হাংচৌ শহরের পশ্চিম হ্রদ
মনোহর নৈসর্গিকসৌন্দর্য , সুজলা সুফলা পল্লীগ্রাম ,সুস্বাদু খাবার , এবং সমৃদ্ধ সংস্কৃতির জন্য দক্ষিণ পুর্ব চীনের জে জিয়াং প্রদেশের রাজধানী হাংচৌ শহর মর্ত্যের স্বর্গ বলে পরিচিত । চীনের উন্মুক্ততাআর সংস্কার অভিযানকে গভীরে নিয়ে যাওয়ার সংগে সংগে জে জিয়াংপ্রদেশে চাকরি ও অধ্যয়ন করতে আসা বিদেশীদের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে । তাঁদের অনেকের পরিবারও এখন জে জিয়াংপ্রদেশে বা হাংচৌ শহরে রয়েছে। কেউ কেউ সেখানে বার্ধক্য জীবন যাপন করছেন ।
পাঁচ বছর আগে দক্ষিণ কোরিয়ার মি: কিম জিং সেক তাঁর স্ত্রী হুয়ে জুং সুক আর দুটো ছোটো মেয়ে নিয়ে হাংচৌ শহরে আসেন ।চোখের পলক ফেলতে না ফেলতে পাঁচ বছর কেটে গেছে । লম্বা ছিপছিপে চেহারার মি: কিম জিং সেক একজন শিল্পী ,তাঁর মাথার পেছনে ছোটো একটি বেণী বাঁধা । নম্র স্বরে কথা বলেন তিনি । কিছু দিন আগে তিনি চীনের চারু শিল্প কলেজের মৃন্ময় পাত্র বিষয়ক শিল্প বিভাগ থেকে মাস্টার্স ডিগ্রী পেয়েছেন । তাঁর পরিবারের দৈনন্দিন জীবনের কর্তব্য পালন করেন তাঁর স্ত্রী হুয়ে জুং সুক । সম্প্রতি তিনি স্বামীর একটি প্রদর্শনীর আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত । চীনে পাঁচ বছর ধরে থাকার ফলে তাঁরা এখন সাবলীলভাবে চীনা ভাষায় কথা বলতে পারেন ।
মাদাম হুয়ে জুং সুক বলেছেন , আট বছর হল আমরা চীনে এসেছি । প্রথমে ছিলাম তিয়ানজিন শহরে, পরে এসেছেন হাংচৌ শহরে । আমার স্বামী শিল্প রসিক ,আমি সংস্কৃতি- অনুরাগী , তাই আমাদের পক্ষে হাংচৌ সত্যিই একটি উপযুক্ত স্থান ।
হানংচৌয়ের প্রসংগ তুলতে মি: কিম জিং সেক ও তাঁর স্ত্রী হুয়ে জুং সুক উত্ফুল্লভাবে অনর্গল কথা বলতে লাগলেন । আট বছর আগে কোরিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়োশোনা শেষ করার পর চীনা সংস্কৃতির প্রতি গভীর ভালোবাসা এবং শিল্পের প্রতি রঙীন স্বপ্নই মি: কিম জিং সেককে চীনের তিয়েনজিন শহরে গিয়ে চীনা ভাষা শিখতে উত্সাহ দিয়েছিল ।তাঁর স্ত্রী হুয়ে জুং সুক দ্বিধাহীনভাব তাঁদের মেয়ে নিয়ে স্বামীর সংগে চীনে আসেন । মি: কিম জিং সেক বলেছেন , আর্ট কলেজের মাস্টার্সকোর্সে অধ্যয়নের জন্য তিনি যে হান চৌ শহর বেঁছে নিয়েছেন তা বোধহয় চীনাদের কথিত ভাগ্য-দেবের নিরব নির্দেশের ফলশ্রুতি ।হানচৌ এসে তিনি নিজেকে ধন্য মনে করেন । তাঁর পরিবার এই সুন্দর শহরের সংগে মিশে গেছে । তিনি বলেছেন হাংচৌ শহর যেন প্রাকৃতিক দৃশ্যর একটি ছবি , খুবই রোমান্টিক। বিশেষ করে আমার কলেজ মনোরম পশ্চিম হ্রদের ধারে অবস্থিত । এমন সুন্দর দৃশ্য দক্ষিণ কোরিয়ায় চোখে পড়ে না । এই শহরের জীবনের গতি আমার ভালোলাগে । দক্ষিণ কোরিয়ার জীবনের গতি এত দ্রুত যে তার সংগে তাল রেখে চলা কঠিন। হানচৌ শহরে আমার মনে হয় রোজ চাকরি করাটা যেন রোজ বিশ্রাম করার মত ।
মাদাম হুয়ে জুং সুক মৃদু হাসতে হাসতে কথা বলেন । তাঁকে দেখা মাত্র বোঝা যায় নে তিনি একজন সুযোগ্য স্ত্রী ও মাতা । বস্তুত: তিনি একজন পরিশ্রমী গৃহিনী । স্বামী ও মেয়েদের দেখাশোনা ও ঘরককন্না করা ছাড়া তিনি হাংচৌ শহরবাসীদের কোরিয় ভাষা শিখান এবং সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানে অংশ নেন । হানচৌ শহরে তিনি প্রথম কোরিয় ভাষার কনিকুঞ্জ খুলেছেন । তিনি বলেছেন তিনি চীনে জীবন যাপন করার সংগে সংগে চীনের সংস্কৃতিও উপভোগ করছেন , তিনি চীনে দক্ষিণ কোরিয়ার সংস্কৃতি প্রসারিত করতে চান ,এটা দু দেশের মধ্যকার বেসরকারী আদান প্রদানের একটি অংশ বলে তিনি মনে করেন । তিনি বলেছেন ,বসন্ত উত্সব উপলক্ষে আমি হাংচৌয়ের একটি স্কুলে চীন -দক্ষিণ কোরিয়ার বন্ধুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক আদান প্রদান সপ্তাহের আয়োজন করেছি। আমি ছাত্রছাত্রদেরআচার তৈরী করতে শিখিয়েছি । তাদের সংগে দক্ষিণ কোরিয়ার পোষাক, চিত্রশিল্প আর বাড়িঘরের পরিচয় করিয়ে দিয়েছি । শেষ দিন আমি ছাত্রছাত্রীদের তৈরী আচার সহ তাদের তৈরী জিনিষপত্রের একটি প্রদর্শনীরও আয়োজন করেছি ।
মাদাম হুয়ে জুং সুকের দুটো মেয়ে হানচৌ শহরের একটি স্কুলে পড়াশোনা করছে । বড় মেয়ের বয়স ১৩ বছর , ছোটো মেয়ের বয়স ১২ বছর ।তারা স্কুলে চীনা ছাত্রছাত্রীদের মত চীনা ভাষায় কথা বলে , কিন্তু বাড়িতে ফিরে প্রধানত: কোরিয় ভাষায় কথা বলেন । কোরিয়ার ইতিহাস আর সংস্কৃতিও তাদের শিখতে হ য় ।মাদাম হুয়ে জুং সুক বলেছেন :প্রায় তিন বছর ধরে আমার বড় মেয়ে চীনের বাদ্যযন্ত্র আর হু বাজানো আর ছোটো মেয়ে চীনের প্রাচীন বাদ্যযন্ত্র "জেন" বাজানো শিখেছে । আগে আমার স্বামী খুবই ব্যস্ত । সাপ্তাহিক ছুটিতে আমি তাদের নিয়ে যাদুঘর ও চারু শিল্প প্রদর্শনী ভবন পরিদর্শন করতে যাই । আমার স্বামীর সময় থাকলে তারা বাবার কর্মশালায় গিয়ে মাটি দিয়ে পুতুল তৈরী করে ।
মাদাম হুয়ে জুং সুক মনে করেন , সন্ধ্যায় খাওয়াদাওয়ার পর তাঁর পরিবারের সবাই হাংচৌ শহরবাসীদের মত মৃদু বাতাসে পশ্চিম হৃদের ধারে হাঁটতে হাঁটতে পশ্চিম হৃদের নয়নাভিরাম দৃশ্য ও পারিবারিক আনন্দ উপভোগ করাই তাঁর পরিবারের সবচেয়ে আনন্দের ব্যাপার । তিনি বলেছেন :রোজ আমরা পশ্চিম হ্রদের ধারে বেড়াতে যাই , খেলাধুলা করি এবং চা খাই , আমরা লক্ষ্য করেছি যে এক এক ঋতুতে পশ্চিমহ্রদের হৃদের সৌন্দর্য এক এক রকমের । সকাল , বিকাল আর সন্ধাবেলার পশ্চিমহ্রদের দৃশ্যও এক নয় ।
মাদাম হুয়ে জুং সুকের অনেক চীনা বন্ধু আছে । এই প্রসংগে তিনি বলেছেন :আমার চীনা বন্ধুদের মধ্যে যেমন আছেন আমার প্রতিবেশী তেমনই আছেন আমার ছাত্রছাত্রী ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পরিচিত হওয়া গণ্যমান্য ব্যক্তি । এতবেশী বন্ধু পেয়ে আমি নিজেকে সৌভাগ্যবতী বলে মনে করি ।
মাদাম হুয়ে জুং সুক চীনা রান্নার অনেক পদ্ধতি শিখেছেন । তবে তিনি যে চীনা খাবার তৈরী করেছেন তা খাঁটি চীনা খাবার নয় , তাতে মিশে আছে দক্ষিণ কোরিয় খাবারের স্বাদ । তার তৈরী খাবার সুস্বাদু বলে এবং তিনি অতিথিপরায়ন বলে তাঁর বাড়ী তাঁর বন্ধূদের রঁদেভূতে পরিণত হয়েছে ।
তিনি সগৌরবে বলেছেন , আমাদের বন্ধুরা আমার তৈরী কারি-ভাত ও নুডলস খেতে পছন্দ করেন । তাঁরা ফলাও করে বলেছেন , আমার তৈরী খাবার নাকি ফাইভ স্টার হোটেলের খাবারের চেয়েও বেশী মুখরোচক ।
মি: কিম জিং সেক সি আর আইয়ের সংবাদদাতাকে জানিয়েছেন , স্নাতকোত্তর ডিগ্রী পাওয়ার পর তিনি হাংচৌ শহরে নিজের একটি কর্মশালা খুলবেন , কাজ করার সংগে সংগে ডক্টোরেট কোর্সে অধ্যয়ন করবেন । তাঁর স্ত্রী আর মেয়েরাও তাঁর সংগে থাকবেন । কেন না , হানচৌ শহর তাদের প্রচুর আনন্দ যুগিয়েছে , হানচৌ শহর হয়েছে তাঁদের দ্বিতীয় বাড়ি।
|