যে চীন আমার স্বপ্ন ছিল
রেহানা সুলতানা রোজি
আমি নিজেই খুব অবাক হচ্ছি ।! অবাক হচ্ছি এই জন্য যে , চীনে এসে লিখতে হচ্ছে এ কথা ভেবেই । আমার খুব ভালোও লাগছে ।
সেই কবেকার কথা তখন আমি খুব ছোট্ট ছিলাম । উপজেলা শহরের একটি নাম করা বিদ্যালয়ের ছাত্রী । সে সময় লেখাপড়া প্রসঙ্গে আমার বাবা বলেছিলেন, আমাদের নবী করীম (স:) বলেছেন "যদি জ্ঞান অর্জন করতে চাও, তবে সুদুর চীন দেশে যাও ।" সেই থেকেই চীন দেশকে দেখার আর জানার আমার প্রবল আগ্রহ
কাজ করতে থাকে হ্রদয়ের ভেতর । তখন মাঝে মাঝেই বাবাকে প্রশ্ন করতাম আমদের নবীজি অন্য কোন দেশের কথা না বলে চীনের কথা বলেছেন কেন ? ওখানে কী আছে ? জবাবে উনি বলতেন, লেখাপড়া শিখে বড় হও । তখন অনেক কিছুই জানতে পারবে । সম্ভব হলে একদিন তুমিও চীনে যেতে পারবে।
আমার বিয়ের পর দেখলাম আমার স্বামীও ছোটবেলা থেকেই চীনকে খুব পছন্দ করে । সে চীনের তথা সাড়া বিশ্বের শোষিত, নিপীড়িত ও নির্যাতিত মানুষের মহান নেতা মাও সে তুঙ-এর সকল বই-পত্র ও তার অনেক ছবি সযত্নে রেখে দিয়েছেন । সময় পেলেই সে গুলো পড়েন । আর ও মজার কথা হলো যখন আমদের দুই ছেলে হলো তারা পড়তে শেখার পর থেকেই চীনের সব মজার মজার গল্প পড়তে ভালোবাসতো । বই পড়ার অভ্যাস খুব ছোটবেলা থেকেই । অজানা বিষয়ে আমার
জানার আগ্রহ দূর্বার । আমার ছেলেরাও হয়েছে তাই । চীনা দুতাবাস থেকে ওরা চীনের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ওপর শিশুদের উপযোগী সহজ করে লেখা ও চীন থেকে প্রকাশিত ইংরেজী এবং বাংলায় অনেক বই প্রায়শই উপহার হিসেবে পেতো । তখন চীনা দূতাবাসে কর্মরত মিস্টি ভাষি জনাব ইয়াও বাওলাই ও অন্য কর্মকর্তাগণ দিয়েছিলেন । আমার ছোট ছেলে তখন মাত্র পড়া শিখেছে । ও সারাক্ষণ বইগুলো খুলে পড়তো । পান্ডাদের জন্মস্হান ও ছিয়াও ইং-এর গানসহ আরও অনেক বই । ওর খেলনা পুতুল গুলোর নামও রেখেছিল বই থেকে সংগ্রহ করা চীনা নামে । সে সময় আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধব সবাই মজা করে বলতো তোমরা চীন দেশে চলে যাওনা কেন?
মনের সেই স্বপ্নটাই আমার বিয়ের দুই যুগেরও পর বাস্তবে রূপ লাভ করলো। । যখন আমার স্বামী সত্যি সত্যিই একদিন এসে বললো আমরা চীনে যাচ্ছি । চীন আন্তজর্জাতিক বেতারের বাংলা বিভাগে । কথাটা প্রথমে আমার বিশ্বাশই হয় নি । ভেবেছিলাম হয়তো আমার সঙ্গে জোক করছে । অলক্ষে আমার দু' চোখ ঝাপসা
হয়ে গিয়েছিল । শিল্পকলা একাডেমী থেকে লিয়েন নিয়ে ১৭ই জুন ২০০৬ সে চলে গেল । এরপর দেখতে দেখতে একদিন অর্থাত আগস্ট মাসে আমরা সবাই চীন দেশে চলে আসি । এত সুন্দর একটা দেশে আসতে পেরে আমার কী যে আনন্দ লেগেছে তা ভাষায় প্রকাশ করে বোঝাতে পারবোনা । সৃস্টি কর্তাকে ধন্যবাদ । এ কথা না বললেই নয় যে আমার বড় ছেলে রেহান সালাউদ্দিন স্কলারশীপ পেয়ে উহান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যলয়ে এম বি এ পড়ছে । ছোটটা বৃটিশ কাউন্সিল থেকে এ লেভেল পরীক্ষা দিচ্ছে । এখানে আসার পর খুশিতে আমার উত্তেজনা দেখা দিয়েছিল : আমার ছোট বেলার স্বপ্নের দেশকে নিজের চোখে দেখবো এবং ঘুরবো । আবার
ভয় ও হচ্ছিল কারণ আমিতো ভাষা জানি না । তাহলে সবার সাথেইবা মিশবো কী ভাবে । কথাওতো বলতে পারবোনা । ইচ্ছে করলেই একা কোথাও যেতেও পারবো না । কিছুদিন পরই আমি অনুভব করলাম, আমি অহেতুক ভয় পেয়েছি । এখানে উল্লেখ করতে হয় যে, ৩১শে আগস্ট ২০০৬ দুপুরে বাংলাদেশ এয়ার পোর্ট থেকে যখন চায়না ইস্টার্ন এয়ার লাইন্সের বিমানে উঠলাম তখন দেশের জন্য ও মা ভাই বোন সবার জন্য খুব কান্না পাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল আমি একা হয়ে যাব । সেদিন রাত ১২টা ৩০ মিনিটে বিমান বেজিং এয়ার পোর্টে এসে নামলো । আমি দু' ছেলেকে নিয়ে বেড়িয়ে এসে দেখি ছালাউদ্দিন এবং সি আর আই এর শিয়ে নান দাঁড়িয়ে আছে । শিয়ে নান এগিয়ে এসে কথা বললো প্রথমেই । পরিচিতি ও বিনিময় পর্বের পর সি আর আই এর গাড়িতে উঠলাম । তখন চারদিকে অন্ধকার ।
রাস্তায় উঠেই দেখি অনেক রঙের বাতি জ্বলছে । বেশির ভাগই লাল আর লাল । প্রথম কস্ট পেলাম আমার বড় ছেলে আমদের ছেড়ে চলে গেল স্কলারশীপ পাওয়া ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে তাই । যাবার সময় ওদের অভ্যর্থনাকারী জানাল যে কাল বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুষঙ্গিক কাজ শেষে সে একদিনের জন্য বাসায় যেতে পারবে । আমাদের সঙ্গে শিল্পকলা একাডেমীর নাট্যকলা বিভাগের সহকারী পরিচালক পূ্র্ণ চন্দ্র চাকমা আমাদের গাড়িতেই আমাদের বাসায় চলে আসে । সে স্কলারশীপ পেয়ে এলেও ওকে কেউ নিতে আসে নি । (চলবে)
|