v চীন আন্তর্জাতিক বেতারv বাংলা বিভাগv চীনের বিশ্ব কোষ
China Radio International
পর্যটনসংস্কৃতিবিজ্ঞানখেলাধুলাকৃষিসমাজঅর্থ-বাণিজ্যশিক্ষার আলো
চীনা সংবাদ
বিশ্ব সংবাদ
চীনের কণ্ঠ
সংবাদ ব্যক্তিত্ব
সংবাদের প্রেক্ষাপট
নানা দেশ
কুইজ
আবহাওয়া

মহা মিলন ২০০৮ পেইচিং অলিম্পিক গেমস

ভয়াবহ ভূমিকম্প দক্ষিণ-পশ্চিম চীনে আঘাত হেনেছে

লাসায় ১৪ মার্চ যা ঘটেছিল

ইয়ুন নান প্রদেশ

দক্ষিণ এশিয়া

তৃতীয় নয়ন
আরো>>
(GMT+08:00) 2008-02-27 20:06:45    
রেহানা সুলতানা রোজি(২)

cri
যে চীন আমার স্বপ্নছিল

আমি বেইজিং এসে যে এলাকায় ছিলাম সে এলাকাটির নাম হল ছং জু ইউয়ান । এলাকাটি চীনের পঞ্চম রিং রোডের প্রায় গা ঘেষে অবস্হিত ; শহরের পশ্চিম প্রান্তে পাহাড়ের কাছাকাছি । আমাদের ভবনটির পশ্চিমে আর মাত্র ৪/৫টি ভবন তখন তৈরি হচ্ছিল । আমরা ভবনটির ২২ তলায় উঠলাম । ভবনটির উত্তর,পশ্চিম আর দক্ষিণের কিছুটা অংশ একদম খোলা । তিন দিকে ফাঁকা মাঠ, রেল লাইন, সড়ক ও পেঁচালো ফ্লাইওভার এবং সুউচ্চ সবুজাভ পাহাড় । বাড়িটি আমার খুব পছন্দ হয়েছিল । কমিউনিটির ভেতর রয়েছে সুন্দর একটি চত্তর যার চার পাশ ঘীরে রয়েছে অসংখ্য ফুলের গাছ এবং হালকা ব্যয়াম করার মত ইকুইপমেন্টসহ শিশু ও বয়স্কদের জন্য খেলার ব্যবস্হা ।

আমি আসার তৃতীয় দিনে আমাদের সম্মানে সি আর আই বাংলা বিভাগের পক্ষ থেকে একটি লাঞ্চের আয়োজন করা হয় । সেটা সম্ভবত: হোয়ালিয়নের পাশে কে এফ সি'র উপরে 'তুং ফো চিউ লৌ' ছিল । আমার ছোট ছেলে সেজানসহ আমরা সেখানে গেলাম।

সেখানে উপস্হিত ছিলেন বাংলা বিভাগের পরিচালক ইউ কোয়াং ইয়ু, উপ পরিচালক চিয়াং চিন ছেং, জনাব ইয়াও বাওলাই, জনাব পাই খাই ইউয়ান, ফেং শিউ ছিয়েন, চুং শাও লি, বিভাগের অপর বিশেষজ্ঞ জনাব ইলিয়াস খান, শুয়ে ফেই ফেই, ছাও ইয়ান হুয়া, ওয়াং হাই মান, ইয়াং ওয়ে মিং, শিয়ে নান, লি লি, খোং চিয়া চিয়া, লি লু, ছাই ইউয়ে ও শুই হুয়া সহ অনেকেই। সবার নাম এই মুহুর্তে মনে করতে পারছিনা । আমি ঠোকার সাথে সাথে সবাই উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো। পরিচালক ইয়ু খুব সুন্দর করে হেসে আমাকে অভর্থনা জানালেন । আমাতো অবাক হোয়ে ওনার দিকে তাকিয়ে আছি, এত সুন্দর বাংলা বলছেন । উনি দেখতেও খুব সুন্দর । আমার খুব পছন্দ হল । খাওয়ার সময় মেয়েরাসহ সবাই বাংলায় আমার সাথে কথা বললো। আমি আশ্বস্ত হলাম । যাক, কথা বলার মানুষ পাওয়া গেল । সেখান থেকে ফেরার পথে শিয়ে নানকে নিয়ে হোয়ালিয়ন মার্কেটে গেলাম। কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস কিনলাম । তারপর সেদিন গল্প করতে করতে হেঁটে বাসায় ফিরলাম ।

আমাদের ভবনের লিফ্ট তত্বাবধানকারী মহিলা খুবই ভালো ছিল । যতবার লিফ্টে উঠতাম ততবারই তিনি হেসে বলতেন 'নি হাও' । আমাদের ভবনসহ এই কমিউনিটির লোকজন সবাই বেশ আন্তরিক । আমরা কেউ কারো ভাষা বুঝি না । তারপরও হাসির বিনিময়ে মনের ভাব প্রকাশ করে সবাই । কথাও বলে, আমিও ইশারায় কথা বলি । তবে দু'একজনের সংগে পরিচয় হয়েছে । যারা এক-আধটু ইংরেজী বলতে পারতো । আমার নাম রোজি। অর্থাত্ রোজ, রোজ মানে গোলাপ। আর গোলাপকে চীনা ভাষায় বলা হয় 'মেই কুই হুয়া' । তাই এলাকার সবাই আমাকে এরপর থেকে মেই কুই হুয়া বলে ডাকতো । আমি বেশ পুলকিত হতাম । খুব ভালো লাগতো । কমিউনিটি সংলগ্ন দু'টি সুপার মার্কেট রয়েছে । সেখানে কিছু কিনতে গেলেই সেলসম্যান মহিলারা খুব আন্তরিকতার সংগে সাহায্য করতো । এমন কি জিনিস-পত্র নিচে নামিয়ে দেয়াসহ বাসা পর্যন্ত এগিয়ে দিত । মনে মনে ভাবি আগে জানতাম যে, চীনারা বন্ধুবত্সল । এখানে এসে তার প্রমান পেলাম । সত্যিই তারা এত ভালো ।

ফোনে আমার মা, ভাই বোন যার সাথেই কথা হয় ওরা জানতে চায় আমি কেমন আছি । বাসায় একা একা খারাপ লাগছে কিনা ? আমি জবাবে হেসে হেসে বলি আমি খুব ভাল আছি । তোমরা না দেখলে বুঝবে না এখানকার মানুষ কত ভালো । চীনে আসার চতুর্থ দিনেই আমার সাথে পরিচয় হয় আমার প্রিয় লিউ আপার সংগে । পুরো নাম লিউ আই হাও । যিনি আমাকে দিয়েছেন মায়ের মমতা আর বড় বোনের স্নেহ । ওনার সাথে কথা বলে তার সাথেই তার বাসায় গেলাম । ওনাকে দেখার পর তার কথা শুনে আমি এত মুগ্ধ হলাম যে তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না । এখন আমার লিউ আপা ছাড়া একদিনও চলে না । প্রতিদিনই আমরা ফোনে কথা বলি । কখনো ঘন্টার পর ঘন্টা । আমার কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা তা তিনি জানতে চান এবং নির্দিধায় তার সমাধান করে দেন । প্রায়শই আমার বাড়িতে আসেন । ওনার হাতের কাজ খুব সুন্দর । তা ছাড়া তিনি খুব ভালো হাতের কাজ জানেন । হাতের কাজ করার প্রতি আমার নেশা আছে । আমি শিখতে চাইলাম । অমনি আপা রাজী হয়ে গেলেন । সেই থেকে আপার কাছ থেকে আমি হাতের কাজ শিখছি । আপা যা জানেন তাই আমাকে শিখিয়ে দেন । এসব কাজের জন্য কখনো কোন কিছু প্রয়োজন হলে আপা আমাকে সাথে নিয়ে মার্কেটে নিয়ে যান । নিজেই দেখে শুনে আমার জন্য সব কিছু বাছাই করে কিনে দেন । তখন মনে হয় মানুষ এত ভাল হয় কী করে !

একদিন অফিসের (সি আর আই) প্রয়োজনে আমার মেডিকেল চেক আপ করাতে হবে । এ জন্য আমাকে হাসপাতালে যেতে হয় । স্বর্ণা নামের একটি মেয়ে আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই । কথা-বার্তা শুনে মেয়েটিকে ভালোই লাগলো । সি আর আই'র গাড়িতে করে হাসপাতালে যাওয়ার সময় তার সাথে আমার অনেক কথা হয় । তখন গ্রীষ্মকাল ছিল । মোটামুটি গরম । গাড়িতে যাওয়ার পথে দেখলাম, পথের দু'পাশে আর সড়ক দ্বীপে ফুটে রয়েছে অসংখ্য নানা রঙের নানা ধরনের ফুল । রাস্তাগুলো খুব প্রশস্ত। দু'পাশের গাছগুলোও সব একই মাপের । আরো ভালো লেগেছিল চারদিকে যেন সবুজ জড়িয়ে রয়েছে । রাস্তায় বাংলাদেশের মত তেমন একটা যান জট নেই । ফ্লাইওভারের সংখ্যা দেখেও অবাক হয়েছিলাম । মেয়েটি আমাকে জিজ্ঞেস করলো ম্যাডাম বেজিং আপনার কেমন লাগছে ? আমি শিশুদের মত উচ্ছসিত হয়ে বললাম ভিষণ ভালো লাগছে । হঠাত্ দেখি গাড়ির ড্রাইভার আমার আবেগ আর উচ্ছাস দেখে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে । আমি খুব লজ্জা পেলাম ।

একটি কথা বলতেই হয় যে, সি আর আই'তে যারা কাজ করে তারা খুব বিনয়ী । মেয়েগুলো এত সুন্দর করে বাংলা বলে ওদের মুখে আমার বাংলা ভাষা শুনতে খুব ভাল লাগে । আমারও খুব ইচ্ছে চীনা ভাষায় কথা বলার । জানিনা পারবো কী না । তবে চেস্টা করলে একদিন অবশ্যই পারবো ।

বেইজিং আসার পর আমার ছেলেদেরও একটু খারাপ লেগেছে । কারন সম্পুর্ন ভিন্ন পরিবেশ হয়তো তাই । বড় ছেলেতো উহান যেতেই চায়নি । এখন কিন্তু দু'ই ছেলেই চীন ছেড়ে যেতে চায়না এখন । ওরাও মনে হয় চীনকে ভালোবেসে ফেলেছে । এই ভালোলাগার আরো কারণ হলো, আমি ছং জু ইউয়ানের যে বাড়িতে ছিলাম সেই বাড়ির প্রসস্ত বরান্দা এবং আমার বেডরুমের জানালা দিয়ে দুরের সারিবদ্ধ পাহাড় দেখা যেতো । আমি একা একা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমার বেডরুমের জানালা দিয়ে আকাশ ছোঁয়া সবুজ পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকতাম । খুব ভাল লাগতো । মাঝে মাঝে মনে হতো আমি যদি ঐ পাহাড়ের শীর্ষে উঠতে পারতাম । কতই না মজা হতো । হয়তো দুরের আমার স্বপ্নের বাংলাদেশটাকেও দেখতে পারতাম । এ কথা শুনে ছালাউদ্দিন হেসে উঠতো । আমাদের ভবনটির পাশ দিয়েই চলে গিয়েছিল রেল লাইন । সারা দিন ট্রেন আসা-যাওয়া করতো । ট্রেন গুলোও ছিল রং বে-রংয়ের । কোনটা দ্রুতগামী আর কোনটা ঢিমে তেতালা । কোনটা যাত্রীবাহি আবার কোনটা মালগাড়ী । বেশিরভাগ ট্রেনই বিদ্যুত চালিত । হুশ হুশ করে ট্রেনগুলো চলে যাচ্ছে । যেতে যেতে তারা দুরের পাহাড়ের একটি গুহার মধ্যে ঢুকছে কিছুক্ষণ পর বেরিয়েই আবার ঢুকে যাচ্ছে আরেকটি টানেলের মানে গুহার মধ্যে । যতক্ষণ পর্যন্ত দেখা যায় আমি শুধু তাকিয়েই থাকি দৃস্টিরা যতক্ষণ না ঝাপসা হয়ে যায় ।

(চলবে)