মন্দির হলো চীনের বৌদ্ধধর্মের স্থাপত্যকর্মগুলোর অন্যতম। ভারতের মন্দির স্থাপত্যকর্ম থেকে এর উত্পত্তি। পেই ওয়েই রাজবংশের আমল থেকে চীনে এর বিকাশ শুরু হয়। এইসব স্থাপত্যকর্মে চীনের সামন্ততান্ত্রিক সমাজের সংস্কৃতির বিকাশ ও ধর্মের উত্থান-পতন লিপিবদ্ধ রয়েছে। এগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ও শৈল্পিক মূল্য রয়েছে।
স্থাপত্যকর্মের কাঠামোতে চীনের প্রাচীন লোকদের সুগভীর ইন-ইয়াং বিশ্বকোণ অর্থাত্ প্রকৃতিতে দুই বিপরীত শক্তি বিদ্যমান এই ধরণের ধারণা এবং সুসমঞ্জসতা, সুশৃংখলতা ও স্থিতিশীলতা পছন্দের নন্দনতত্ত্ব রয়েছে। তাই চীনের বৌদ্ধমন্দিরগুলো দক্ষিণদিক থেকে উত্তরদিক পর্যন্ত প্রসারিত কেন্দ্রীয় রেখার দুই দিকে সুসমঞ্জস স্থাপত্যকর্ম বিশিষ্ট সমতল চতুষ্কোণ, সংযত ও সুশৃংখল স্থাপত্যকর্মপুঞ্জ। তাছাড়া উদ্যান ধরণের স্থাপত্য-কাঠামোর বৌদ্ধমন্দিরও চীনে খুবই বেশি। এই দুই ধরণের শৈল্পিক কাঠামো চীনের মন্দিরগুলোকে যেমন সংস্কৃতিসম্পন্ন ও গাম্ভীর্যপূর্ণ করে তুলেছে, তেমনি অত্যন্ত প্রাকৃতিক রুচিসম্পন্নও করে তুলেছে। এর শৈল্পিকভাবে সুগভীর ও সুদূরপ্রসারী।
চীনের অধিকাংশ প্রাচীন মন্দিরের বিন্যাস এরকম: সম্মুখদিকের মাঝখানে পাহাড়ী গেট, পাহাড়ী গেটের ভেতরের বাম ও দক্ষিণদিকে যথাক্রমে ঘন্টা টাওয়ার ও ঢাক টাওয়ার । সম্মুখদিকে দেবতা প্রাসাদ, প্রাসাদে দাঁড়িয়ে আছে মন্দিরের প্রবেশদ্বারের চারজন স্বর্গীয় রক্ষকের মূর্তি। এরপর যথাক্রমে সাক্যমুনি প্রাসাদ ও ধর্মশাস্ত্রের গ্রন্হগুলো সংরক্ষণ হল। সম্মুখদিকের মাঝখানের বাম ও দক্ষিণ দুই দিকে যথাক্রমে সন্ন্যাসীদের আশ্রম ও তাদের খাবার ঘর। সাক্যমুনি প্রাসাদ হচ্ছে বৌদ্ধমন্দিরের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও বিশাল স্থাপত্যকর্ম।
লো ইয়াং শহরের পাই মা মন্দির
হান রাজবংশের আমলে নির্মিত হোনান প্রদেশের লো ইয়াং শহরের পাই মা মন্দির হলো চীন সরকারের সর্বাগ্রে নির্মিত বৌদ্ধমন্দির । প্রায় চল্লিশ হাজার বর্গমিটার জায়গা জুড়ে নির্মিত এই মন্দিরের আকার চারকোণা। পাই মা মন্দিরের নির্মাণ চীন আর পূর্ব এশিয়া ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়া অঞ্চলে বৌদ্ধধর্মের বিকাশকে বলিষ্ঠভাবে ত্বরান্বিত করেছে। তাই পাই মা মন্দির আজো অনেক দেশের বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের দর্শনের তীর্থস্থান।
উ থান পাহাড়ের বৌদ্ধ ধর্মের স্থাপত্য
শান শি প্রদেশের উ থান পাহাড় হচ্ছে চীনের বিখ্যাত বৌদ্ধ ধর্মীয় পবিত্র স্থান। পাহাড়ে সংরক্ষিত প্রাচীনকালের বৌদ্ধ ধর্মের স্থাপত্য আছে ৫৮টির বেশি। এর মধ্যে অপেক্ষাকৃত নামকরা মন্দির হচ্ছে থাং রাজবংশের নান ছেন মন্দির এবং ফো কুয়াং মন্দির। নান ছেন মন্দির হচ্ছে চীনের সংরক্ষিত সবচেয়ে প্রাচীনকালের একটি কাঠ দিয়ে তৈরি মন্দির স্থাপত্য। ফো কুয়াং মন্দিরের স্থাপত্য শৈলিতে চীনের বিভিন্ন যুগের স্থাপত্যের কৌশল মিশে আছে। মন্দিরটি তার স্থাপত্য, ভাবমূর্তি, দেয়াল ছবি এবং হস্তলিপির জন্য বিখ্যাত।
হেন শান পাহাড়ের সুয়েন খং মন্দির
সানসি প্রদেশের ভেতরের হেন শান পাহাড়ের সুয়েন খং মন্দিরও বেশ উল্লেখযোগ্য। এটি হলো শূন্যে স্থাপিত একটি মন্দির।এর উপরে বিপজ্জনক পাথর , নিচে গভীর খাদ। স্বতন্ত্র স্থাপত্যরীতির এই মন্দির খুবই বিরল স্থাপত্যকর্ম। হুয়েন ইউয়ান জেলা-শহরের সাড়ে তিন কিলোমিটার দক্ষিণের চিন লোং গিরিখাতের পশ্চিমদিকের খাড়া পাহাড়ের ঢালুতে অবস্থিত সুয়েন খং মন্দির হলো এপর্যন্ত চীনের সংরক্ষিত একমাত্র খাড়া পাহাড়ের ঢালুতে নির্মিত কাঠের তৈরি স্থাপত্যকর্ম। সুয়েন খং মন্দির হচ্ছে উত্তরচীননের হেন শান পাহাড়ের সর্বপ্রথম দর্শনীয় জায়গা। এটি নির্মিত হয় পেই ওয়েই রাজবংশের আমলে। থান, চিন , মিন ও ছিন রাজবংশের আমলে এটিকে মেরামত করা হয়।
পোতালা ভবন
লামাধর্ম হলো চীনের বৌদ্ধধর্মের একটি শাখা। লামাধর্মের মন্দির স্থাপত্যকর্মের বৈশিষ্ট হলো এই যে-বৌদ্ধপ্রাসাদ বিশাল, ধর্মগ্রন্হ সংরক্ষণ হল খুবই উঁচু এবং স্থাপত্যকর্ম নিম্ন ঢালুতে নির্মিত। তিব্বতের লাসায় অবস্থিত পোতালা ভবন আদর্শ লামাধর্মের মন্দির স্থাপত্যকর্ম। থান রাজবংশের আমলে নির্মিত পোতালা ভবন বিভিন্ন রাজবংশের আমলে মেরামত ও পুননির্মিত হওয়ার পর বিশাল স্থাপত্যকর্মপুঞ্জে পরিণত হয়েছে। পাহাড়ের নিম্ন ঢালুতে নির্মিত গোটা প্রাসাদ স্থাপত্যকর্ম উজ্জ্বল ও মহত্। তার মোট মেঝের আয়তন বিশ হাজার বর্গমিটারেরও বেশি । এর ভেতরে বিশের অধিক প্রাসাদ ও হল আছে। সামনের প্রাসাদে বারো বছর বয়সের সময়ের সাক্যমুনির হুবহু গিল্টি করা মূল্যবান তামার মূর্তি সংরক্ষিত আছে। পোতালা ভবনের স্থাপত্যরীতিতে যেমন আদর্শ থান রাজবংশের আমলের স্থাপত্যরীতি মিশে আছে, তমনি এতে নেপাল ও ভারতের স্থাপত্যের শৈল্পিক বৈশিষ্টও ধারন করা হয়েছে।
তাছাড়া ছেন তে শহরের “ ওয়েই পা মিয়াও” অর্থাত্ গ্রীষ্মাবাসের চারদিকের আটটি মন্দির ও পেইচিংয়ের ইউন হো প্রাসাদও বিখ্যাত লামাধর্মের স্থাপত্যকর্ম।
|