পুতালা প্রাসাদ

       

      পুতালা প্রাসাদ চীনের তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের লাসা শহরের কেন্দ্রের হংসেন পাহাড়ে অবস্থিত। গোটা স্থাপত্য পাহাড়ে নিমির্ত হয়। দেখতে সুমহান। এই প্রাসাদকে ‘ বিশ্বের ছাদের মুক্তা’ বলা হয়। পুতালা প্রাসাদ যেমন তিব্বতী জাতির স্থাপত্য শিল্পকলার শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি তেমনি চীনের বিখ্যাত প্রাচীন স্থাপত্যগুলোর অন্যতম।  

      পুতালা প্রাসাদ তিব্বতের ভিবিন্ন প্রজম্মের দালাইলামাদের রাজনৈতিক, ধমীর্য় তত্পরতা চালানো আর থাকার জায়গা ছিল। বতর্মানে এটা হল তিব্বতে সংরক্ষিণ বৃত্তম প্রাচীনকালের উচু তলার স্থাপত্য। ঐতিহাসিক তথ্য থেকে জানা গেছে, ষষ্ঠ শতাব্দীতের টুফেন রাজবংশের সনজেনগানবু সময়পর্বে পুতালা প্রাসাদের নিমার্ন কাজ শুরু হয়। তখন তাকে হংসেন প্রাসাদ বলা হত। পুতালা প্রাসাদের আকার বিরাট। প্রাসাদের বাইরে তিনটি দেয়াল এবং প্রাসাদের ভিতরে হারাজাধিক ঘর আছে। এটা ছিল টুফান রাজবংশের রাজনৈতিক কেন্দ্র। নবম শতাব্দীতে টুফান রাজবংশ ভেংগে যায়। তখন থেকে তিব্বত দীর্ঘকালের যুদ্ধে নিমজ্জীত। হংসেন প্রাসাদও ধীরে ধীরে পরিত্যক্ত হয়।

      ১৬৪৫ সাল থেকে পঞ্চম প্রজম্মের দালেইলামার শাসনকালে পুতালা প্রাসাদের নিমার্ন কাজ আবার শুরু হয়। প্রায় ৫০ বছর ধরে এই নির্মান কাজ চলে থাকে। পরে তিন শতাধিক বছরে প্রাসাদের অন্যান্য নিমার্ন প্রকল্প চলে থেকে। পুতালা প্রাসাদ ১৩ তলার স্থাপত্য। তার উচ্চতা ১১০ মিটার। পুতালা প্রাসাদের গোটা কাঠামো পাথর আর কাঠের তৈরী। প্রাসাদের দেয়াল সবই পাথর দিয়ে তৈরী করা হয়। দেয়ালের সবচেয়ে পুরু অংশ প্রায় ৫ মিটার। গোটা স্থাপত্য ভূকম্প প্রতিরোধের ক্ষমতা বাড়ানোর জন্যে দেয়ালের ভিতরে লোহার রস পূর্ণ করা হয়। এই প্রাচীনকালের উচু তলার স্থাপত্য বজ্র থেকে রক্ষা করার জন্যে প্রাসাদের ছাদে লোহা জাতীয় অলঙ্গকরণ সামগ্রী লাগানো হয়। কয়েক শো বছর ধরে পুতালা প্রাসাদ বজ্রের আঘাত আর ভূমিকম্পের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এখনওপযর্ন্ত অক্ষতভাবে দাঁড়িয়ে আছে। পুতালা প্রাসাদের প্রধান অংশ হল, পূর্বাংশের সাদা প্রাসাদ( দালেইলাম থাকার জায়গা), মধ্য অংশের লাল প্রাসাদ ( বুদ্ধ আর নানা প্রজম্মের দালেইলামার মুর্তি রাখার জায়গা), সন্যাসিরা পশ্চিমাংশের সাদা রংয়ের ঘরগুলোতে থাকেন। লাল প্রাসাদের সামনে একটি সাদা রংয়ের উঁচু দেয়াল আছে যেখানে বুদ্ধ ধর্মীয় উত্সবে বুদ্ধ মূর্তি সেলাই-করা গালিচা ঝুঁলানো হয়। অনেক স্থাপত্য ভিন্ন সময় নিমার্ন করা হয়, কিন্তু পাহাড়ী ভুবৈচিত্রের সুবাদে গোটা প্রাসাদ সুন্দরভাবে নিমির্ত হয়েছে। বাইরের দিক থেকে দেখলে প্রাসাদ খুব সুমহান। স্থাপত্য শিল্পকলার সৌন্দর্যশাস্ত্রের সাফল্য একটি উচু মানে উন্নীত হয়। লাল প্রাসাদ হল গোটা স্থাপত্য সংগ্রহশালার প্রধান অঙ্গ । এটা প্রাসাদে নানা প্রজম্মের দালেইলামাদের মারনিন হল(mourning hall) এবং বুদ্ধ মূর্তি রাখার জায়গা। পঞ্চম প্রজম্মের দালেইলামা সেনচাছুর মারনিন টাওয়া সবচেয়ে যত্নভাবে বানানো হয়েছে। মারনিন হলের টাওয়ার(mourning tower) উচ্চতা ১৫ মিটার। টাওয়ার ভিত্তি, টাওয়ার অঙ্গ আর টাওয়ার ছাদ এ তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়। পঞ্চম প্রজম্মের দালেইলামার মৃত্যু দেহ সুগন্ধি আর লোধ্র ফল দিয়ে টাওয়ার দানে সংরক্ষিত হয়। টাওয়ার অঙ্গ সোনা দিয়ে জড়ানো হয়। মোট ৩৭২৪ কিলোগ্রাম সোনা ব্যবহার করা হয়। তা ছাড়া, এক হাজার ৫ শোরও বেশি মূল্যবান হীরা, লাল আর সবুজ মুক্তা ইত্যাদি খচিত করা হয়। ধমীর্য় তত্পরতায় ব্যবহৃত নানা ধরনের যন্ত্রপাতি আর পূজা অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত নানা ধরণের যন্ত্রপাতি এই টাওয়া দেহে রাখা হয়। পশ্চিম প্রাসাদ হল পঞ্চম প্রজম্মের দালেইলামারমারনিন হলের(mourning hall)একটি ঘর। এটা হল লাল প্রাসাদের সবচেয়ে বড় প্রাসাদ।এই প্রাসাদে ৪৮টি বড় স্তম্ভ আছে। প্রাসাদের উচ্চতা ৬ মিটারও বেশী।স্থাপত্যে হান জাতির স্থাপত্যে ব্যবহৃত আচ(arch) কাঠামো গ্রহণ করা হয়। তা ছাড়া, স্থাপত্যগুলোতে অজস্র কাঠের তৈরী বুদ্ধ-মূর্তি, সিংহ আর হাতি ইত্যাদি নানা ধরণের প্রাণী খোদাই করা হয়। ১৭ শতাব্দীতে পুতালা প্রাসাদের নির্মান এবং পরবর্তীকালের সম্প্রসারণ কাজে তিব্বত অঞ্চলের শ্রেষ্ঠ চিত্রশিল্পীরা হাজার হাজার সূক্ষ্ম দেয়াল চিত্রাঙ্কন রচনা করেন।প্রসাদেরছোট-বড় ঘরগুলো, হল, করিডর ইত্যাদি জায়গায় দেয়াল চিত্রাঙ্কন আঁকা হয়। এ সব দেয়াল চিত্রাঙ্কনের বিষয় বৈচিত্রময় বিষয়বস্তু সমৃদ্ধ। এগুলোর মধ্যে কোন কোন ঐতিহাসিক গল্প, কোন কোন বুদ্ধ শাস্ত্র গল্প ।তা ছাড়া, স্থাপত্য, রীতিনীতি, ক্রীড়া, বিমোদন ইত্যাদি দৈনিক জীবন সম্পর্কিত বিষয়ও দেয়াল চিত্রাঙ্কনে দেখা যায়। এ সব পুতালা প্রাসাদে উচু মূল্যবান শিল্পকলা।

      তা ছাড়া, পুতালা প্রাসাদে ১৭ শতাব্দীর পর থেকে দশ হাজারের কাছাকাছিএবং ব্যাপক পরিমাণে পাথর ভাষ্কর্য , কাঠের ভাস্কর্য এবং মাটির ভাষ্কর্যইত্যাদি সংরক্ষিত হয়।এতে শুধু যে উচ্চ মানের শিল্পকলার মূল্য প্রতিফলিত হয়েছে তাই নয় হাজারাধিক বছর ধরে হান আর তিব্বতি জাতির মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সফর বিনিময় এবং সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের সুদীর্ঘ ইতিহাসও প্রতিফলিত হয়। ‘ বিশ্বের ছাদের উজ্জ্বল মুক্তা’ হিসেবে পুতালা প্রাসাদের বিন্যাস, নির্মান প্রকল্প, ধাতু আর ধাতুকে গলান, চিত্রাঙ্কন , ভাষ্কর্য ইত্যাদি বিশ্ববিখ্যাত। এতে তিব্বতী জাতি সহ হান, মন আর ম্যান জাতির সেরা মিস্ত্রিদের দক্ষ প্রকৌশল এবং তিব্বতী জাতির স্থাপত্য শিল্পকলার মহান সাফল্য প্রতিফলিত হয়েছে। ১৯৯৪ সালে ইউনেস্কো আনুষ্ঠানিকভাবে পুতালা প্রাসাদ সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার হিসেবে ‘বিশ্ব উত্তরাধিকা তালিকায়’ অন্তভূর্ক্ত করেছে।