কূটনীতির রূপরেখা


  ১৯৪৯ সালে চীন গণ প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর চীন কূটনৈতিক ক্ষেত্রে এক নতুন অধ্যায় সংযোজন করে ।

  ১৯৪৯ সাল থেকে গত শতাব্দীর ৫০ দশকের শেষ দিক পর্যন্ত চীন সোভিয়েত ইউনিয়ন সহ প্রতিটি সমাজতান্ত্রিক দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে এবং বন্ধুত্ব ও সহযোগিতামূলক সম্পর্ক জোরদার করেছে। ১৯৫৫ সালে ইন্দোনেশিয়ায় বান্দোং আফ্রো-এশিয় সম্মেলনের পর বেশ ক’টি দেশ চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে । ১৯৫৬ সালে চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা দেশের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিলো ২৫ ।

  গত শতাব্দীর ৫০ থেকে ৬০ দশকের সময়পর্বে চীন পরপর গিনি, ঘানা,মালি, কঙ্গো,তান্জানিয়া প্রভৃতি দেশের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তির পাশাপাশি অর্থনৈতিক কারিগরি সহযোগিতা চুক্তিও স্বাক্ষর করে , অ্যাঙ্গোলা,গিনিবিসাও,মোজান্বিক,জিম্বাবুয়ে , নামিবিয়া প্রভৃতি দেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য চালিত সশস্ত্র সংগ্রাম এবং দক্ষিণ আফ্রিকান জনগণের বর্ণবাদবিরোধী সংগ্রাম সমর্থন করেছে । অন্যদিকে মায়ানমার ,নেপাল, মঙ্গোলিয়া, আফগানিস্তানের সঙ্গে দীর্ঘ দিনের সীমান্ত সমস্যা সমাধান করে সীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করেছে । পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের সিনচিয়াং এবং পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলগুলোর মধ্যকার সীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করেছে । ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে প্রবাসী চীনাদের দ্বি –জাতীতত্ত্যের সমস্যা সমাধান করেছে । ১৯৬৯ সালে চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হওয়া দেশের সংখ্যা দাঁড়ায় ৫০-এ ।

  ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাস ছিলো নয়া চীনের কূটনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষন । সে সময় ব্যাপক উন্নয়নমুখী দেশগুলোর সমর্থনে ২৬তম জাতিসংঘ সাধারন পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে ২৭৫৮নং প্রস্তাব গৃহিত হয়েছে, সে প্রস্তাবে জাতিসংঘে চীন গণ প্রজাতন্ত্রের যাবতীয় বৈধ অধিকার পুনরুদ্ধার হয় এবং কুওমিনতাং চক্রের প্রতিনিধিকে জাতিসংঘ ও তার সবক’টি সংস্থা থেকে বাদ দেওয়া হয় । এরপর চীন অধিকাংশ পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলে । যার ফলে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার তৃতীয় ধাপ সফল হয় ।

  গত শতাব্দীর ৭০ থেকে ৮০ দশকের শেষ সময়পর্বে তেন সিয়াওপিংয়ের কূটনীতির চিন্তাধারার পথ-নির্দেশে চীন মার্কিন যুক্ত রাষ্ট্র, জাপান,পশ্চিম ইউরোপের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক উন্নয়ন করেছে , সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি করেছে, সাবির্কভাবে তৃতীয় দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করেছে । আশেপাশের দেশগুলো এবং ব্যাপক উন্নয়নমুখী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি করেছে । সুষ্ঠুভাবে হংকং সমস্যা আর ম্যাকাও সমস্যা সমাধানের জন্য চীন বৃটেন আর পর্তুগালের সঙ্গে কূটনৈতিক আলোচনার পর যথাক্রমে ১৯৮৪ সালের ডিসেম্বর মাসে বৃটেনের সঙ্গে আর ১৯৮৭ সালের এপ্রিল মাসে পর্তুগালের সঙ্গে যুক্ত বিবৃতি প্রকাশ করে স্বীকৃতি দিয়েছে যে, যথাক্রমে ১৯৯৭ সালের ১ জুলাই আর ১৯৯৯ সালের ২০ ডিসেম্বর হংকং আর ম্যাকাওতে গণ প্রজাতন্ত্রী চীন সরকার পুনরায় নিজের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা শুরু করবে ।  

  গত শতাব্দীর ৯০ দশক থেকে কমরেড চিয়াং জেমিনকে নিয়ে গঠিত চীনের তৃতীয় প্রজন্মের নেতৃমন্ডলী সৃজনশীলভাবে তেন সিয়াওপিংয়ের কূটনৈতিক চিন্তাধারা অনুসরণ করে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র শান্তিপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি অবলম্বন করে, সক্রিয়ভাবে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পঞ্চশীল নীতির ভিত্তিতে বিশ্বের বিভিন্ন উন্নয়নমুখী দেশগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্ব আর সহযোগিতামূলক সম্পর্ক উন্নয়নের প্রচেষ্টা চালিয়েছে এবং মিলিতবাবে আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও অর্থনীতির নুতন শৃঙখলা প্রতিষ্ঠার ব্রতকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে । এর পর ইন্দোনেশিয়ার সংগে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনরুদ্ধার হয়েছে ,সিঙ্গাপুর ,ভ্রুনেই আর দক্ষিন কোরিয়ার সঙ্গে কুটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা হয়েছে এবং ভিয়েতনাম ও মঙ্গোলিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়েছে ।

  ১৯৯৬ সালে চেয়ারম্যান চিয়াং জেমিন দক্ষিণ এশিয়ার তিনটি দেশ সফর করেন । এই সফরের পর সিদ্ধান্ত হয় পর চীন ও ভারত একবিংশ শতাব্দীর উপযোগী গঠনমূলক অংশীদারীত্বের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করবে ,চীন ও পাকিস্তান একবিংশ শতাব্দীর উপযোগী সার্বিক সহযোগিতামূলক অংশিদারিত্বের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করবে , চীন ও নেপাল যুগযুগ ধরে বন্ধুত্ব আর সুপ্রতিবেশিসুলভ অংশিদারিত্বের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করবে ।চীন সক্রিয়ভাবে এশিয়া, আফ্রিকা আর ল্যাটিন আমেরিকা এবং পূর্ব ও মধ্য ইউরোপীয় দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক সম্প্রসারন করেছে ।সাহারার দক্ষিণাঞ্চলের আফ্রিকান দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক আরও সুসংবদ্ধ ও জোরদার হয়েছে । চীন আর ল্যাটিন আমেরিকার মধ্যেকার সম্পর্ক ক্রমাগত সম্প্রসারিত করেছে । আমাদের চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপিত ল্যাটিন আমেরিকান দেশের সংখ্যা বেড়ে ১৯ হয়েছে ।যে দেশগুলো চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেনি সেই দেশগুলো চীনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার কথা বিবেচনা শুরু করেছে ।

  মানবজাতি নতুন শতাব্দীতে প্রবেশ করেছে , এর প্রধান নিদর্শন হলো , বিশ্বের বহুমেরুকরন , অর্থনীতির বিশ্বায়ন অনবরতভাবে বিকাশলাভ করেছে, লোকসংখ্যার দিক থেকে চীন বিশ্বে বৃহত্তম উন্নয়নমুখী দেশ । চীনের উন্নয়ন যেমন বিশ্বকে বাদ দিয়ে হবে না তেমনি বিশ্বের উন্নয়ণেও চীনকে প্রয়োজন । শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পঞ্চশীল নীতির ভিত্তিতে সকল দেশ আর অঞ্চলের সঙ্গে সহযোগিতা করে মিলিতভাবে উন্নতি লাভ করবে বলে চীন আন্তরিকভাবে আশা করে ।