নাওয়াবগন্জ জেলার শ্রোতা মো: কামরুজ্জামার তাঁর চিঠিতে প্রশ্ন করেছেন, চীনের প্রধান বাণিজ্যিক বন্দর কোনটি? চীনের মহা প্রাচীরের দৈঘ্যও প্রস্থ কত? আপনার প্রথম প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে, চীনের নদনদী সম্পর্কে কিছু বণর্না দেবো। চীন দেশের অজস্র নদীর মধ্যে দেড় হাজারেরও বেশী এমন নদী আছে যেগুলোর প্রত্যেকটির অববাহিকার আয়তন ১০০০ বর্গ কিলোমিটারেরও বেশি। এগুলোর মধ্যে প্রধান প্রধান নদী হলো ছাংজিযাং, হুয়াংহো, হেইলোংজিয়াং, যুজিয়াং, হাইহো এবং হুয়াইহো। এখানে কেবল ছাংজিয়াং নদী সম্পর্কে বিশেষভাবে বর্ননা করবো। ছাংজিয়াং নদীর মোট দৈর্ঘ্য ৬,৩০০ কিলোমিটার। শাংহাই , নানজিং, উহান এবং ছোংছিং-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোকে সংযুক্ত করে একটি প্রধান শিরাপথের মতো ছাংজিয়াং নদী প্রবাহিত। এই নদীতে দশ হাজারটনী বড় বড় জাহাজ চলাচল করতে পারে। চীনে বেশী কয়েকটি বড় বড় বন্দর আছে। যেমন, সাংহাই বন্দর, নিনপো বন্দর, থিয়েনচিং বন্দর , দালিয়েন বন্দর । এগুলোর মধ্যে সাংহাই বন্দরকে চীনের সবচেয়ে বড় বন্দর বলে মনে করা হয়। এখন দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি। এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে চীনের মহাপ্রাচীর সম্পর্কেও কিছু বলবো।
মহা প্রাচীরকে বিশ্বের সাতটি বিস্ময়ের একটি বলে আখ্যায়িত হয়। এই সুমহান প্রাচীর চীনের ভূখনন্ডে ৭ হাজার কিলোমিটারেরও বেশী বিস্তীর্ণ । ১৯৮৭ সালে মহা প্রাচীর বিশ্ব উত্তরাধিকারের তালিকায় অন্তভুর্ক্ত। মহা প্রাচীরের নিমার্ন কাজ খৃষ্টপূর্ব নবম শতাব্দী থেকে শুরু হয়। তখন মধ্য চীনের প্রশাসন উত্তরাঞ্চলের জাতি থেকে আক্রমন প্রতিরোধ করার জন্যে দেওয়াল দিয়ে সীমান্তে নিমির্ত প্রহরা টাওয়ারগুলোকে ঘেরাও করে। চীনের বসন্ত ও শরত যুগ আর যুদ্ধমান রাজ্যসমূহের যুগে বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে একটানা লড়াই হয়। বড় রাজ্যগুলোর মধ্যে পরষ্পরের আক্রমন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে সীমান্তের নিকটবর্তী পাহাড়ে মহা প্রাচীরের নিমার্ণ কাজ শুরু হয়। খৃষ্টপূর্ব ২২১ সালে ছিন রাজবংশের প্রথম রাজা চীনকে একীভূত করার পর আগের ছোট ছোট রাজ্যের নিমির্ত মহা প্রাচীর সংযুক্ত করে। আস্তে আস্তে আঁকাবাঁকা পাহাড়গুলোতে তৈরী এই প্রাচীর উত্তর সীমান্তের প্রতিবন্ধকতায় পরিণত হয়। যাতে উত্তর দিকের মঙ্গোলিয়ার বিস্তীর্ণ তৃণভূমির পশুপালকদের আক্রমন ঠেকানো যায়। ছিন রাজবাংশ আমলে মহা প্রাচীরের দৈর্ঘ্য ৫০০০ কিলোমিটার। ছিন রাজবংশের পর হান রাজবংশ মহা প্রাচীর আরও ১০ হাজার কিলোমিটার দৈর্ঘ্য বাড়িয়ে দেয় । দু' হাজারাধিক বছর ধরে চীনের বিভিন্ন সময়কালের প্রশাসন ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় মহা প্রাচীর নিমার্ন করেন। বিভিন্ন রাজবংশের আমলে নিমির্ত প্রাচীর এক সঙ্গে সংযুক্ত হলে মোট দৈর্ঘ্য হতে পারে ৫০ হাজার কিলোমিটারেও বেশী ।তার মানে এই দৈর্ঘ্য পৃথিবীকে এক বার ঘুরে আসার মত।
এখন মহা প্রাচীর বলতে সাধারণত মিন রাজবংশ আমলে নিমির্ত মহা প্রাচীরকে বুঝায়। এই মহাপ্রাচীর বলতে চীনের পশ্চিমাংশের গানসু প্রদেশের চিয়াইউ চোকা থেকে চীনের উত্তর-পূর্ব লিওনিন প্রদেশের য়ালোচিয়াং নদীর তীর পযর্ন্ত মহাপ্রাচীরকেই বুঝায় । এই মহা প্রাচীর চীনের ৯টি প্রদেশ, শহর, স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের মধ্য দিয়ে বিস্তীর্ণ । মোট দৈর্ঘ্য ৭৩০০ কিলোমিটার ।প্রায় ১৪ হাজার লির সমান। সুতরাং চীনের মহা প্রাচীরকে ১০ হাজার লির মহা প্রাচীর বলা হয়। মহা প্রাচীর আঁকাবাঁকা আর উচু-নিচু পাহাড়ে বিস্তীর্ণ হয়। প্রাচীরের নিচে খড়া পাহাড় । প্রাচীর আর পাহাড় পরষ্পরের সঙ্গে সংযুক্ত।প্রাচীন কালের সামরিক কাহিণীর এই মহা প্রাচীর অতিক্রম করা সম্ভব ছিল না। মহা প্রাচীর সাধারণত বড় বড় ইট আর লম্বা পাথর দিয়ে তৈরী করা হয়। ইট আর পাথরের ভিতরে হলুদ চুন শুরকীর মাটি আর পাথরের টুকরা পূর্ণ করা হয় । প্রাচীরের উচ্চতা প্রায় দশ মিটার। তার প্রন্থ ৪ থেকে ৫ মিটার। বতর্মানে সামরিক ব্যবস্থা হিসেবে মহা প্রাচীরের এই ব্যবহৃত ভূমিকা আর নেই। কিন্তু তার বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন স্থাপত্য সুমহান। মহা প্রাচীর দেখতে খুব মজবুত একটি স্থাপত্য। দূর থেকে দেখলেএই সুমহান মহা প্রাচীর একটি উড্ডয়নমান ড্রাগনের মতো চীনের ভূখন্ডে বিস্তীর্ণ । নিকট থেকে দেখলে উচু-নিচু পাহাড়ের সঙ্গে মিশে যাওয়া এই সুমহান মহা প্রাচীর একটি রহস্যময় চিত্রের মতো।
মহা প্রাচীরের ঐতিহাসিক আর সাংস্কৃতিক তাত্পর্য এবং পযর্টনের মূল্য আছে। চীনে একটি প্রবাদ আছে: ' মহা প্রাচীর দেখতে না গেলে আসলে বীর নয়'। দেশী-বিদেশী পযর্টকরা মহা প্রাচীরে উঠার পর খুব গর্ব বোধ করেন। চীনে সফরে আসা অনেক বিদেশী প্রেসিডেন্ট এই প্রাচীরে গেছেন। এখন মহা প্রাচীরের কয়েকটি অংশ অপেক্ষাকৃতভাবে সংরক্ষিত রয়েছে। যেমন পেইচিংএর বিখ্যাত বাদালিন, সিমাডে, মুতিয়েনইউ, মহা প্রাচীরের পূর্ব দিকের সানহাই গুওয়াং এবং মহা প্রাচীরের সর্ব পশ্চিম দিকে গানসু প্রদেশের চিয়াইউ গুওয়াং প্রভৃতি। এ সব জায়গা চীনের বিখ্যাত পযর্টন জায়গা। সারা বছর এ সব জায়গায় পযর্টকদের ভীড় লেগেই থাকে।
মহা প্রাচীরে চীনের প্রাচীনকালের লক্ষ লক্ষ শ্রমিকজিবীর মেধা আর শ্রম প্রতিফলিত হয়েছে। ১৯৮৭ সালে মহা প্রাচীর 'চীনা জাতির প্রতীক' হিসেবে বিশ্ব উত্তরাধিকারের তালিকায় অন্তভুর্ক্ত হয়।
|