চীনের উদ্যান স্থাপত্যের ইতিহাস সুপ্রাচীনকালের । বিশ্বের উদ্যান ইতিহাসে এর বেশ সুখ্যাতি রয়েছে। তিন হাজার বছরেও বেশি সময় আগেকার চৌ রাজবংশের আমলে চীনে সর্বাগ্রের রাজপ্রাসাদের উদ্যান দেখা যায়। চীনের নাগরিক উদ্যান খুবই সমৃদ্ধ। বিশ্বের তিনটি বৃহত্ উদ্যান ব্যবস্থায় এটি উজ্জ্বল স্থান দখল করে আছে।
পাহাড় আর পানির মাঝে তৈরী চীনের উদ্যানগুলোর শৈলী বৈশিষ্ট্যময়। এ সব উদ্যানের বিন্যাস নমনীয় আর পরিবর্তনশীল । তা ছাড়া এ সব উদ্যানে কৃত্রিম আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের শেল অকল্পনীয় সৌন্দর্য হিসেবে প্রকাশ পায়। এ সব উদ্যান স্থাপত্য সাধারণত পাহাড় আর পানির মধ্যে নির্মিত হয়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এ সব উদ্যানে পুরোপুরি প্রতিফলিত হয়।
চীনের উদ্যান স্থাপত্যগুলোতে সুমহান রাজকীয় উদ্যান আর ব্যক্তিগত উদ্যান অন্তভুর্ক্ত। এ সব উদ্যানে কৃত্রিম পাহাড় , ফুল, ঘাস , গাছ করিডোর প্রভৃতি ব্যবস্থা সুন্দরভাবে সাজিয়ে চিত্তাকর্ষক পরিবেশের সৃষ্টি করা হয়েছে যার প্রশংসা করে শেষ করা যায় না। চীনের উদ্যানগুলোকে উত্কর্ষের তিনটি পযার্য়ে বিভক্ত করা হয়। এই তিনটি পর্যায় হল প্রশাসন, দেবতা এবং প্রকৃতি।
চীনের লু তত্ত্বে যে বাস্তবতা, উচ্চ পর্যায়ের সামাজিক দায়িত্ববোধ , নৈতিক মূল্যবোধ আর রাজনৈতিক চিন্তাধারা উল্লেখ করা হয় তা উদ্যানের নকশায় প্রতিফলিত হয়। এটা সাধারণত রাজকীয় উদ্যানগুলোতে দেখতে পাওয়া যায়। বিখ্যাত রাজকীয় উদ্যান ইয়াংমিনইয়াং-এ অধের্ক দৃশ্যে এই উত্কর্ষের পর্যায় প্রতিফলিত হয়েছে।
দেবতা পর্যায় বলতে এই অর্থ বুঝায় যে, উদ্যান নির্মাণের সময় রোম্যান্টিক্স সৌন্দর্য হিসেবে গণ্য করা হয়, চীনের তাও পরিবার তত্ত্বে যে শান্তি , সুখ আর দু:খে নির্বিকার থাকার মনোভাব জোরদার করা হয়েছে তার চিন্তভাবনা চীনের রাজকীয় উদ্যানগুলোতে প্রতিফলিত হয়।যেমন ধরুন, ইয়াংমিনইয়াং উদ্যানের পংদাওইয়াওথাই , সিছুয়েন ছিংছেন সেনের গুছানদাওগুয়ান , হুবেই উদানসেনের নানইয়েনগন প্রভৃতি।
চীনের ইতিহাসের বিখ্যাত মানুষের নাম অনুসারে নির্মিত উদ্যানগুলোতে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিকে বেশী মনোযোগ দেয়া হয়। যেমন চীনের সোং রাজবংশের সুশেনছিনের ছানলান চৌকি, সিমাগুওয়াংয়ের দুলোইয়াং প্রভৃতি।
চীনের উদ্যান আর পাশ্চাত্যের উদ্যানের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে, পাশ্চাত্যের উদ্যান জ্যামিতি ও গণিতের মূলনীতির উপর জোর দেয় ও স্থাপত্যকেই প্রাধান্য দেয় আর চীনের উদ্যান প্রকৃতিক দৃশ্যাবলী ও দর্শকদের অনুভূতিকে প্রাধান্য দেয় এবং প্রাধান্য দেয় প্রকৃতি ও মানুষের ঐক্যের উপর।
সুচৌয়ের উদ্যান
১৯৯৭ সালে “ বিশ্বের উত্তরাধিকার সম্পত্তিগুলোর তালিকা”য় অন্তর্ভুক্ত সোচৌয়ের প্রাচীন উদ্যানগুলোতে কেন্দ্রীয়ভাবে চীনের উদ্যান স্থাপত্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। সুচৌয়ের উদ্যানের ইতিহাস দু’হাজার বছরেরও বেশি সময়ের। এপর্যন্ত দশ বারোটি বিখ্যাত উদ্যান সংরক্ষিত আছে। সুচৌয়ের বেশিভাগ উদ্যানের আয়তন ছোট। উদ্যানগুলোতে চীনের পাহাড়, পানি, ফুল ও পাখির মজা আর থাং রাজবংশ ও সুং রাজবংশের আমলে লেখা কবিতাগুলোর শৈল্পিক ভাবকে প্রাধান্য দিয়ে সীমিত পরিসরে কৃত্রিম পাহাড়, গাছপালা, প্যাভিলিয়ন, পুকুর ও সেতুর ব্যবস্থা করে অসীমিত শৈল্পিক রুপ করা হয়েছে। এর মধ্যে বিখ্যাত বিখ্যাত উদ্যান স্থাপত্যের মধ্যে রয়েছে ছান লান থিন, সি চি লিন, চুও চেন ইউয়ান, লিউ ইউয়ান ইত্যাদি।
(ছবি: সুচৌয়ের উদ্যানের একাংশ )
ইউয়ান মিন ইউয়ান
চীনের সবচেয়ে বিখ্যাত রাজ-উদ্যান, “ অযুত উদ্যানের মধ্যকার উদ্যান” বলে পরিচিত পেইচিংয়ের ইউয়ান মিন ইউয়ানের স্থাপত্যরীতিতে চীনের বিভিন্ন স্থানের বিভিন্ন রীতির উদ্যানশিল্পের সমাবেশ ঘটেছে এবং পাশ্চাত্যের আংশিক স্থাপত্যকর্মের স্থাপত্যরীতি আহরণ করা হয়েছে। উদ্যানের ভেতরের স্থাপত্যকর্মগুলো ছিলো খুবই সূক্ষ্মসুন্দর। ইউয়ান মিন ইউয়ান শুধু তখনকার চীনের সম্রাটের অস্থায়ী বসবাসের একটি সবচেয়ে সুন্দর রাজপ্রাসাদই ছিলো না, বরং ইউরোপেও এর বেশ খ্যাতি ছিলো। অষ্টাদশ শতাব্দীর ইউরোপের প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলীর উদ্যানের উন্নয়নের উপরও এটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিলো। ১৮৬০ সালে হানাদার বৃটেন ও ফ্রান্সের যুক্ত বাহিনী এই সুন্দর ইউয়ান মিন ইউয়ানকে পুড়িয়ে দিয়েছে।
ইয়াংমিনইয়াং উদ্যানের ধ্বংসাবশেষ পেইচিং শহরের পশ্চিম উপকন্ঠে অবস্থিত। সাধারণত ইয়াংমিনইয়াং উদ্যান বলতে এই উদ্যানের দুটো শাখা উদ্যান --ছানছুন আর ছিছুন (ওয়ানছুন উদ্যান) উদ্যান বুঝায়। সুতরাং এই উদ্যানকে ‘ইয়াংমিনইয়াং তিন উদ্যান’ নামে ডাকা হয়। এই উদ্যান ছিন রাজবংশে পেইচিং পশ্চিম উপকন্ঠে পাঁচটি উদ্যানের মধ্যে সবচেয়ে বড় আকারের উদ্যান। এই উদ্যানের আয়তন ৩৪৭ একর। এ পাঁচটি উদ্যান হল: শানসেন ছিনইইয়াং, ইউশিয়েসেন ছিনমিন ইয়াং, ওয়াসিওসেন ছিনছিইয়াং, ইয়াংমিইয়াং আর ছাছুন ইয়াং।
চীনের ছিন রাজবংশে ইওয়াংমিইয়াং তত্কালের সবচেয়ে বিখ্যাত রাজকীয় উদ্যান। রাজা ছিলন এই উদ্যানকে ‘ পৃথিবীর স্বর্গ, রাজাদের উপভোগের জায়গা’ আখ্যায়িত করেন। তা ছাড়া, বিদেশী মিশনারিদের বাণী, রিপোর্ট এবং বর্ণনার মাধ্যমে ইউরোপেও ইওয়াংমিইয়াং উদ্যানের সুনাম ছিল। সুতরাং ১৮ শতাব্দীতে ইউরোপের প্রাকৃতিক দৃশ্যসমৃদ্ধ উদ্যানগুলোর উন্নয়নে ইওয়াংমিইয়াং উদ্যানের অবদান ছিল।
|