ছিন শিহুয়াং সমাধিস্থান আর সৈনিক ও ঘোড়ার মূর্তির যাদুঘর

       চীনের পশ্চিমাঞ্চলের সিআন শহরেঅবস্থিত ছিন শিহুয়াং সমাধিস্থান হল পৃথিবীর এমন একটি সম্রাট সমাধিস্থান যার আকার সবচেয়ে বড়, কাঠামো সবচেয়ে অদ্ভূত এবং সারমর্ম সবচেয়ে সমৃদ্ধ। ছিন শিহুয়াংএর সঙ্গে কবর-দেওয়া গর্তগুলোর অন্যতম হিসেবে সৈনিক ও ঘোড়ার মুর্তি গর্ত মিসরের ভিরামিজের মতো সুনাম আছে। তাকে বিশ্বের অষ্টম বিস্ময় বলে গণ্য করা হয়। ছিন শিহুয়াং ( খৃষ্টপূর্ব ২৫৯ থেকে খৃষ্টপূর্ব ২১০ ) চীনের সামন্ততান্ত্রিক সমাজের প্রথম সম্রাট। চীনের ইতিহাসে তিনি একজন বিতর্কিত ব্যক্তি। ছিন শিহুয়াং প্রথম সম্রাট যিনি চীনকে ঐক্যসাধন করেন। সমাজের অথর্নীতি , সাংস্কৃতিক বিকাশ তরান্বিত করার জন্যে তিনি ধারাবাহিক পদক্ষেপ নেন। যেমন, মুদ্রা, ভাষার শব্দ , মাপ আর ওজনের মানদন্ড ঐক্যসাধন করেন। এর সঙ্গে সঙ্গে উত্তরাঞ্চলের সংখ্যালঘু জাতির আক্রমন থেকে রক্ষা করার জন্যে তাঁর নিদের্শে মহা প্রাচীর নিমার্ন করা হয়। এ সব ব্যবস্থা বাস্তবায়িত হওয়ার ফলে ছিন শিহুয়াং চীনের ইতিহাসে একজন বিখ্যাত রাজনীতিবিদে পরিণত হন। অন্য দিকে ছিন শিহুয়াং খুব নিষ্ঠু এবং তাঁর জীবন খুব বিলাসী। জনসাধারণের চিন্তাভাবনা নিয়ন্ত্রন করা জন্যে তিনি তাঁর শাসনের বিরুদ্ধে বইগুলো আগুনে পুড়ে দেন , এমনকি চিন্তাভাবনা আর ভিন্ন মতামত সম্পন্ন পন্ডিতদের জীবিত অবস্থায় ববর দেন। যাতে তাঁর ছিং রাজবংশের শাসন রক্ষা করা হয়। তা ছাড়া, তাঁর শাসনকালে তিনি যাতে বিলাসী জীবন যাপন করতে পারেন, সেই জন্যে তিনি বিপুল অংকের অর্থ দিয়ে নিজের সমাধিস্থান এবং বিলাসী প্রাসাদ নিমার্ন করেন। দেশ ঐক্যসাধনের অল্প সময পর তিনি তাঁর সমাধিস্থান নিমার্ন করতে শুরু করেন।৭ লক্ষ লোক তাঁর সমাধিস্থান নিমার্নের কাজে অংশ নেয়, তাঁর সমাধিস্থান সম্পন্ন করতে ৪০ বছর লেগেছিল। তাঁর মৃত্যু পযর্ন্ত এই সমাধিস্থানের প্রকল্প শেষ হয়নি। ছিন শিহুয়াং সমাধিস্থান চীনের সেনশি প্রদেশের উপকন্ঠের লিসেন পাহাড়ে অবস্থিত। সমাধিস্থানের আয়তন ৫৬ বর্গমিটার। সমাধিস্থানের নিম্ন অংশ গোল আকারের। দক্ষিণ-উত্তর ৩৫৯ মিটার লম্বা, পুর্ব-পশ্চিম ৩৪৫ মিটার প্রন্থ, উচ্চতা ৭৬ মিটার। গোটা সমাধিস্থান দেখতে ভিরামিজের মতো। চীনের প্রত্নত্ত্ববিদরা অনুসন্ধানের সময় উদ্ধার করেছিলেন, সমাধিস্থানের চার পাশে আরও ৫০০টি সমাধিস্থান আছে। এ সব সমাধিস্থানে প্রাসাদের ব্যক্তি এবং সমাধিস্থান নিমার্নকারীদেরকে তাঁর সঙ্গে কবর দেয়া হয়। এ সব সমাধিস্থানের মধ্যে রয়েছে, ছিন শিহুয়াং গাড়ী চড়ার প্রতীক তামার তৈরী ঘোড়া গড়ীর কবর, প্রাসাদের ঘোড়ার আস্তাবলের প্রতীক ঘোড়ার আস্তাবল কবর এবং ছিন রাজবংশ আমলের শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর প্রতীক সৈনিক ও ঘোড়ার মূর্তির কবর ইত্যাদি ইত্যাদি। ছিন শিহুয়াং সমাধির সৈনিক ও ঘোড়ার মূর্তিকে বিশ্বের অষ্টম বিস্ময় বলা হয়। অপ্রত্যাশিত উপলক্ষে এই বিস্ময় উদ্ধার করা হয়।

    ১৯৭৪ সালে স্থানীয় কৃষক কুয়া খনন করার সময় বিপুল পরিমাণের চীনমাটি উদ্ধার করেন। কৃষকরা খুব একটা খেয়াল করেননি। তিনি এ সব চীনামাটি ফেলতে চেয়েছিলেন । একজন পুরাকীর্তি সংরক্ষণ ব্যক্তি সরাজমিনে ছিলেন। তিনি এ সব চীনামাটি দেখার পর উপলদ্ধি করলেন এটা হল একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্ধার। তিনি সঙ্গে সঙ্গে জেলার পুরাকীর্তি ব্যুরোর্ কমর্কতার্দের রিপোট করলেন। এর পর বিশ্ব-কাঁপানো ছিন রাজবংশের সৈনিক ও ঘোড়ার মূতির্ খখন করা হয়। বতর্মানে এ সব মুর্তির মধ্যে ৫০০টি হলো সৈনিকের মুর্তি, ১৮টি হলো কাঠের গাড়ী এবং ১০০টি হলো ঘোড়ার মুর্তি। এ সব সৈনিকের শরীরর গঠন বিরাট, তাদের গড়পড়তা ১ দশমিক ৮ মিটারের কাছাকাছি। তাদের শরীরের গঠন অত্যন্ত প্রাণবন্ড, তাদের ভঙ্গী নানা ধরণের। এতে ছিং রাজবংশ আমলের ভাষ্কর্যের প্রকৌশল মান প্রতিফলিত হয়েছে। ছিং রাজবংশের সৈনিক ও ঘোড়ার মুর্তি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জনগণের সাদার লাভ পেয়েছে। এই সৈনিক ও ঘোড়ার মুর্তি দেখার জন্যে অনের বিদেশী পযর্তক হাজার হাজার মাইল পথ অতিক্রম করাকেতুচ্ছ জ্ঞান করেছেন। কয়েকটি দেশের শীর্ষ নেতা চীন সফর করা সময় ছিং রাজবংশের এই সৈনিক ও ঘোড়ার মুতির্ জাদুঘর দেখার অনুরোধ করেন। প্রাক্তন মাকির্ন প্রেসিডেন্ট রোনালট রেগান প্রশংসা করে বললেন, ছিং রাববংশের সৈনিক ও ঘোড়ার মুতির্ হলো মানব জাতির মহান বিস্ময়। পুরাকীর্তির সংরক্ষণ কারিগরির কারণে এবং চীন সরকার ছিন শিহুয়াং সমাধিস্থান আরও সুন্দরভাবে রক্ষা করার জন্যে সম্প্রতি চীনসরকারের ছিন শিহুয়াংএর প্রধান সমাধি খনন করার পরিকল্পনা নেই। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ছিন শিহুয়াংএর সঙ্গে কবর দেওয়া সমাধিতে ৫০ হাজারাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক পুরাকীর্তি খনন করা হয়েছে। এ সব পুরাকীর্তির মধ্যে তামার ঘোড়া গাড়ী সহ দুষ্প্রাপ্য মূল্যবান জিনিস রয়েছে। ১৯৮০ সালে চীনের প্রত্নতত্ত্ববিদরা তামার ঘোড়ী গাড়ী উদ্ধার করেন। এই গাড়ীর প্রধান অংশ তামার তৈরী, কিন্তু কয়েকটি অংশ সোনা আর রোপ্য অলংকার। গাড়ীর নানা ধরণের অংশ যন্ত্রপাতি দিয়ে একই শিল্পকলা সম্পূর্ণ করে। তামার ঘোড়া গাড়ী সুক্ষ্মভাবে তৈরী করা হয়। তার আকার আসল গাড়ীর দ্বিতীয়াংশ। গাড়ীগুলো আসল গাড়ী অনুশীলন করে তৈরী করা হয়। এতে ষ্পষ্টভাবে ছিন শিহুয়াং গাড়ী চড়ার ভঙ্গী প্রতিফলিত হয়। এ সব সমাধির সারমর্ম আর চীনের ইতিহাস বইতে লিপিবন্ধ তথ্য থেকে বুঝা যায় ছিন শিহুয়াং সমাধি ঠিকই তখন ছিং রাজবংশের প্রতিফলন। তিনি ভাবছিলেন যে তাঁর মৃত্যুর পর ছিং রাজবংশের শাসন অব্যস্থ থাকে।কিন্ত তাঁর মৃত্যু হওয়ার তিন বছর পর কৃষদের অভ্যত্থার্নে ছিং রাজবংশ উত্খাতন করা হয়। তবে চীনের সম্রাট সমাধিগুলোর মধ্যে এই সমাধির আকার সবচেয়ে বিরাট, সবচেয়ে বেশী মূল্যবান জিনিস লুকিয়ে রাখা হয়। এই দু’হাজারাধিক বছরের সমাধিস্থান চীনের ইতিহাসের ‘প্রত্যক্ষদর্শীতে পরিণত হয়েছে। ছি শিহুয়াং সমাধিস্থানের বিরাট ঐতিহাসিক মূল্য পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৮৭ সালে ছিন শিহুয়াং সমাধিস্থান আর সৈনিক ও ঘোড়ার মূর্তি ইউনেস্কোর বিশ্ব সংস্কৃতি উত্তরাধিকার তালিকায় অন্তভুর্ক্ত হয়েছে।