মাঝখানে চালর্স লি
চালর্স লি হচ্ছেন পেইচিং অলিম্পিক গেমসে মার্কিন প্রতিনিধি দলের নেতা। ১৯৮৪ সালে যখন যুক্তরাষ্ট্র লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিক গেমস বয়কটের হুমকিতে পড়েছিল সে সময় চার্লস লি বিশেষ দূত হিসেবে চীনে এসেছিলেন। তখন থেকে চীনের সঙ্গে তাঁর চিরস্থায়ী সম্পর্ক স্থাপিত হয়। সম্প্রতি ওয়াশিংটনে আমাদের সংবাদদাতা ওয়াং শান শান চার্লস লির বিশেষ সাক্ষাত্কার নিয়েছেন। সাক্ষাত্কারে তিনি তাঁর স্মরণীয় অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন।
চার্লস লি'র চীনা নাম লি সি। ১৯৮৪ সালের ১২ মে লি সি ও বর্তমান মার্কিন অলিম্পিক কমিটির চেয়ারম্যান পিটার উয়েবেরোথের মনের বিশেষ স্মৃতি এখনো অম্লান। সেদিন গভীর রাতে পেইচিংয়ে লি সি আনন্দচিত্তে তত্কালীন লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিক সাংগঠনিক কমিটির চেয়ারম্যান উয়েবেরোথকে ফোন করে জানিয়েছিলেন, 'তারা আসছেন'। আসলে লি সি জানিয়েছিলেন, চীনের প্রতিনিধি দল যে লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিক গেমসে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে কথা। লি সি বলেন, 'সম্প্রতি আমি উয়েবেরোথের সঙ্গে এ নিয়ে আলাপ করেছি। তিনি বলেন, যদি সেই সময় চীন না আসতো তাহলে শুধু লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিক গেমস নয়, বরং গোটা অলিম্পিক ক্রীড়ার জন্যই বড় ক্ষতি হতো।'
যুক্তরাষ্ট্র ১৯৮০ সাল মস্কো অলিম্পিক গেমস বয়কট করেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের ওপর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য ১৯৮৪ সালের মে মাসে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন খেলোয়াড়দের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিক গেমসে প্রতিনিধি দল না পাঠানোর ঘোষণা দেয়। এর পাশাপাশি সোভিয়েত ইউনিয়ন অনেক দেশকে যৌথভাবে লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিক গেমস বয়কট করার প্রস্তাব করে। লি সি বলেন, তারা খবর পান যে, চীনও এ দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে। 'তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন অনেক দেশকে সাথে নিয়ে লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিক বয়কট করার চেষ্টা চালিয়েছিল। আমরা শুনেছি যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন ১০০টি দেশের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন স্পষ্টভাবে উয়েবেরোথকে জানিয়েছিল , চীনও বয়কট করবে।'
পিটার উয়েবেরোথ
লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিক গেমস উদ্বোধনের দু'মাস আগে যুক্তরাষ্ট্র বয়কটের তথ্য পায় । উয়েবেরোথ ত্বরিত্ কিছু বিশেষ দূতকে বিভিন্ন দেশে পাঠান। লস অ্যাঞ্জেলেসের একজন ফেডারেল পাবলিক প্রসিকিউটর হিসেবে লি সি লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিক গেমসের সংশ্লিষ্ট আইন ও নিয়মকানুন প্রণয়নের কাজে অংশ নিয়েছিলেন। ভালো চীনা ভাষা বলতে পারেন বলে লি সি একটি গ্রুপ নিয়ে পেইচিংয়ে আসেন। উয়েবেরোথ কিউবাতেও গিয়েছিলেন। তরে তার কিউবা সফর ব্যর্থ হয়। লি সি চীন থেকে সুখবর নিয়ে ফিরে যান। সে বারের চীন সফরের স্মৃতিচারণ করে লি সি বলেন, 'চীন যাওয়ার আগেই আমি শুনেছিলাম, চীন অলিম্পিক গেমস অংশ নেবে। আমি চীন সফরের উদ্দেশ্য ছিল চীনের প্রতিনিধি দলের অলিম্পিক গেমসে অংশগ্রহণ সম্পর্কে একটি লিখিত বিবৃতি পাওয়া। চীনের ক্রীড়া কর্মকর্তারা বন্ধুত্বপূর্ণ এবং অতিথিপরায়ন। তাঁরা দ্রুতই আমাদেরকে প্রয়োজনীয় স্বীকৃতি পত্রটি দিয়েছিলেন। এটা ছিল লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিক গেমস তথা বিশ্ব অলিম্পিক ক্রীড়াকে দেয়া চীনের একটি বড় উপহার। আমি তাদের সেই সমর্থনের জন্য সবসময় কৃতজ্ঞতা জানাই।'
১৯৮৪ সালে বয়কটের মুখে ১৪০টি দেশ লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিক গেমসে অংশ নিয়েছিল এবং সাফল্যের সঙ্গে অলিম্পিক গেমস আয়োজনের বাণিজ্যিক পদ্ধতি তুলেছিল। লি সি মনে করেন, চীন লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিক গেমসের নিয়তি বদলে দিয়েছিল। তিনি বলেন, 'একটি বড় দেশ হিসেবে চীন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মানুষের চীনের ওপর বিশেষ কৌতুহল আছে। আমি মনে করি, চীন লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিক গেমসে অংশ নিতে রাজ হওয়ায় বয়কটের প্রবণতাও অনেক কমে গিয়েছে। অবশেষে কেবল ১৪টি দেশ বয়কটে অংশ নিয়েছিল এবং সেগুলো ছিল অপেক্ষাকৃত ছোট দেশ। উয়েবেরোথের কথা ছিল , চীন লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিক গেমসকে উদ্ধার করেছিল।'
চীনে যাওয়া একজন বিশেষ দূত হিসেবে লি সি লস অ্যাঞ্জেলেস বিমান বন্দরে চীনের ক্রীড়া প্রতিনিধি দলকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। অলিম্পিক গেমসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে চীনের ক্রীড়া প্রতিনিধি দলের উষ্ণ অভ্যর্থনা পাওয়ার দৃশ্য এখনো তাঁর মনে অম্লান হয়ে আছে। তিনি বলেন, 'এটা হচ্ছে আমার স্মৃতিতে সবচেয়ে হৃদয়স্পর্শী ও অভিনব দৃশ্যের একটি। চীনের প্রতিনিধি দল স্টেডিয়ামে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে ৯০ হাজার দর্শকের উল্লসিত অভ্যর্থনা পায়। মানুষ দীর্ঘক্ষণ ধরে হাততালি দিয়ে তাদেরকে বরণ করে নিয়েছিলেন। সবাই চীনের উপস্থিতিতে উত্তেজিত বোধ করেছিলেন। আমি গভীরভাবে উপলব্ধি করেছি যে, মানুষের মধ্যে এ ধরনের মুখোমুখি বিনিময় পরস্পরের মৈত্রী ও সমর্থনের ভালো পদ্ধতি।'
১৯৮৪ সালের লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিক গেমস থেকে চীন আধুনিক অলিম্পিক গেমসে ফেরে যাত্রা শুরু করে এবং অলিম্পিক গেমসের প্রথম স্বর্ণপদক অর্জন করে। লি সি মনে করেন, চীনের প্রতিনিধি দলের নৈপুন্য দুর্দান্ত ছিল। তিনি বলেন, 'তাদের মধ্যে বিশ্ব পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় রয়েছেন। যেমন লি নিং। তখন আমি চীনের ক্রীড়া সম্পর্কে তেমন ধারণা ছিল না। কিন্তু আমি জানতাম, জিমন্যাস্টিকস ইভেন্টে চীন খুব শক্তিশালী। চীনা দল প্রথম বার অলিম্পিক গেমস অংশ নিলেও অনেকগুলো স্বর্ণপদক জিতেছিল।'
তখন থেকে লি সি আর চীনের ক্রীড়া মহলের মধ্যে চিরস্থায়ি সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। এ বছরের আগস্ট মাসে তিনি মার্কিন প্রতিনিধি দল নিয়ে পেইচিং আসবেন। তিনি বলেন, ১৯৮৪ সালে চীন অলিম্পিক ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এবার চীন স্বাগতিক দেশ হিসেবে অলিম্পিক গেমস আয়োজন করবে। এর মধ্যে চীনে আকাশ পাতাল পরিবর্তন ঘটেছে। পেইচিং অলিম্পিক গেমস আর রাজনীতি প্রসঙ্গে লি সি বলেন, 'বয়কট কেবল নিরীহ খেলোয়াড়দের ক্ষতি করে তাই নয়, কোন উদ্দেশ্য্ই এতে বাস্তবায়িত হয় না। আমি মনে করি, বয়কট মূল্যহীন।'
লি সি বলেন, পেইচিং অলিম্পিক গেমস চলাকালে তিনি মার্কিন ও বিভিন্ন দেশের খেলোয়াড়দের উত্সাহ দেয়ার জন্য যত বেশি সম্ভব প্রতিযোগিতা দেখবেন। তিনি বিশ্বাস করেন, তাঁর পেইচিং সফর অত্যন্ত সুখী ও পরিপূর্ণ হবে। (ইয়ু কুয়াং ইউয়ে)
|