রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ১৯৭১ সালের ২ অক্টোবর চীন চীন-জাপান কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করার যে তিনটি নীতি উত্থাপন করেছে তা হলো , চীন গণ প্রজাতন্ত্র চীন প্রতিনিধিত্ব করার একমাত্র বৈধ সরকার , তাইওয়ান চীন গণ প্রজাতন্ত্রের এক পবিত্র আর অবিচ্ছেদ অংশ , জাপান-চিয়াং কাইশেক চুক্তি অবৈধ আর অকাযকর , তাই সেটি বাতিল করা উচিত । ১৯৭২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাপানের প্রধানমন্ত্রী তানাকা কাকুয়ে চীন সফর করেন । ২৯ সেপ্টেম্বর চীন আর জাপান সরকার যুক্ত বিবৃতি প্রকাশ করে এবং চীন জাপান কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক হয় ।
বর্তমানে দুদেশের সম্পর্কে সামনের দিকে এগিয়ে যাওযার প্রবনতা বজায় রয়েছে ।বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাস্তবনিষ্ঠ সহযোগিতা ইতিবাচক সাফল্য অর্জিত হয়েছে । কিন্তু অন্য দিকে জাপানের প্রধানমন্ত্রী জুনিচিরো কুইজুমি যে বারবার যুদ্ধ সমাধি ইয়াসুকুনিতে প্রার্থনা করেন তা বর্তমান চীন- জাপান রাজনৈতিক সম্পর্কের উপর প্রভাব বিস্তার করে এক প্রধান সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছে ।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চীন আর জাপান পরস্পরের গুরুত্বপূর্ণ বানিজ্যিক অংশিদার। জাপান গত দশ বছর ধরে চীনের বৃহত্তম বানিজ্যিক অংশিদার আর চীন জাপানের দ্বিতীয় বৃহত্তম বানিজ্যিক দেশ ও দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানীবাজারে পরিনত হয়েছে ।
বিজ্ঞান,শিক্ষা,সংস্কৃতি আর স্বাস্থ্যরক্ষার ব্যাপারে চীন-জাপান কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার পর দুপক্ষ বিজ্ঞান আর প্রযুক্তিগত সহযোগিতা সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেছে এবং ১৯৮০ সালের মে মাসে“ চীন-জাপান বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি সহযোগিতা চুক্তি ”স্বাক্ষর করেছে । এরপর দুদেশের বিজ্ঞান আর প্রযুক্তিগত আদান-প্রদান ও সহযোগিতা দ্রুতগতিতে বিকাশ লাভ করেছে এবং সম্প্রসারিত হয়েছে । যার ফলে সরকারী-বেসরকারী খাতে এক সঙ্গে বানিজ্যিক পরিবেশ গড়ে তোলা হয়েছে ।
১৯৭৯সালের ৬ ডিসেম্বর চীন আর জাপানের মধ্যে স্বাক্ষরিত “চীন-জাপান সংস্কৃতি আদান-প্রদান চুক্তিতে দুদেশের সংস্কৃতি,শিক্ষা, প্রযুক্তি,ক্রীড়া প্রভৃতি ক্ষেত্রে আদানপ্রদান স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে । ২০০২ সালে দুদেশের সরকার “চীনা সংস্কৃতি বছর ” আর “জাপান সংস্কৃতি বচর ” আয়োজনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে । তাছাড়া দুদেশ “চীন-জাপান-দক্ষিণ কোরিয়া কিশোরকিশোরী গ্রীস্মকালীন শিবির”, “চীন-জাপান-দক্ষিণ কোরিয়া টেলিভিশন জ্ঞান যাচাইপ্রতিযোগিতা” আর “ চীন-জাপান অর্থনীতি ফোরাম” প্রভৃতি তত্পরতার আয়োজন করেছে ।
বর্তমানে চীন-জাপান সম্পর্কের ক’টি স্পর্শকাতর বিষয়ের উপর নজর দেওয়া দরকার তা হলো :
প্রথমত: ইতিহাসের জ্ঞান-সমস্যা । এটা চীন-জাপান সম্পর্কের স্পর্শকাতর রাজনৈতিক সমস্যা । ২০০১ সাল থেকে এপযন্ত একটানা এমন সব ঘটনা ঘটেছে যে ,জাপান ইতিহাসের বাস্তবতা উপেক্ষা করে ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তকের সংশোধন করেছে,জাপান কর্তৃক চীন আক্রমন করার ঐতিহাসিক ঘটনা বিকৃত করেছে , জাপান প্রধানমন্ত্রী জুনিচিরো কুইজুমি ইয়াসুকুনি যুদ্ধসমাধিতে প্রার্থনা করেন । এইসব চীন-জাপান সম্পর্কে গুরুতর প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে ।
দ্বিতীয়ত:তাইওয়ান সমস্যা । জাপান-তাইওয়ান সম্পর্কে চীনপক্ষের অধিষ্ঠান স্পষ্ট। তা হলো, জাপান আর তাইওয়ানের মধ্যে যে বেসরকারী সফর বিনিময় হয় চীন তার বিরোধিতা করে না , কিন্তু তাদের মধ্যকার যে কোনও রকমের সরকারী সফর বিনিময় অথবা দুই চীন বা এক চীন এক তাইওয়ান সৃষ্টির দৃঢ়-বিরোধিতা করে এবং জাপান পক্ষের উদ্দেশে স্পষ্ট ভাষায় জাপান-মার্কিন নিরাপত্তা সহযোগিতার আওতায় তাইওয়ান অন্তর্ভুক্ত না করার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার দাবী জানায় ।
তৃতীয়ত:তিয়াওইয়ু দ্বীপ সমস্যা । তিয়াওইয়ু দ্বীপপুন্জ চীনের তাইওয়ান প্রদেশের কিলোং শহর থেকে ৯২ মাইল উত্তরপূবের পূব সাগরের জলসীমায় অবস্থিত। তাইওয়ান দ্বীপের অধীনস্থ দ্বীপ , প্রধানতঃ তিয়াওইয়ু দ্বীপ , হুয়াংউই দ্বীপ, ছিউই দ্বীপ,ক্ষুদ্রদক্ষিণ দ্বীপ আর ক্ষুদ্র উত্তর দ্বীপ এবং কয়েকটি জলের পাহাড় নিয়ে তিয়াওইয়ু দ্বীপপুন্জ গঠিত হয় । তিয়াওইয়ু দ্বীপপুন্জ প্রাচীনকাল থেকেই চীনের ভূভাগ,তাইওয়ানের মতোই সেগুলোও চীনের ভূভাগের এক অবিচ্ছেদ অংশ । তিয়াওইয়ু দ্বীপপুন্জ আর আশেপাশে জলসীমার উপর চীনের অবিসংবাদিত সার্বভৌমত্ব আছে ।
আমাদের এই অধিষ্ঠানের ঐতিহিসিক ও আইনগত যুক্তি আছে । ১৯৪৩ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-বৃটেনের “কায়রো ঘোষনা”অনুসারে জাপান উত্তর-পুব, তাইওয়ান,ফোংহু দ্বীপপুন্জ সহ জাপানকে তার কেড়ে নেওয়া চীনের ভূভাগ চীনকে ফেরত দেবে । ১৯৪৫ সালের “বোগিতান ইস্তাহার”অনুযায়ী“কায়রো ঘোষনার শর্তাবলী বাস্তবায়িত হবেই । একই সালের আগষ্ট মাসে জাপান "বোগিতান ঘোষনা” গ্রহন করে শর্তবিহীনভাবে আত্মসমর্পন ঘোষনা করেছে , এর অর্থ হলো জাপানকে তাইওয়ান আর তার অধীনস্থ তিয়াওইয়ু দ্বীপপুন্জ চীনের কাছে ফেরত দিতে হবে ।
চতুর্থত: জাপান-মাকিন নিরাপত্তা সহযোগিতা সমস্যা ।১৯৯৬সালে জাপান আর যুক্তরাষ্ট্র “নিরাপত্তা সহযোগিতার যুক্ত ঘোষনা “প্রকাশ করেছে এবং এর ভিত্তিতে ১৯৭৮সালে প্রণিত “ প্রতিরক্ষা সহযোগিতার পথনির্দেশক “ সংসোধন করতে শুরু করেছে । ১৯৯৭ সালের সেপ্টেম্বরে জাপান আর যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার নতুন নীতি স্থির করেছে । ২০০৪ সালের ২৪ মে জাপান সংসদে জাপান-মার্কিন প্রতিরক্ষা সহযোগিতার নতুন নীতির প্রাসঙ্গিক বিল গৃহিত হয় , এতে স্থির হয়েছে , জাপান আর যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা সহযোগিতা জোরদার করার নতুন ব্যবস্থা মোটামুটি সম্পন্ন হয়েছে । এ ব্যাপারে চীনের লক্ষ্যবস্তু হলো তাইওয়ানজনিত সমস্যা আর জাপানের সামরিক দিক । এপর্যন্ত চীন নানান পদ্ধতিতে উদ্বেগ ও সংশ্লিষ্ট অধিষ্ঠানের কথা ব্যক্ত করেছে ।
পঞ্চমত:যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ সমস্যা ।১৯৭২ সালে চীন- জাপান কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়া সম্পর্কে বৈঠক চলাকালে জাপান সরকার স্পষ্টভাষায় অতীত যুদ্ধে চীনা জনগনের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধনের জন্য গভীর দুঃখ এবং অনুতাপ প্রকাশ করে ।এই পূর্বশর্তে দেশের মৌলিক স্বার্থের জন্য চীন সরকার জাপানের কাছে যুদ্ধের ক্ষতিপুরণ দাবী পরিত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং ১৯৭২ সালে দুদেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত “চীন-জাপান যুক্ত বিবৃতিতে ”সিদ্ধান্তটি লিপিবদ্ধ করেছে । ১৯৭৮ সালে চীনের পঞ্চম জাতীয় গণ কংগ্রেসের স্ট্যান্ডিং কমিটির তৃতীয় অধিবেশনে অনুমোদিত “ চীন-জাপান শান্তিপূর্ণ বন্ধুত্ব চুক্তি”আবার আইনগত দলিল হিসেবে যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ পরিত্যাগ করার সিদ্ধান্তটিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
ষষ্ঠতম: চীনে জাপনের পরিত্যাক্ত রাসায়নিক অস্ত্র সমস্যা ।চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় জাপান প্রকাশ্যে আন্তর্জাতিক চুক্তি লংঘন করে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করায় বিপুল চীনা সামরিক আর বেসামরিক লোক বিষক্রিয়ায় মারা যান । যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর জাপানীবাহিনী বিপুল পরিমান রাসায়নিক অস্ত্র ঘটনাস্থলে স্থাপন করে রেখে গেছে । এপর্যন্ত চীনের দশ-বারোটি প্রদেশ,শহর আর স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের ত্রিশাধিক জায়গায় জাপানের পরিত্যাক্ত রাসায়নিক অস্ত্র পাওয়া গেছে । গত অর্ধ শতাব্দীর ঝড়-বৃষ্টির ফলে এই সব অস্ত্রে সাংঘাতিকভাবে মরিচা পড়েছে এবং মাঝেমাঝে সেগুলোর ভেতর থেকে বিষাক্ত গ্যাস বেরু হয়ে আসে । ফলে চীনা জনগনের জীবন আর সম্পদের নিরাপত্তা এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ গুরুত্বর হুমুকীর সম্মুখীন হয় । গত শতাব্দীর আশির দশকের শেষ দিকে চীন সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে জাপান সরকারের কাছে সমস্যাটি সমাধানের দাবী জানায় । ১৯৯৯ সালের ৩০ জুলাই চীন আর জাপান সরকার পেইচিং-এ “ চীনের ভেতরে জাপানের পরিত্যাক্ত রাসায়নিক অস্ত্র ধ্বংস করা সম্পর্কে স্বারকলিপি ” স্বাক্ষর করেছে । এতে জাপান সরকার “ চীন-জাপান যুক্ত বিবৃতি ” আর “ চীন-জাপান শান্তিপূর্ণ মৈত্রী চুক্তির” মর্ম মনে রাখার কথা ব্যক্ত করেছে এবং সমস্যাটি সমাধানের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছে , “রাসায়নিক অস্ত্র নিষিদ্ধকরন চুক্তিতে” নির্ধারিত সময়ে ধ্বংস করার দায়িত্ব পালন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে । বর্তমানে দুদেশের সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ “স্বারকলিপি”এর মর্ম অনুসারে কিভাবে দ্রুত সম্ভব জাপানের পরিত্যাক্ত রাসায়নিক অস্ত্র ধ্বংস করা যায় তা নিয়ে বিস্তারিত আলাপ
আলোচনা করছে ।