১৯৯৭ সালে চীনের উত্তরাঞ্চলের শানসি প্রদেশের পিনয়াও প্রাচীন নগর ‘বিশ্ব উত্তরাধিকার’ তালিকাভুক্ত হয়। বিশ্ব উত্তরাধিকার কমিটির বনর্না হল: পিনয়াও প্রাচীন নগর হচ্ছে চীনে সবচেয়ে সুন্দরভাবে সংরক্ষিত প্রাচীন নগর। চীনের ইতিহাসের উন্নয়নে এই প্রাচীন নগর একটি অসাধারণ সংস্কৃতি, সমাজ , অর্থনীতি আর ধর্ম উন্নয়নের সম্পূর্ণ চিত্র সক্রোল প্রকাশ পেয়েছে।
|
(
ছবিতে সুমহান পিনয়াও প্রাচীন নগরের দেওয়াল
) |
খৃষ্টপূর্ব নবম শতাব্দীর কাছাকাছি সময় পিনয়াও প্রাচীন নগরের নিমার্ন কাজ শুরু হয়। গোটা নগর চথুর্ধার , আয়তন মাত্র ২.২৫ বর্গমিলোমিটার। বতর্মান পিনয়াও প্রাচীন নগরের প্রধান স্থাপত্য আর কাঠামো ৬০০ বছর আগে মোটামুটি সম্পন্ন হয়। সম্প্রতি দেওয়াল, সড়ক, বসতবাড়ী, দোকানপাট , মন্দির ইত্যাদি স্থাপত্য মোটামুটি অক্ষতভাবে সংরক্ষিত রয়েছে। এ থেকে প্রতিপন্ন হয়েছে , এতে গত কয়েক হাজার বছরে চীনের হান জাতির ঐতিহ্যিক সংস্কৃতি মনোভাব প্রতিফলিত হয়েছে। এই প্রাচীন নগর হচ্ছে চীনের মিন আর ছিন (১৩৬৮-১৯১১)সময়পর্বের স্থাপত্য শিল্পকলার ঐতিহাসিক জাদুঘর।
২৮০০ বছর আগে পিনয়াও প্রাচীন নগরের দেওয়ালের নিমার্ন কাজ শুরু হয়। তখন মাত্র একটি মাটির তৈরী দেওয়াল ছিল।১৩৭০ সালে মাটির তৈরী দেওয়াল ইট আর পাথরের তৈরী দেওয়াল পরিবর্তিত হয়। পরে দেওয়াল অবিরাম সুসংবদ্ধ করা হয়। এখন পযর্ন্ত প্রাচীন নগরের দেওয়াল আগের মতো সংরক্ষিত আছে।
পিনয়াও প্রাচীন নগরের দেওয়ালের মোট দৈর্ঘ্য ছ’হাজারাধিক মিটারের , তার উচ্চতা ১২ মিটার।দেওয়াল দেখতে কচ্ছপের মতো।মোট ছ’টি দেয়ালের দ্বার আছে। দক্ষিণ আর উত্তর দিকে যথাক্রমে একটি, পূর্ব আর পশ্চিম দিকে যথাক্রমে দুটো।দক্ষিণ দ্বার হল কচ্ছপের মাথা, দ্বারের সামনে দুটো কুয়া কচ্ছপের দুটো চোখের প্রতীক। উত্তর দ্বার হল কচ্ছপের লেজু। দেয়ালের উত্তর দিকের জায়গা গোটা নগরের সবচেয়ে নীচু জায়গা। দেয়ালের ভিতরে জমা-থাকা সমস্ত পানি এখান থেকে বয়ে যায়। চীনের ঐতিহ্যিক সংস্কৃতিতে কচ্ছপ দীর্ঘ বায়ুর প্রতীক। দেয়ালের আকার থেকে বুঝা যায়, চীনের পূর্ব পুরুষরা মঙ্গল প্রাণী কচ্ছপ দিয়ে পিনয়াও প্রাচীন নগর মজবুদ আর দীর্ঘকালে সংরক্ষণের কামনা করেন।
|
(
ছবিতে পিনয়াও প্রাচীন নগরের মিন আর ছিন আমলের বাণিজ্য সড়ক
) |
এই রুদ্ধ প্রাচীন নগরে সোজা দক্ষিণ-উত্তর বিস্তীর্ণ সড়ক। ছোট-বড় গলিগুলো গোটা নগরে ছড়িয়ে পড়ে। গোটা নগরের বিন্যাস সুশৃংখল ।
পিনয়াও প্রাচীন নগরের বসতবাড়ীগুলো সবই নীল রংয়ের ইট আর কাল রংয়ের টালি দিয়ে তৈরী চক মেলানো বাড়ী।স্থাপত্যের বিন্যাস অত্যন্ত উপযোগী। প্রত্যেকটি বাড়ী দেয়াল ঘেরা হয়। দেয়ালের উচ্চতা ৭-৮ মিটার। পিনয়াও প্রাচীন বসতবাড়ীর বৈশিষ্ট্য এই যে, বাড়ীঘরের প্রধান ঘরে চীনের উত্তর-পশিচমাঞ্চলের গুহা বসতবাড়ীর শৈলী সংরক্ষিত হয়। স্থাপত্যে যে সুক্ষ্ম কাঠের ভাষ্কর্য , ইঁটের ভাষ্কর্য এবং জানালায় লাগানো কাগজের কাটা দেখা দিয়েছে তাতে গ্রামাঞ্চলের প্রগাঢ় আমেজ প্রতিফলিত হয়েছে। বতর্মানে পিনয়াও প্রাচীন নগরে চাঁর হাজারাধিক সাধারণ বসতবাড়ী সংক্ষরিত আছে যাদের মধ্যে বেশীর ভাগ চীনের মিং আর ছিং রাজবংশ আমলে নিমির্ত হয়। চাঁর শতাধিক জায়গা চমত্কারভাবে সংরক্ষিত রয়েছে। এ পযর্ন্তপিনয়াও প্রাচীন নগরের বসতবাড়ীগুলো চীনের হ্যান জাতি অধ্যুষিত অঞ্চলের সবচেয়ে অক্ষতভাবে সংরক্ষিত প্রাচীনকালের বসতি এলাকা।
বতমার্নে পিনয়াও প্রাচীন নগরের ছ’টি বড় মন্দিরের সংগ্রহশালা এবং সড়কের দু’পাশের দোকানপাট সবই ঠিকই অতীতের মতো সংরক্ষিত রয়েছে। বাড়ীঘরের ছাদে হলুদ আর সবুজ রংয়ের লিওলি টালি এবং কালো ইটের বসানো ঘরের মেঝেতে শ্রেণীরপ্রতীক দেখানো হয়। এ সব প্রাচীনকালের স্থাপত্যে পুরোপুরি আর ষ্পষ্টভাবে মিং আর ছিং রাজবংশ আমলের শহুরে দৃশ্য দেখা দিয়েছে।
পিনয়াও প্রাচীন নগরে অজস্র পুরাকীর্তী আছে। যেমন নগরের উত্তর-পূর্ব দিকের জেগু মন্দিরের উয়েনউ হল বতর্মানে চীনের তৃতীয় পুরাতন কাঠের তৈরী স্থাপত্য। এই হলের ইতিহাস এক হাজারাধিক বছরের। হলে দশম শতাব্দী সময়পর্বের রঙীন ভাষ্কর্য চীনের পূবর্কালীণ রঙীন ভাষ্কর্য গবষণার নমুনা। প্রাচীন নগরের সওয়াংলিন মন্দির ষষ্ঠ শতাব্দীতে নিমির্ত হয়। এই মন্দিরের দশাধিক হলে মোট দু’হাজারাধিক মাটির ভাষ্কর্য মুক্তি ত্রয়োদশ থেকে সপ্তবিংশ শতাব্দীতে বানানো হয়। এ সব মুক্তিকে ‘ চীনের প্রাচীনকালের মাটি ভাষ্কর্য শিল্পকলার মূল্যবান ভান্ডার’বলে আখ্যয়িত হয়।
|
(ছবিতে পিনয়াও প্রাচীন নগরের পুরাতন টাকা বিনিময়ের কেন্দ্র---রেসেনছাং বিনিময় কেন্দ্রের পুরাতন স্থান) |
চীনের আধুনিক ব্যাংকিং ইতিহাসে পিনয়াও প্রাচীন নগরের বিশেষ স্থান আছে। ১৮২৪ সালে পিনযাওতে চীনের প্রথম টাকা বিনিময় কেন্দ্র ‘ রেসেনছাং ‘ প্রতিষ্ঠিত হয়। মানিআওডার মাধ্যে নগদ টাকা পরিশোধের ঐতিহাসিক ব্যবস্থা পরির্বতিত হয়। এর পর, সারা চীনে ‘ রেসেনছাং-এর’ ব্যবসা ছড়িয়ে পড়ে। আস্তে আস্তে এর ব্যবসা জাপান, শিংগাপুর এবং রাশিয়া প্রভৃতি দেশগুলোতে চালু হয়। তখন এই বিনিময় কেন্দ্রকে ‘ পৃথিবীর এক নম্বর’ বিনিময় কেন্দ্র বলে আখ্যয়িত হয়। ‘রেসেনছাং’-এর প্রভাবে পিনয়াওয়ের মানিআওডার(money order) বিনিময়ের ব্যবসা দ্রুত বিকাশিত হয়। এক সময় এখানে মোট ২২টি বিনিময় কেন্দ্র ছিল। চীনের মানিআওডার(money order) মোট সংখ্যার অধের্ক পিনয়াওয়ে ছিল। তখন পিনয়াও চীনের ব্যাংকিং কেন্দ্রে পরিণত হয়।
বতর্মানে পিনয়াও প্রাচীন নগরের পশ্চিম সড়ক ঠিক শতাধিক আগের ‘ ব্যাংকিং সড়ক’। এখনও এই পশ্চিম সড়কের দু’পাশে একের পর এক দোকান আছে। এ সব দোকানের ব্যবসা খুব ভাল। এ সব দোকান বেশ বড় নয়, কিন্তু এ সব পান্ডববজির্তএবং জীর্ণ দোকান অতীতে বিরাটাকার এবং দেশ-বিদেশ বিখ্যাত ব্যাংকিং কেন্দ্র ছিল।
প্রাচীনকালের পিনয়াও বহিষ্ণু ছিল, আজকের পিনয়াও এখনও আকর্ষনপূর্ণ। একটি প্রাচীন দেয়াল নতুন যুগের পিনয়াও জেলা নগর বিভক্ত করেছে। মনে হয় দেয়ালের দু’পাশে দুটো তুনিয়া। দেয়ালের ভিতরের সড়ক, দোকানপাট এবং বাড়ীঘর ছ’শ বছর আগের আকার সংরক্ষিত আছে। কিন্তু দেয়ালের বাইরে ‘ নতুন নগর’ বলা হয়। এটা হল প্রাচীন আর আধুনিক স্থাপত্যের মিশ্র জায়গা। চিত্তাকর্ষনীয় জায়গাও বটে।
|