে অবস্থিত প্রথম ইউরোপীয় বন্দর। আমাদের বন্দরটি ইউরোপে পণ্য আমদানি-রফতানির অন্যতম প্রধান মাধ্যম। গ্রিস 'এক অঞ্চল, এক পথ' উদ্যোগের সাফল্য কামনা করে।" (শিশির/আলিম/সুবর্ণা)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040