যদি আপনি পেইচিং ভ্রমণের সুযোগ পান তাহলে আপনাকে মহা প্রচীর, রাজ প্রাসাদ , শ্রীষ্মকালীণ প্রাসাদ, তিয়েন থাইন দশর্নীয়স্থান যেতেই হবে। কারণ তারা চীনের প্রাচীন কালের স্থাপত্যের সবোর্চ্চ মানের প্রতিনিধিত্ব করে। তিয়েন থাইন হচ্ছে বতর্মানে চীনে সংরক্ষিত সবচেয়ে অক্ষত আর সবচেয়ে বড় আকারের পূজা স্থাপত্যের সংগ্রশালা। শস্যের জন্যে অনুকূল আবহাওয়া, জনসাধারণের জন্যে শান্তি আর সুস্থ্য কামনা করার জন্যে চীনের নানা যুগের সম্রাটরা প্রত্যেক বছর বিশেষ পূজা অনুষ্ঠান পালন করে। এ সব অনুষ্ঠানের মধ্যে স্বর্গের কাছে পূজা করার অনুষ্ঠান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। চীনের রাজা ‘স্বর্গের ছেলে’ বলে মনে করা হয়। রাজারা ‘স্বর্গের ছেলে’ হিসেবে জনসাধারণকে শাসন করেন এবং দেশকে পরিচালনা করেন। স্বর্গ পূজা করার অনুষ্ঠান তাদের বিশেষ অধিকারে পরিণত হয়। সাধারণ মানুষের এই অধিকার ছিল না।
১৪২০ সালে তিয়েন থাইনের নিমার্ণ কাজ শুরু হয়। এখানে (১৩৬৮-১৯১১) দু’ প্রজম্মের রাজা তুনিয়া আর স্বর্গ পূজা করেন। তিয়েন থাইন পেইচিংএর বিখ্যাত নিষিদ্ধ নগরের ( রাজ প্রাসাদ) দক্ষিণ দিকে অবস্থিত। তার আয়তন নিষিদ্ধ নগরের চাইতে চার গুণ বেশী। তিয়েন থাইনের দক্ষিণ দিকের দেয়াল গোল আকারের , তা তুনিয়ার প্রতীক। সবচেয়ে উত্তর দিকের দেয়াল সেমি গোল আকারের, তা স্বর্গের প্রতীক। প্রাচীনকালের চিন্তাভাবনার প্রভাবে এই স্থাপত্যের নকশা হয়। প্রাচীনকালের ধারণা ‘ স্বর্গ গোল এবং পৃথিবী চতুর্ধার’ । তিয়েন থাইনে ভিতর আর বাইরের অংশ ভাগ করা হয়। তিয়েন থাইনের প্রধান স্থাপত্য ভিতরেরএবং দক্ষিণ-উত্তর দুটো প্রত্যন্তে কেন্দ্রভূত হয়। দক্ষিণ থেকে উত্তর পযর্ন্ত স্থাপত্য আছে: ইয়ানছি্ও, হুয়াংছুনইউ, ছিনিয়েন থিয়েন। ইয়ানছিও একটি তৃতল স্থাপত্য। প্রত্যেক তলায় পাথের সিলিং ঘেরা হয়। এই গোল প্ল্যাথর্ফমে রাজারা স্বর্গ পূজা করতেন। স্বর্গ পূজা বরার অনেক নিয়ম ছিল। সাধারণত প্রত্যেক বছরের চান্দ্র বর্ষের মাসের ডংজি অথার্ত ২২ ডিসেম্বর মাসের ভোরের আগে এই পূজার অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। রাজা নিজেই এটি পূজা অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন। অনুষ্ঠান পালিত হওয়ার সময় এই প্ল্যাফোর্মের সামনে বড় বড় লন্ঠন ঝুলানো হয়। লন্ঠনের ভিতরে এক মিটাররেওবেশী লম্বা মোমবাতি জ্বালানো হয়। এই ভবনের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে এক সারি বিশিষ্ট ধুপ জ্বালানোর উনান বসানো হয়। স্বর্গ পূজা করার সময় এ সব উনানে নানা ধরণের উত্সগীকৃতবস্তু জ্বলানো হয়। স্বর্গ পূজার সম্পূর্ণ প্রক্রিয়ায়আকাশে ধূপের ধোঁয়া পাক খায়, ঢাক আর সংগীত যন্ত্রের আওয়াজ মখরিত হয়। তখন পরিবেশ অত্যন্ত গভীর। ইয়ানছিও ভবনেরউত্তর দিকের হুয়াংছুন ইউ একটি গোল আকারের এক তলা ছোট প্রাসাদ। এই ছোট প্রাসাদে স্বর্গ পূজা করার বোর্ড রাখা হয়। হুওয়াংছুন ইউর চার দিকে বেষ্টিত একটি গোল দেয়াল আছে। এই হল বিখ্যাত ধ্বনি প্রতিফলন দেয়াল। এই দেয়াল একটি অত্যন্ত রহস্যময় দেয়াল। যদি আপনি দেয়ালের এক দিকে নিম্ন স্বরে কথা বলেন তাহলে অন্য দিকে আপনার কথা ষ্পষ্টভাবে শোনা যায়।
তিয়েন থাইনের আরেকটি গ্রুপের পূজার স্থাপত্য হল ছিনিয়েন তিয়েন। এটা হল একটি তিন ছাঁইচের গোল ভবণ। তিন তলার গোল পাথরের প্ল্যাথর্ফমে এই ভবণ নিমির্ত হয়। অক্ষ থেকে বুঝা যায়, ছিনিয়েন তিয়েন হল প্রত্যেক শ্রীষ্মকালে রাজারা ভাল ফসল কামনা করার জায়গা। সুতরাং এই ভবন কৃষির সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত। যেমন, ভবনের চারটি বিরাট স্তম্ভ বসন্ত, শ্রীষ্ম, শরত এবং শীতের প্রতিনিধিত্ব করে।চীনের পূর্বপুরুষরা এক দিনে ১২টি পযার্য়ের সময় ভাগ করেন বলে প্রথম তলার ছাঁইচ দাঁড়িয়ে করা ১২টি স্তম্ভ ১২টি পযার্য়ের সময়ের প্রতীক। মধ্য তলার ১২টি স্তম্ভ ১২ মাসের প্রতীক, এক সঙ্গে মিলে ২৪টি স্তম্ভ। এ থেকে বুঝা যায়, চীনের চান্দ্র বর্ষে ২৪টি ঋতু আছে। তিয়েন থাইনে ইয়ানছিও আর ছিনিয়েন তিয়েন এ দু’টো প্রধান স্থাপত্য ছাড়া, পশ্চিম দ্বারে অবস্থিত বিনোদ ভবন আর উত্সর্গ কক্ষ যেখানে নতর্ক আর নতর্কি এবং পূজায় ব্যবহৃত প্রাণী চাষ করার ব্যক্তিদের থাকার জায়গা।
তিয়েন থাইনের নিমার্নে চীনের প্রাচীনকালের স্থপত্যশিল্পীদের অতুলনীয় সৃষ্টি শক্তি প্রতিফলিত হয়। যেমন স্থাপত্যের রং প্রয়োগে বিরাট অগ্রগতি অর্জিত হয়। চীনের রাজ প্রাসাদের স্থাপত্যগুলোতে প্রধানত: হলুদ রংয়ের লিওলি টালি ব্যবহার করা হয় । হলুদ রং রাজার ক্ষমতার প্রতীক। তবে তিয়েন থাইনের স্থাপত্যে আকাঁশের রং—নীল রং ব্যবহার করা হয়। নীল রং স্থাপত্যের প্রধান রং হিসেবে ব্যবহার করা হয়। যেমন ধ্বনি প্রতিফলন দেয়ালের ছাদ, হুওয়াংছুন ইউ, ছিনিতিয়েনের ছাঁইচ এবং এ দুটো স্থাপত্যের চারপাশের উদ্যানের ছাদে নীল রং লিওলি টালি লাগানো হয়। ১৯৮৮ সালে তিয়েন থাইন ‘বিশ্ব উত্তরাধিকার তালিকায়’ অন্তর্ভুক্ত। তিয়েন থাইনের প্রতি বিশ্ব উত্তরাধিকার কমিশনের বর্ণনা হল: ‘ বতর্মানে সংরক্ষিতচীনের প্রাচীনকালের বৃহত্তম পূজার স্থাপত্য সংগ্রহশালী হিসেবে তিয়েন থাইনের স্থাপত্যের কাঠামো সুবিন্যাস্ত এবং বৈশিষ্ট্যময় বলে বিশ্ববিখ্যাত। এটা শুধু যে চীনের স্থাপত্য ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করেছে তাই নয়, বিশ্ব স্থাপত্য শিল্পকলার মূল্যবান উত্তরাধিকারও বটে।
|