চীনে ২০টি সংখ্যালঘু জাতির লোকসংখ্যা
এক লক্ষের কম। তারা হল : পুলং
জাতি, তাজিক জাতি, আছাং জাতি,
ফুমি জাতি, ওউয়েনক জাতি, নু জাতি,
চিং জাতি, কিনো জাতি, তেআং জাতি,
পাওআন জাতি, রুশ জাতি, ইয়্যুকুও
জাতি, উজবেক জাতি, মেনপা জাতি,
ওরেনছুং জাতি, তুলুং জাতি, তাতার
জাতি, হেচে জাতি, কাওসান জাতি
আর লুপা জাতি।
লু পা জাতি
লু পা জাতির লোকসংখ্যা প্রায় ৩ হাজার । চীনে সংখ্যালঘুজাতিগুলোর মধ্যে তারা সবচেয়ে ছোট । তারা প্রধানতঃ তিব্বত স্বায়ত্ত শাসিত অঞ্চলের দক্ষিণ-পূর্বাংশে ছড়িয়ে আছে । মেথু জেলার উত্তরাংশে বসবাসকারী লু পা জাতির লোকেরা তিব্বতী ভাষা ব্যবহার করেন । এই জাতির অন্যান্য লোকেরা লু পা ভাষা ব্যবহার করেন । লু পা ভাষা হান-তিব্বত ভাষা ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত । ভিন্ন অঞ্চলে বসবাসকারী লু পা জাতির লোকদের আঞ্চলিক ভাষায় ব্যবধান আছে । লু পা শব্দটা তিব্বতী ভাষা থেকে এসেছে । তার অর্থ ‘দক্ষিণাংশের লোক’ । ১৯৪৯ সালে নয়া চীন প্রতিষ্ঠিত হবার আগে লু পা জাতির লোকেরা কাঠে খোদাই আর দড়িতে জড়ানোর পদ্ধতিতে বিগত স্মৃতি লিখে রাখতেন । তাদের স্বজাতির লিখিত ভাষা ছিলো না । সংখ্যালঘু লোকেরা তিব্বতী ভাষা জানতেন । নয়া চীন প্রতিষ্ঠিত হবার পর লু পা জাতির জনগণ বিভিন্ন জাতির সমতার অধিকার ভোগ করেন । দেশ আর বিভিন্ন জাতির ব্যাপক সমর্থনে তারা আধুনিকায়নের পথে চলেছেন এবং আর্থ- সাংস্কৃতিক অবস্থা দ্রুত প্রসারিত হয়েছে । লু পা জাতির লোকেরা পৃথিবীতে হাজার হাজার উদ্ভিদ আর প্রানীর আত্মা আছে এমন প্রাচীন ধর্ম বিশ্বাস করেন ।
তুলুং জাতি
তুলুং জাতির লোকসংখ্যা ৭ হাজার ৪শ’র বেশি। তারা ইউনান প্রদেশের কুংসান তুলুং জাতি ও নু জাতি স্বায়ত্তশাসিত জেলার তুলুংচিয়াং নদীর অববাহিকার উপত্যকা এলাকায় বাস করেন। তারা যে তুলুং ভাষা ব্যবহার করেন, তা হান-তিব্বতী ভাষার অন্তর্ভুক্ত। তাদের স্বজাতির নিজস্ব কোনও লিপি নেই। তাদের বিশ্বাস পৃথিবীতে সব কিছুতে আত্মা আছে। তারা প্রকৃতির প্রতি দারুন অনুগত । তুলুং জাতির সৃষ্টির নাম ইউয়ান রাজবংশের ইতিহাস সংক্রান্ত গ্রন্হের লিচিয়াং অঞ্চলের রীতিনীতি ধারায় দেখা যায়। তাকে “ছাও” বলে ডাকে। মিন আর ছিং রাজবংশে তাকে “ছ্যু” বা “ছ্যুয়ে” বলে ডাকে। নয়া চীন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তাদের স্বজাতির আশা আকাংক্ষা অনুসারে “তুলুং” নামটা গ্রহণ করা হয়েছে। আগে তুলুং জাতির সমাজে উত্পাদন শক্তি অত্যন্ত অনুন্নত ছিল। তারা প্রাচীনকালের কাঠ ও বাঁশ দিয়ে তৈরী সরল হাতিয়ার ব্যবহার করে জুম চাষ পদ্ধতির চাষাবাদ করতো। বন্য ফলমূল সংগ্রহ আর মত্স চাষ ও শিকার উত্পাদনের এক ধরনের পরিপূরকতা। ১৯৪৯ সালে নয়া চীন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তুলুং জাতির এই অনুন্নত অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। তুলুং জাতির লোকেরা পরিশ্রমী আর অতিথিপরায়ন। কারো বাড়িতে অসুবিধা হলে সকল গ্রামবাসীর সাহায্য পাওয়া যায়। শিকার করে যা পাওয়া যায়, তা ভাগাভাগি করার অধিকার সকল শিকারীর আছে। তারা বিশ্বাস ও বন্ধুত্বের উপর গুরুত্ব দেন এবং নিজেদের প্রতিশ্রুতি মেনে চলেন। তাদের সহজ-সরল নৈতিক বোধ আছে। “রাতে ঘুমানোর সময় ঘরের দরজা বন্ধ না করা আর পথে অন্যদের কিছু হারিয়ে গেলে, তা কুড়িয়ে না নেয়া” তো তুলুং জাতির অন্যতম ঐতিহ্য।
কিনো জাতি
কিনো জাতির লোকসংখ্যা ২০ হাজারের
কিছুটা বেশি। তারা প্রধানত :
দক্ষিণ পশ্চিম চীনের ইউননান প্রদেশের
সিসানপাননা বিভাগের একটি পাহাড়ের
উপরে বাস করেন। তারা যে কিনো
ভাষা ব্যবহার করে, তা হান-তিব্বতী
ভাষার অন্তর্ভুক্ত। তাদেরও স্বজাতির
লিপি নেই। পৃথিবীর সব কিছুতে
যে আত্ম আছে, কিনো জাতিও তা বিশ্বাস
করতো। তারা নিজেদের পূর্বপুরুষদের
সন্মান করে। কিনো শব্দটা তাদের
স্বজাতির নাম। কিনো জাতির উত্স-এর
ক্ষেত্রে কোনো লিখিত ভাষা নেই।
চু কে লিয়াং চীনের প্রাচীনকালের
একজন খুব নামকরা সামরিক উপদেষ্টা।
কিনো জাতির লোকেরা তাকে সন্মান
করেন। জানা গেছে, তারা চু কে
লিয়াংয়ের দক্ষিণ চীন সামরিক অভিযানের
একটি সৈন্যদল। তারা ফু এর, মে
চিয়াং এমন কি আরও দূরের উত্তর
চীন থেকে স্থানান্তরিত হয়েছেন।
নয়া চীন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর
কিনো জাতির লোকেরা প্রত্যক্ষাভাবে
আদিম সমাজের শেষ থেকে সমাজতন্ত্রে
প্রবেশ করেছেন। ফলে তারা আগে
যে আদিমকালের কৃষিকাজ করতেন,
বাঁশের পিঠে খোদাই করে’ যে প্রবন্ধ
লিখতেন, নিজের পণ্যের বদলে অন্যদের
পণ্য বিনিময় করার যে ব্যবসা করতেন
এবং রোগ দূর করার জন্য স্বর্গের
কাছে সাহায্য চেয়ে যে উপাসনা
করতেন, তা পুরোপুরি পরিবর্তিত
হয়েছে। বর্তমানে কিনো জাতির ক্যাডার,
ডাক্তার, ব্যবসায়ী আর কৃষি বিজ্ঞানী
ও প্রযুক্তিবিদরা সবাই দক্ষ হয়ে
উঠেছেন।
ঔ রেন ছুন জাতি
ঔ রেন ছুন জাতির লোকসংখ্যা
৮ হাজারের একটু বেশী। তারা
প্রধানত: অন্তমঙ্গোলিয়া স্বায়ত্ত
শাসিত অঞ্চল আর হেইলুংচিয়াং
প্রদেশের সংযোগস্থল --তাসিনআনলিং
আর সিয়াওসিনআনলিং পার্বত্য
এলাকায় থাকেন। অন্তমঙ্গোলিয়া
স্বায়ত্ত শাসিত অঞ্চলের হুরেনবেল
বিভাগের অধীনে ঔরেনছুন স্বায়ত্ত
শাসিত জেলা স্থাপন করা হয়।
ঔরেনছুন জাতি ঔরেনছুন ভাষা
ব্যবহার করে। তাদের ভাষা আরথাই
ভাষার অন্তর্ভুক্ত। তাদের স্বজাতির
লিখিত ভাষা নেই। তারা হান ভাষা
ব্যবহার করেন। ঔরেনছুন তাদের
জাতির নাম, মানে পর্বতের লোক।
চীনের ছিং রাজবংশের প্রথম দিকের
ঐতিহাসিক গ্রন্হে এই নাম দেখা
যায়। ঔরেনছুন লোকেরা দীর্ঘকাল
ধরে শিকারের উপর নির্ভর করে’
জীবনযাপন করেন। ফলমূল সংগ্রহ
আর মাছ ধরা তাদের জীবনযাপনের
প্রধান দু’টি উত্স। তাদের প্রায়
সকল পুরুষই শ্রেষ্ঠ অশ্বারোহী
এবং দক্ষ তীরন্দাজ। তারা নানা
বিধ বন্য প্রানীর স্বভাব ও
রীতিনীতি জানেন এবং শিকার করার
অভিজ্ঞতা তাদের আছে। গত শতাব্দির
চল্লিশের দশকেও তারা যে একটি
পশুপালনকারী জাতি, সে জাতির
মধ্যে আদিম কমিউনের চিহ্ন দেখা
যেতো। তারা যা শিকার করতেন,
তা তাদের উপজাতির মধ্যে মাথাপিছু
বন্টন করা হতো। বয়স্ক, দুর্বল,
আহত আর বিকলাঙ্গদের মধ্যে তারা
শিকার বন্টন করে দিতো। নয়া
চীন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ঔরেনছুন
জাতি সরাসরি সমাজতান্ত্রিক
সমাজে প্রবেশ করেছে। এখন তারা
নির্দিষ্ট বাসস্থানে থাকেন,
শিকারের কাজ ছেড়ে দিয়ে এবং
বন ও বন্য প্রাণীর রক্ষকে পরিনত
হয়েছেন। ঔরেনছুন জাতির লোকেরা
হস্তশিল্প তৈরী করায় পারদর্শী
তারা ব্যার্চ গাছের চামড়া কাজে
লাগিয়ে কাপড় চোপড়, জুতা, বক্স,
ঝুড়ি, টব এমন কি ব্যার্চ গাছের
চামড়া দিয়ে নৌকা, প্রভৃতি বৈচিত্র্যময়
হস্তশিল্প দ্রব্য তৈরী করতে
পারেন। এইসব দ্রব্যের উপর সন্দর
নকশা থাকে। এইসব দ্রব্য দেখতে
সুন্দর, হাল্কা আর ব্যবহারযোগ্য।
ঔরেনছুন জাতির লোকেরা সামান
ধর্মাবলম্বী। তারা প্রকৃতির
আনুগত্য করেন, পৃথিবীতে হাজার
হাজার পদার্থের যে আত্মা আছে,
তারা তা বিশ্বাস করেন এবং তারা
পূর্বপুরুষের প্রতি আনুগত্য
স্বীকার করেন।
তাতার জাতি
তাতার জাতির লোকসংখ্যা প্রায়
৫ হাজার । তারা সিনচিয়াং উইগুর
স্বায়ত্ত শাসিত অঞ্চলের ই নিন
, তাছেন , উরুমুচি প্রভৃতি
শহরে বাস করেন । তাদের ব্যবহৃত
তাতার ভাষা আলতায় ভাষা ব্যবস্থায়
অন্তর্ভুক্ত। কিছু সংখ্যক বৃদ্ধবৃদ্ধা
তাতার ভাষা ব্যবহার ছাড়া অন্য
লোকেরা সাধারণতঃ স্থানীয় কাজাখ
ভাষা আর উইগুর ভাষা ব্যবহার
করেন । আরবী অক্ষরের ভিত্তিতে
তাতার জাতির লিখিত ভাষার জন্ম
হয় । তবে এই দুই জাতির সংগে
একসাথে থাকা আর সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ
বলে এই দুই জাতির লিখিত ভাষা
তাতার জাতির প্রচলিত লিখিত
ভাষায় পরিণত হয়েছে । তাতার
জাতির বেশির ভাগ লোক ইসলাম
ধর্মে বিশ্বাস করেন । তাদের
পূর্বপুরুষরা উত্তর চীনের তাতারস্তান
নামে একটি উপজাতি থেকে এসেছেন
। ত্রয়োদশ শতাব্দিতে মঙ্গোলীয়
জাতি পশ্চাত্যে অভিযান চালানোর
সময় পশ্চিমারা তাদের তাতার
ডাকেন । উনবিংশ শতাব্দির প্রথম
দিক থেকে বেশ কিছু তাতার রাশিয়া
থেকে চীনের সিনচিয়াংয়ে স্থানান্তরিত
হয়ে চীনের তাতার জাতিতে পরিণত
হন । গ্রামে বসবাসকারী তাতার
জাতির লোকেরা প্রধানতঃ পশুপালনে
নিয়োজিত হন । এই জাতির মধ্যে
বুদ্ধিজীবিরা বিশেষ করে শিক্ষা
কর্মীরা সাধারণতঃ শহরে থাকেন
। তারা সিনচিয়াংয়ের শিক্ষা
উন্নয়নের জন্য উল্লেখযোগ্য
অবদান রেখেছেন ।
|