কনফুসিয়াসের মন্দির, কনফুসিয়াসের ভবন, কনফুসিয়াসের সমাধিস্থান

      কনফুসিয়াসের মন্দির, কনফুসিয়াসের ভবন, কনফুসিয়াসের সমাধিস্থান বিশ্বের সবচেয়ে মহান দশর্নবিদগুলোর অন্যতম এবং চীনের লু বিদ্যা দলের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর স্মৃতিতে নিমির্ত ‘কনফুসিয়াসের মন্দির , কনফুসিয়াসের ভবন আর কনফুসিয়াসের সমাধিস্থান’ হচ্ছে দু’ হাজারাধিক বছর ধরে কনফুসিয়াস আর লু তত্ত্বের প্রতি চীনের বিভিন্ন আমলের সম্রাট শ্রদ্ধা তর্পনের প্রতীক। চীনের ইতিহাস আর বিশ্বের প্রাচ্য সংস্কৃতিতেকনফুসিয়াসের অবস্থান লক্ষ্যনীয়।

  কনফুসিয়াসের মন্দির , কনফুসিয়াসের ভবন আর কনফুসিয়াসের সমাধিস্থানতাঁর জন্মস্থান অথার্ত চীনের পূর্বাঞ্চলের শানতুং প্রদেশের ছুইফু শহরেঅবস্থিত।  

  কনফুসিয়াসের মন্দিরকে ‘ চীনের প্রথম মন্দির’ হিসেবে গণ্য করা হয়। এই মন্দির হল চীনের বৃহত্তম কনফুসিয়াসকে পূজা করার গুরুত্বপূর্ণ স্থান। খৃষ্টপূর্ব ৪৭৮ সালে কনফুসিয়াসের মৃত্যু হওয়ার পরের দ্বিতীয় বছর লু রাজ্যের রাজা কনফুসিয়াসের বসতবাড়ী মন্দিরে পরিণত করেন। এর ভিতরে কনফুসিয়াসের কাপড়-চোপড় আর অন্যান্য জিনিসপত্র রাখা হয়। প্রত্যেক বছর লোকেরা ওখানে কনফুসিয়াসকে পূজা করতে যান। প্রথম দিকে কনফুসিয়াসের ভবনে মাত্র তিনটি ঘর ছিল। পরে কনফুসিয়াসের প্রতিষ্ঠিত লু দলের সংস্কৃতি ধীরে ধীরে চীনের ঐতিহ্যিক সংস্কৃতিতে পরিণত হয়। বিভিন্ন আমলের রাজা এই মন্দির সম্প্রসারিত করেন। যার ফলে কনফুসিয়াসের ভবন একটি বিরাটাকারের স্থাপত্যের সংগ্রহশালায় পরিণত হয়। আটারো শো শতাব্দীর প্রথম দিকে ছিন রাজবংশের রনসেন রাজা কনফুসিয়াসের ভবনে বড় সংস্কার চলানোর নিদের্শ দেন। বতর্মানে লোকেরা যে কনফুসিয়াসের ভবন দেখেছেন তার আকার রনসেন রাজার শাসনকালে প্রতিষ্ঠিত হয়।  

  কনফুসিয়াসের ভবনের দক্ষিণ-উত্তর বিস্তীর্ণ দৈর্ঘ্য এক হাজারাধিক মিটার। আয়তন প্রায় এক লক্ষ বর্গমিটার। ভবনে প্রায় ৫০০টি ঘর আছে। তার বতর্মান আকার পেইচিং রাজকীয় প্রাসাদের সংগ্রহশালীর চাইতে একটু ছোট। কনফুসিয়াসের ভবনকে চীনের প্রাচীনকালেরবিরাটাকারের মন্দির স্থাপত্যগুলোর আদর্শ বলে মনে করা হয়।  

   চীনের সামন্ত সমাজের সবোর্চ্চ স্থাপত্যের শৈলী অথার্ত রাজকীয় প্রাসাদের স্থাপত্যের শৈলী অনুশীলন করে কনফুসিয়াসের মন্দির নিমির্ত হয়। তার প্রধান স্থাপত্য একটি দক্ষিণ-উত্তর অক্ষরেখাতে নিমির্ত হয়। অতিরিক্ত স্থাপত্যগুলো প্রধান স্থাপত্যের বাম আর দাম দিকে সুবিন্যস্তভাবে নিমির্ত হয়। কনফুসিয়াসের মন্দিরের ভিতরে নয়টি পূজার ঘর আর নয়টি উদান আছে। প্রধান পূজার ঘরের ভিতরে আবার নয়টি ছোট ঘর আছে। নয় নম্বর হল একক অঙ্কের সবচেয়ে বড় নম্বর। চীনের সামন্ত সমাজে নয় অঙ্ক রাজার বিশেষ ব্যবহৃত অঙ্ক, বিশেষ করে স্থাপত্যে রাজা ছাড়া কেউ নয় অঙ্ক ব্যবহার করতে পারে না। যদি কেউ নয় অঙ্ক ব্যবহার করে তাকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হত।তবে কনফুসিয়াসের মন্দিরের ব্যতিক্রম ছিল। কনফুসিয়াসের মন্দিরের প্রধান পূজার কক্ষের সামনে পাঁচটি দরজা নিমির্ত হয়। সামন্ত সমাজের নিয়ম অনুযায়ী, কেবল রাজকীয় প্রাসাদের স্থাপত্যে পাঁচটি দরজা নিমার্ন করা যায়। যেমন পেইচিং রাজকীয় প্রাসাদে পাঁচটি দরজা আছে। 

  কনফুসিয়াসের মন্দিরের কেন্দ্র স্থাপত্য ডাজেন হলের উচ্চতা ৩০ মিটার, পূর্ব-পশ্চিম প্রন্থ পন্চাশেরও বেশী মিটার। ভবনের ছাদ চকচকে সৌনালি টালিতে আচ্ছন্ন হয়। দেখতে পেইচিংএর রাজকীয় প্রাসাদের তেইহো ভবনের মত সুমহান। এই ভবনকে ‘চীনের তিনটি বড় প্রাচীন প্রাসাদগুলোর’ অন্যতম হিসেবে গণ্য করা হয়। ডাজেন হলের্ সবচেয়ে আকর্ষণীয় জিনিস হল হলের সামনের দশটি ড্রাগন-বেষ্টিত পাথরের স্তম্ভ। এ দশটি স্তম্ভের উচ্চতা যথাক্রমে ৬ মিটার। প্রায় এক মিটার ব্যাস পাথর দিয়ে এই স্তম্ভ খোদাই করা হয়। এই ভাষ্কর্য অন্তত্য সুক্ষ্ম। এ দশটি স্তম্ভের ড্রাগনের আকার ভিন্ন। চীনের প্রাচীন পাথর ভাষ্কর্য শিল্পকলায় এই ভাষ্কর্য সত্যি একটি উল্লেখযোগ্য কর্ম। এমন কি পেইচিং রাজকীয় প্রাসাদের ড্রাগন স্তম্ভ এ থেকে তুলনা করতে পারে না।  

  কনফুসিয়াসের মন্দিরে দু’হাজারাধিক চীনের বিভিন্ন রাজবংশ আমলের পাথর ফলক রয়েছে যাদের মধ্যে ৫০টিরও বেশী পাথর ফলকে রাজার অভিলেখন থাকে। এ থেকে বুঝা যায়, চীনের সামন্ত সমাজে কনফুসিয়াসের মযার্দা খুব বেশী।  

  কনফুসিয়াসের মন্দিরের পাশে কনফুসিয়াসের প্রাসাদ যেখানে কনফুসিয়াসের বংশধররা বসবাস করেন। চীনের মিন আর ছিন রাজবংশের রাজকীয় প্রাসাদের পর এটা হল চীনের দ্বিতীয় বড় আকারের প্রাসাদ।  

  কনফুসিয়াসের প্রাসাদ সন আর সোং আর কিন রাজবংশ আমলে (খৃষ্টব্দ দ্বাদশ –ত্রয়োদশ শতাব্দী) নিমির্ত হয়। এটা হল চীনের সামন্তকালের অভিজাতের বসতবাড়ী।তার আয়তন প্রায় ৫০ হজার বগর্মিটার । বিভিন্ন ধরনের ঘর প্রায় ৫ শো। কনফুসিয়াসের প্রাসাদের বিন্যাস অত্যন্ত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। প্রাসাদের সামনের অংশ অফিসের কাজ মোকাবেলার জায়গা, পিছনের অংশ থাকার জায়গা। প্রধান হলের স্থাপত্যে মিন আর ছিন রাজবংশ আমলের অভিসের শৈলীর রীতিনীতি দেখা যায়। কনফুসিয়াসের প্রাসাদে রয়েছে বিপুল সংখ্যক মূল্যবান ঐতিহাসিক দলিলপত্র, বিভিন্ন আমলের কাপড়চোপড় , আসবাবপত্র ইত্যাদি । 

  কনফুসিয়াসের সমাধিস্থান হল কনফুসিয়াস আর তাঁর বংশধরদের বিশিষ্ট সমাধি। বতর্মানে এটা হল পৃথিবীতে সবচেয়ে সুদীর্ঘকাল আর সবচেয়ে ব্ড় আকারের পরিবার সমাধিস্থান।একটানা ২৫০০ বছরের জন্যে এই সমাধিস্থান ব্যবহার করা হয়। প্রায় দুই বগর্কিলোমিটার জায়গায় মোট এক লক্ষটি কনফুসিয়াসের বংশধরের সমাধি আছে। কনফুসিয়াসের সমাধিস্থানে রয়েছে হান রাজবংশের পর থেকে (খৃষ্টপূর্ব ২০৬ – ২২০ খৃষ্টাব্দ) সংরক্ষিত ৫ হাজারেরও বেশীটি সমাধিস্থান ফলক আর বিভিন্ন পাথর ভাষ্কর্য। 

  চীনের বিভিন্ন আমলের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক আর সাংস্কৃতিক উন্নয়নে এবং অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার রীতিনীতির পরিবর্তনের গবেষণায় কনফুসিয়াসের সমাধিস্থানের ভূমিকা অপরিবর্তিত।  

  কনফুসিয়াসের মন্দির, কনফুসিয়াসের সমাধিস্থান এবং কনফুসিয়াসের প্রাসাদ বিশ্ববিখ্যাত । এটা হল প্রগাঢ় সংস্কৃতির উত্তরাধিকার। এর সঙ্গে সঙ্গে এতে বিপুল পরিমাণ মূল্যবান প্রাকৃতিক উত্তরাধিকার রয়েছে। ‘ কনফুসিয়াসের মন্দির , কনফুসিয়াসের সমাধিস্থান আর কনফুসিয়াসের প্রাসাদের উদ্যানে ১৭ হাজারেরও বেশীটি প্রাচীন গাছ আছে । এ সব গাছ হল এই জায়জার উন্নয়ন ইতিহাসের প্রত্যক্ষদর্শী। এর সঙ্গে সঙ্গে প্রাচীন কালের আবহাওয়া তত্ত্ব আর প্রাকৃতিক বিদ্যা গবেষণার জন্যে এ সব প্রাচীন গাছ মূল্যবান তথ্য যুগায়। 

  কনফুসিয়াসের মন্দির , কনফুসিয়াসের সমাধিস্থান আর কনফুসিয়াসের প্রাসাদের প্রগাঢ় সংস্কৃতি , সুদীর্ঘ ইতিহাস, সুমহান আকার, সমৃদ্ধ পুরাকীর্তি এবং বিজ্ঞাসঙ্গত শিল্পকলা বিশ্ববিখ্যাত। ১৯৯৪ সালে ‘কনফুসিয়াসের মন্দির, কনফুসিয়াসের সমাধিস্থান আর কনফুসিয়াসের প্রাসাদ ইউনেস্কোর বিশ্ব সংস্কৃতি উত্তরাধিকার তালিকাভূক্ত করা হয়।