একশ বছরেরও বেশি আগে বাঙালি পাঠকদের প্রতি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের জিজ্ঞাসা ছিল "আজি হতে শতবর্ষ পরে /কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি / শত কৌতূহল ভরে / অথবা, আজি হতে শতবর্ষ পরে / এখন করিছো গান সে কোন্ নূতন কবি /তোমাদের ঘরে!" কিন্তু কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ হয়তো স্বপ্নেও ভাবেননি তাঁর ১৫৫ তম জন্মবার্ষিকী তাঁরই জন্মস্থান কলকাতায় পালিত হবে এক রবীন্দ্রপ্রেমী চীনা মানুষের হৃদয় উত্সারিত আবেগ ও শ্রদ্ধায় । হ্যাঁ,শুনতে অবাক লাগলেও এই বিরল ঘটনার সাক্ষী থাকলো কলকাতা। আরো একবার প্রমানিত হলো বাংলার কবি, বাঙালির কবি রবীন্দ্রনাথ যথার্থ অর্থেই বিশ্বচরাচরের অংশ। কবির গানের ভাষায় -" বিশ্বসাথে যোগে যেথায়া বিহারো সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারও।"
গত ৭ই মে,শনিবার কলকাতার আই টি সি হোটেলে এশিয়ার প্রথম নোবেলজয়ী বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে কলকাতার চীনা কনস্যুলেট জেনারেল ও বিশ্বভারতীর উদ্যোগে "রবীন্দ্রনাথ ও চীন " শীর্ষক একটি সেমিনারের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানের মূল আহ্বায়ক ছিলেন কলকাতায় নিযুক্ত চীনের কনসাল জেনারেল মা চান উ (Mr. Ma Zhanwu)। সেমিনারে মা চান উ বলেন, "সাম্প্রতিক সময়ে চীন-ভারত সম্পর্ক নতুন মাত্রায় উন্নীত হয়েছে। চীন ও ভারতের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আদর্শ ও চিন্তাধারা দুই দেশের মধ্যে মৈত্রী বিস্তার ও দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্ককে গাইড করতে পারে"।
চীনা কনসাল জেনারেল দ্বারা আয়োজিত এই সেমিনারে যোগ দিতে চীন থেকে এসেছিলেন পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লিউ শুসীয়ং (Professor Liu Shuxiong) চায়না রেডিও ইন্টারন্যাশনালের বাংলা বিভাগের কর্মকর্তা ও অনুবাদে সহযোগী অধ্যাপিকা ইয়াং ওয়েই মিং স্বর্ণা(Associate Professor in translation Yang Weiming), তিয়ানচীন ফরেন স্টাডিজ ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপিকা চেং ছিয়ং (Associate Professor Zeng Qiong), পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপিকা চাং শিং (Associate Professor Zhang Xing), সমেত বেশ কয়েকজন রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ ও অনুবাদক যাঁরা রবীন্দ্রনাথকে ভালোবেসে রবীন্দ্রচর্চার কাজে লাগিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে অধ্যাপিকা ইয়াং ওয়েই মিং স্বর্ণা এবং জাং শিং সমগ্র রবীন্দ্রনাথকে চীনা ভাষায় চীনাদের উপহার দিতে পারার কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। যাঁদের কন্ঠে মধুর বাংলা শুনে মুগ্ধ হয়ে কলকাতার জনপ্রিয় বাংলা সংবাদপত্র "এই সময়ের" সহযোগী সম্পাদক তাঁর কলমে লিখেছেন ,"জন্মসূত্রে এঁরা বাঙালি নন। কিন্তু আমাদের মতো অনেকের থেকে হয়তো বেশি বাঙালি। এঁরা বাংলা জানেন, পড়েন, পড়ান, চর্চা করেন, রবীন্দ্র অনুরাগী আর বিদেশের মাটিতে বাংলা ভাষা -বাংলা সংস্কৃতি ছড়িয়ে দেওয়ায় অনেক বাঙালির চেয়ে এগিয়ে লক্ষ মাইল ।"
সত্যিই তাই। চীনা পাঠকরা রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য ভালোবাসে। রবীন্দ্র সাহিত্য চীনা পাঠকের মনে প্রশান্তি ও আত্মিক প্রশস্ততা এনে দেয়। কবিগুরুর সাহিত্য শুধু চীনের পাঠক সমাজেই সমাদৃত নয়, বরং চীনের আধুনিক সাহিত্য ও লেখকদের ওপর রয়েছে তার প্রভাব। সেমিনারে আলোচনায় অংশ নিয়ে ইয়াং ওয়েই মিং স্বর্ণা (Mrs.Yang Wei Ming) বলেন,"বিশ্বকবির অনন্য লেখার ইংরেজি অনুবাদের হাত ধরেই বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে চীনের পাঠকদের আনুষ্ঠানিক পরিচয় ঘটেছে বিশ শতকের গোড়ার দিকে। আর সরাসরি বাংলা থেকে রবীন্দ্র সাহিত্যের চীনা ভাষায় রূপান্তর শুরু হয় গত শতকের সত্তুরের দশকে। চীন আন্তর্জাতিক বেতারের বাংলাভাষী চৈনিকদের অনুবাদ কর্ম এর মধ্যে অন্যতম।"
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চীনা জনগণের সহৃদয় বন্ধু ছিলেন। তিনি আজীবন চীনকে ভালোবাসতেন। ১৯২৪ সালে শরীর দুর্বল হলেও তিনি কয়েক হাজার মাইল পথ অতিক্রম করে চীন সফর করেছিলেন। চীন সফরকালে চীনের খ্যাতনামা পণ্ডিত ও শিল্পীদের সংগে তাঁর যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল এবং তিনি বিদেশী হামলার বিরুদ্ধে চীনা জনগণের নির্ভীক সংগ্রামে যে সমর্থন জানিয়েছিলেন তা প্রতিফলিত হয়েছে তারঁ রচনায়। ১৯২৪ সালে যখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চীন থেকে হংকং অতিক্রম করে ভারত ফিরে আসেন , তখন চীনে তার অনুবাদক বিখ্যাত কবি স্যু চি মো (Xu Zhimo) কবি গুরুকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনি দেশে ফিরে যাবেন, কোনো জিনিস চীনে রয়ে গেছে? ঠাকুর মজা করে উত্তরে বলেছিলেন, 'আমার মন চীনে রয়ে গেছে'।
সেমিনারে উপস্থিত বিশিষ্ট অতিথি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভ্রাতুষ্পুত্র অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাতি তিরানব্বই বছরের অমিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর চীনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নিয়ে বেশ কিছু গল্প শোনান। অনুষ্ঠানে ভারতের জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী উষা উত্থুপ জাং শিং ও ইয়াং ওয়েই মিং স্বর্ণার সঙ্গে রবীন্দ্র সংগীত পরিবেশন করেন ।
সেমিনারে উপস্থিত ভারতীয় সাংবাদিকদের কনসাল জেনারেল মা চান উ বলেন, "রবীন্দ্র চর্চায় চীন নেহাত কম যায় না৷ আমার তো মাঝে-মাঝে মনে হয়, কলকাতার চেয়ে হয়তো রবীন্দ্রচর্চা বেশি হয় পেইচিংয়ে ৷ তাঁর কথায়, ভারতীয় ভাষা এবং ইংরেজি ভাষার পরে রবীন্দ্র সাহিত্য সবচেয়ে বেশি শুধুমাত্র চীনা ভাষায় ছাপা হয়। ভারতের পরে সম্ভবত চীনে তার ভক্তের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। চীনের মাধ্যমিক স্কুলের পাঠ্যসূচীতে কয়েক দশক আগেই রবীন্দ্রনাথের রচনা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।"
ভারতের ও বাংলাদেশের শ্রোতারা এটা জেনে খুবই খুশি হবেন যে বাংলাসাহিত্যের সূর্যসন্তান কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫৫ জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে চীন আন্তর্জাতিক বেতারের বাংলা বিভাগের প্রায় অর্ধযুগের প্রচেষ্টায় চীনের বৃহত্ প্রকাশনা সংস্থা পিপলস পাবলিশিং হাউস 'দি কমপ্লিট ওয়ার্কস অব টেগোর' নামে রবীন্দ্র রচনাবলীর চীনা অনুবাদ গত ৫ই মে পেইচিং -এ প্রকাশিত হয়েছে। এ রচনাবলীর সম্পূর্ণটিই বাংলা ভাষা থেকে অনুবাদ করা হয়েছে এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সব লেখা সংগ্রহ করা হয়েছে। চীনা ভাষায় অনুবাদের জন্য ১ কোটি ৬০ লাখ অক্ষর ব্যবহৃত হয়েছে, যা মোট ৩৩টি গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে। এটি চীনের দ্বাদশ পঞ্চ বার্ষিকী পরিকল্পনার একটি অংশ এবং বর্তমান বিশ্বে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্যকর্মের সবচেয়ে বিস্তারিত চীনা অনুবাদ। আজ সব অর্থেই রবি ঠাকুর ভারত ও চীনের মৈত্রীর সেতুতে পরিণত হয়েছেন।
লেখক পরিচয়: রবিশংকর বসু, সম্পাদক, নিউ হরাইজন রেডিও লিসনার্স ক্লাব, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত