চীনের গণ বসতি


       চীনের বিভিন্ন স্থানের আবাসিক স্থাপত্যকর্মকে গণবসতিও বলা হয়। আবাসিক স্থাপত্যকর্ম হচ্ছে সবচেয়ে মৌলিক স্থাপত্যকর্ম। এই ধরণের স্থাপত্যকর্ম সবচেয়ে আগে আবির্ভূত হয়। এর বিন্যাসও সবচেয়ে ব্যাপক এবং সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। চীনের বিভিন্ন স্থানের আলাদা আলাদা প্রাকৃতিক পরিবেশ আর আলাদা আলাদা রীতিনীতি ও সংস্কৃতির দরুন বিভিন্ন স্থানের গণবসতিতেও নানা বৈচিত্র্য দেখা যায়।  

       চীনের হানজাতি-অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোর প্রধান প্রধান ঐতিহ্যিক গণবসতি হচ্ছে নিয়মমাফিক বসতবাড়ি। কেন্দ্রীয় রেখার উভয় পাশে সুসমঞ্জস স্থাপত্যকর্ম স্থাপনের কাঠামোয় গড়ে ওঠা পেইচিংয়ের চকমিলানো বাড়ি এর আদর্শ প্রতিনিধিত্বকারী। পেইচিংয়ের চকমিলানো বাড়িতে আছে সামনের আঙিনা ও পেছনের আঙিনা। মাঝখানের প্রধান ঘরের ব্যবস্থার মানমর্যাদা সবচেয়ে বেশি। এটি হচ্ছে পারিবারিক অনুষ্ঠান আয়োজন ও বিশিষ্ট অতিথিদের সঙ্গে সাক্ষাত্ করার জায়গা। বিভিন্ন ঘরের দরজা আঙিনামুখী এবং ঘরগুলোকে সংযুক্ত করেছে বারান্দা। পেইচিংয়ের চকমিলানো বাড়ির স্থাপত্যরীতিতে চীনের প্রাচীনকালের বংশ ধারণা ও পারিবারিক ব্যবস্থা প্রতিফলিত হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে প্রশস্ত চতুষ্কোণ আঙিনার পরিবেশ শান্ত একান্ত। এতে গাছ ও ফুল সাজানো সুশৃংখল বলে এটি ঘরের বাইরের জীবনযাত্রার খুবই আদর্শ অবকাশও বটে। উত্তর চীন ও উত্তরপূর্ব চীনের বেশির ভাগ গণবসতিই এই ধরণের প্রশস্ত আঙিনা যুক্ত।

ছবি: পেইচিংয়ের চকমিলানো বাড়ি

কেন্দ্রীয় ঘর ও মাটির তৈরি দালান  

      দক্ষিণ চীনের বসতবাড়িগুলো অপেক্ষাকৃত আঁটসাঁট। বেশির ভাগই দালান। এর আদর্শ বসতবাড়ি হচ্ছে ছোট আয়তাকার আঙিনা-কেন্দ্রিক কেন্দ্রীয় ঘর। এই ধরণের বসতবাড়ির বাহ্যিক রুপ চৌকা খাড়া এবং বাহুল্যবর্জিত । দক্ষিণ চীনের বিভিন্ন প্রদেশে এই ধরণের বসতবাড়ি খুবই বেশি।

       ফুচিয়েন প্রদেশের দক্ষিণাঞ্চল , কুয়াংতুং প্রদেশের উত্তরাঞ্চর ও কুয়াংসি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের উত্তরাঞ্চলের হাক্কাভাষাভাষীরা সাধারণত: গোলাকার ও চতুষ্কোন বৃহত্ গ্রুপ বসতবাড়িতে থাকেন। কেন্দ্রীয় অংশের একতলা হলঘর ও তার চারদিকের চার বা পাঁচতলা বাড়িঘরগুলো নিয়ে এগুলো গঠিত। এই ধরণের স্থাপত্যকর্মের প্রতিরোধের গুণ খুবই প্রবল। ফুচিয়েন প্রদেশের ইউন তিং জেলার হাক্কাভাষাভাষীদের মাটির তৈরি দালান এর প্রতিনিধিত্বকারী । ইউন তিং জেলায় চতুষ্কোন, গোলাকার, আটকোণাকার ও উপবৃত্তাকার ইত্যাদি আকরের মোট হাজারের মতো মাটির তৈরি দালন রয়েছে। এইসব মাটির তৈরি দালান আকারে বড়, রুপে সুন্দর , এবং বিজ্ঞানসম্মত ও ব্যবহারের খুবই উপযোগী, তেমনি স্ববৈশিষ্টসম্পন্ন। এগুলো চমত্কার গণবসতি জগত গড়ে তুলেছে।   

       স্থানীয় মাটি , পাথরের গুড়ি , কাঠের সীট দিয়ে ফুচিয়েনের ঘরবাড়ী তৈরী করা হয়। এক একটি ছোট ঘর নিয়ে বড় আকারের ঘরবাড়ী গঠিত হয়। অবশেষে মোটা মোটা দেওয়াল বেষ্টিত দুর্গের মতো বসতবাড়ী ----মাটির তৈরী বসতবাড়ী গঠিত হয়। এই মাটির তৈরী বসতবাড়ীগুলো সুসংবদ্ধ, নিরাপদ এবং ধর্মীয় প্রকৃতিসম্পন্ন। বসতবাড়ীর উদ্যানে কূয়া আর খাদ্য রাখার ভবন আছে। যুদ্ধ আর ছিনতাইয়ের সম্মুখীন হলেও কয়েক মাস ধরে খাওয়া-দাওয়ার কোনো অসুবিধা দেখা দিত না। এই ভবনের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল: শীতকালে গরম, গ্রীষ্মকালে ঠান্ডা। তা ছাড়া ভূমিকম্প আর বাতাস প্রতিরোধের ব্যবস্থা আছে। এ কারনে খোচিয়া মানুষ বংশপরম্পরায় এই মাটির তৈরী বসতবাড়ীগুলোতে বসবাস করেন। 

সংখ্যালঘু জাতির আবাসিক স্থাপত্যকর্ম  

       চীনের সংখ্যালঘু জাতি অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোর আবাসিক স্থাপত্যকর্মও বৈচিত্র্যপূর্ণ। যেমন উত্তরপশ্চিম চীনের সিনচিয়াংয়ের উইঘুর জাতির বেশিরভাগ বসতবাড়ির ছাদ সমতল, দেয়াল মাটির তৈরি এক থেকে তিন তলা, বাইরে আঙিনা ঘেরা। তিব্বতীজাতির আদর্শ গণবসতির বাইরের দেয়াল পাথরের তৈরি, ভেতরের কাঠের তৈরি কাঠামোর ছাদ সমতল। সঙ্গোলীয়জাতি সাধারণত: ভ্রাম্যমানের মধ্যে থাকে। দক্ষিণপশ্চিম চীনের বিভিন্ন সংখ্যালঘু জাতি প্রায়ই পাহাড়ের পাদদেশে নদীর ধারে রেলিংবিশিষ্ট কাঠের দালান তৈরি করে থাকে । এইসব দালানের নীচতলা খালি থাকে, উপরতলায় মানুষ থাকে। এর মধ্যে ইউন্নান প্রদেশের তায়জাতির বাঁশের তৈরি দালান সবচেয়ে বেশি বৈশিষ্টসম্পন্ন। দক্ষিণপশ্চিম চীনের গণবসতির মধ্যে মিয়াও জাতি ও থুচিয়া জাতির থামগুলোর উপর ভর করে দাঁড়ানো দালাই সবচেয়ে বেশি বৈশিষ্টসম্পন্ন। এই ধরণের দালান ঢালুতে নির্মিত। এর কোনো ভিত্তি নেই। থামগুলোর উপর ভর করে দাঁড়ানো। দোতলা বা তিনতলা বিশিষ্ট। সবচেয়ে উপরতলা খুব নিচু। এতে মানুষ থাকে না, শুধু খাদ্য রাখা হয়। দালানের নীচে টুকরা-টাকরা জিনিস স্তুপীকৃত করে রাখা হয় বা গবাদীপশু পালনশালা নির্মিত হয়।  

উত্তরচীনের গুহা ও প্রাচীন শহরের গণবসতি  

       উত্তরচীনের হুয়াংহো নদীর মধ্য ও উচ্চ অববাহিকা অঞ্চলে গুহা ধরণের বসতবাড়ি অপেক্ষাকৃত বেশি। 

       শেনসি প্রদেশ, কানসু প্রদেশ, হোনান প্রদেশ, সানসি প্রদেশ ইত্যাদি হলুদ মাটি অঞ্চলে স্থানীয় অধিবাসীরা প্রাকৃতিক মাটির প্রাচীরে গুহা খনন করে এবং প্রায়ই কয়েকটি গুহাকে সংযুক্ত করে দিয়ে গুহার মধ্যে ইট ও পাথর দিয়ে বসতবাড়ি তৈরি করেন। গুহার ভেতরের বসতবাড়ির আগুন ও কর্কশ শব্দ প্রতিরোধক গুণ ভালো। শীতকালে বেশি শীত হয় না, গরমকালে বেশি গরম হয় না। জমি বাঁচে , অর্থ বাঁচে , শ্রমও বাঁচে। প্রাকৃতিক চিত্রের সঙ্গে জীবনচিত্রের সামঞ্জস্যপূর্ণ সংযোগও ঘটে। তাই গুহা ধরণের বসতবাড়ি হচ্ছে স্থানীয় বৈশিষ্টের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নিখুঁত সুন্দর স্থাপত্যরুপ। এর শরীরা গঠনে হলুদ মাটির প্রতি স্থানীয় অধিবাসীদের গভীর ভালোবাসা মিশে আছে।  

       তাছাড়া চীনে এ পর্যন্ত বেশ ভালোভাবে সংরক্ষিত প্রাচীন শহরগুলোও রয়েছে । এইসব প্রাচীন শহরে বহু প্রাচীন গণবসতি রয়েছে। এর মধ্যে সানসি প্রদেশের পিন ইয়াও প্রাচীন শহর ও ইউন্নান প্রদেশের লিচিয়াং প্রাচীন শহর ১৯৯৮ সালে “ বিশ্বের পুরোকীর্তির তালিকা” ভুক্ত হয়েছে।



       পিন ইয়াও প্রাচীন শহর হচ্ছে এ পর্যন্ত সংরক্ষিত সবচেয়ে পুর্ণাঙ্গ মিন আর ছিন রাজবংশের প্রাচীন জেলা শহর এবং চীনের হানজাতি অধ্যুষিত হুয়াংহো নদীর মধ্য ও নিম্ন অববাহিকার প্রাচীন জেলা শহরের আদর্শ প্রতিনিধিত্বকারী। এই শহরের প্রাচীর, রাস্তাঘাট, গণবসতি, দোকানপাট, মন্দির ইত্যাদি স্থাপত্যকর্ম এপর্যন্ত মোটামুটি ভালোভাবে সংরক্ষিত আছে। তার স্থাপত্য কাঠামো ও চেহারার বৈশিষ্ট মোটামুটিভাবে অপরিবর্তিত রয়েছে।পিন ইয়াও হচ্ছে চীনের রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, সমর, পূত, শিল্পকলা ইত্যাদি ক্ষেত্রের ঐতিহাসিক বিকাশ গবেষণার জীবন্ত নমুনা।

       নানসুং রাজবংশের আমলে প্রতিষ্ঠিত লিচিয়াং প্রাচীন শহর হচ্ছে নাসি জাতির ঐতিহ্যিক স্থাপত্যবৈশিষ্টের সঙ্গে বহিরাগত স্থাপত্যবৈশিষ্টের সমন্বয় সাধনের একমাত্র শহর। লিচিয়াং প্রাচীন শহরের উপর হুয়াংহো নদীর মধ্য ও নিম্ন অববাহিকার শহরের স্থাপত্য ব্যবস্থার প্রভাব পড়ে নি। শহরের রাস্তাগুলো অবিন্যস্ত, কোনো কড়া পাহারাধীন শহর-প্রাচীর নেই। হেইলুংথান অর্থাত্ কালো ড্রাগন পুকুর হচ্ছে প্রাচীন শহরের পানির প্রধান উত্স। পুকুরের পানি বহু ছোট ছোট স্রোতে বিভক্ত হয়ে বাড়িতে বাড়িতে প্রবাহিত হয়ে পানির জালে পরিণত হয়। প্রাচীন শহরের সর্বত্রই দেখা যায়, নদী আর খালে পানির স্রোত অবিরাম বয়ে যাচ্ছে এবং সে নদী ও খালের ধারে উইলো গাছগুলো পানি ছুঁয়ে ছুঁয়ে খেলছে।

ছবি: লিচিয়াং প্রাচীন শহর