চীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত তুনহুয়াং মোকাও গুহা মন্দির হচ্ছে বতর্মান বিশ্বের সবচেয়ে বড় আকার এবং সবচেয়ে অক্ষতভাবে সংরক্ষিত বুদ্ধ ধর্মের মূল্যবান শিল্পকলা ভান্ডার। ১৯৮৭ সালে মোকাও গুহা মন্দির ‘বিশ্ব উত্তরাধিকারের তালিকায় ’ অন্তভূর্ক্ত। তার উপর বিশ্ব উত্তরাধিকার কমিশনের মূল্যায়ন হল: মোকাও গুহা মন্দির ভাষ্কর্য আর দেয়াল চিত্র বিশ্ব-বিখ্যাত, এ সব ভাষ্কর্য আর চিত্র হাজারাধিক বছরে বতার্নো বুদ্ধ ধর্মের শিল্পকলা প্রকাশ পেয়েছে।
চীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের কানসু প্রদেশের তুনহুয়াং শহরের উপকন্ঠে মেনছুয়ে নামে একটি পাহাড় আছে। এই পাহাড়ের পূর্বাংশে অজস্র গুহা আছে। এই জায়গা দক্ষিণ-উত্তর বিস্তীর্ণ দু’ কিলোমিটার দীর্ঘ । এ সব পাঁচ তলার গুহা সুশৃংখলভাবে খনন করা হয়েছে।দেখতে সুমহান। এটা হল বিশ্ব-বিখ্যাত তুনহুয়াং মোকাও হুহা।
৩৬৬ সালে মোকাও হুগার খনন কাজ শুরু হয়। বিভিন্ন রাজবংশে এই খনন কাজ অব্যহত থাকার ফলে হুগার সংখ্যা ক্রমেই বাড়ে। সপ্তম শতাব্দীতে অথার্ত থান রাজবংশ আমলে মোকাও গুহাতে এক হাজারাধিক বুদ্ধ গুহা ছিল। সুতরাং মোকাও গুহাকে ‘সহস্রাব্দী গুহা’ বলে গণ্য করা হয়।
বিভিন্ন রাজবংশের মানুষ গুহা খনন করার সময় গুহার ভিতরে অজস্র বুদ্ধ মূক্তি বানিয়েছেন এবং বিপুল পরিমাণে দেওয়াল চিত্র একেঁছেন। তুনহুয়াং মোকাও গুহা তত্কালীণ প্রাচ্য-পশ্চিম যোগাযোগ ‘ রেশম পথের’ দুর্গে অবস্থিত বলে এটা প্রাচ্য-পশ্চিম ধর্ম , সংস্কৃতি আর জ্ঞানের সংযোজিত জায়গা । তুনহুয়াং মোকাও গুহাতে বিদেশের নানা ধরনের শিল্প আর চীনের জাতীয় শিল্প এক সঙ্গে মিশ্রিত হয়। বৈচিত্রময় শিল্পের আলোকে এই শিল্পের মূল্যবান ভান্ডার উজ্জ্বল দৃশ্য প্রকাশ পেয়েছ।
ইতিহাসের পরিবর্তন আর কৃত্রিম ধ্বংসের পর মোকাও গুহাতে এখনও প্রায় ৫০০টি গুহা , প্রায় ৫ বর্গমিটার দেয়ালচিত্র এবং দু’হাজারাধিক ভাষ্কর্য সংরক্ষিত রয়েছে। মোকাও গুহার বুদ্ধ মুক্তি বৈচিত্রময়। গায়ে পরা পোষাক আর ভঙ্গি নানা ধরনের। এতে ভিন্ন আমলের বৈশিষ্ট্য প্রতিফলিত হয়েছে। মোকাও গুহার দেয়ালচিত্র দেখতে সুমহান। যদি এ সব চিত্র এক সঙ্গে সংযুক্ত করা হয় তাহলে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি চিত্র করিডর হয়ে যায়।
|
ছবিতে থাং রাজবংশ আমলের তুনহুয়াং মোকাও গুহারের ১৪৮ নম্বর গুহারের দক্ষিণাংশের দেয়ালচিত্র |
এ সব দেয়ালচিত্রের বেশির ভাগ বুদ্ধ ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত। যেমন বিভিন্ন বুদ্ধ, দেবাতার মুক্তি, বুদ্ধ শাস্ত্রে লিপিবদ্ধ নানা ধরনের গল্পের চিত্র, ভারত, মধ্য এশিয়া এবং চীনে প্রচালিত গল্প , ঐতিহিসিক ব্যক্তি সঙ্গে সমন্বিত বুদ্ধ ইতিহাসের চিত্র ইত্যাদি ইত্যাদি। তা ছাড়া, বিভিন্ন যুগের দেয়ালচিত্রে যেমন তখনকার বিভিন্ন জাতির বিভিন্ন স্তরের সামাজিক জীবন, জামা-কাপড়, প্রাচীন কালের স্থাপত্য আর সংগীত, নৃত্য , জ্যামনেস্টিক প্রভৃতি প্রফলিত হয়েছে তেমনি দেশী-বিদেশী সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের ঐতিহাসিক সত্যতাও লিপিবন্ধ করা হয়। সুতরাং পশ্চাত্য পন্ডিতরা তুনহুয়াং দেয়ালচিত্রকে ‘দেয়ালের গ্রন্থাগার ‘ বলে গণ্য করেন।
|
|
ছবিতে ১৭২ নম্বর গুহাতে প্রাসাদের ভবণের মাঝখানে |
ছবিতে ৩৯ নম্বর গুহার পশ্চিম দেয়ালের দক্ষিণ দিকের |
তুনহুয়াং মোকাও গুহা এক সময় চীনের আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে শোচনীয় দুযোর্গ অতিক্রম করল। গুহাতে অনেক পুরাকীর্তি হারানো হয়।
১৯০০ সালে মোকাও গুহার একটি বই রাখার গোপনীয় ঘর অপ্রত্যাশিকভাবে উদ্ধার করা হল। পরে লোকেরা এই গোপনীয় ঘরকে ‘শাস্র রাখার গুহা’ বলে ডাকেন। তিন মিটার দীর্ঘ আর প্রন্থ এই ছোট গুহার ভিতরেবুদ্ধ ধর্মের শাস্ত্র, নানা ধরনের দলিলপত্র, শেলাই কাজ, চিত্র , বুদ্ধমূর্তি ইত্যাদি প্রায় ৫০ হাজারটি পুরাকীর্তী স্তুপাকৃত হয়। এগুলো পুরাকীর্তিচতুর্থ শতাব্দী থেকে এয়োদশ শতাব্দী পযর্ন্ত আমলের। এ সব পুরাকীর্তির মধ্যে অন্তর্ভূক্ত চীন, মধ্য-এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া, ইউরোপ প্রভৃতি জায়গার ইতিহাস , ভৌগল, রাজনীতি, জাতি, সামরিক , ভাষা ও সাহিত্য, সাহিত্য ও শিল্পকলা, ধর্ম, ঔষুধ বিষয়ক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রায় সমস্ত সামাজিক ক্ষেত্রের বিষয়। এটা’ মধ্য প্রাচীণ যুগের বিশ্বকোষ’ বলে আখ্যয়িত হয়।
তিব্বত বুদ্ধ ধর্মের শাস্ত্র গুহা আবিষ্কৃত হওয়ার পর , বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ‘আবিষ্কারকরা’ তুনহুওয়াংয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে শুরু করেন। ২০ বছরের কম সময়ের মধ্যে তাঁরা তুনহুওয়া থেকে পর পর প্রায় ৪০ হাজার শাস্ত্র আর অনেক দেয়ালচিত্র, ভাষ্কর্য চুরি করেছেন। যার ফলে তুনহুওয়া মোকাও গুহা সাংঘাতিক সবর্নাস হয়। বর্তমানে ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া, ভারত, জার্মানী, ডেনমার্ক, সুইডেন, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিনল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি দেশ তুনহুওয়াংয়ের পুরাকীর্তি সংগ্রহ করেছে। মোট সংখ্যা তিব্বত শাস্ত্র গুহারের দুই তৃতীয়াংশ।
তিব্বত শাস্ত্র গুহার আবিষ্কৃত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপক চীনা পন্ডিত তুনহুওয়াংয়ের দলিলপত্র নিয়ে গবেষণা করতে শুরু করেন। ১৯১০ চীনে তুনহুওয়াং দলিলপত্র নিয়ে গবেষণা বিষয়ক প্রথম কিস্তির বই প্রকাশিত হয়। এ সব বইকেবিশ্বের নজরবিহীন তুনহুওয়াং বিষয়ক তত্ত্ব বলে গণ্য করা হয়। গত কয়েক দশক বছর ধরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পন্ডিতরা তুনহুওয়াং লিল্পকলার উপর গভীর আগ্রহ প্রকাশ করে এসেছেন। এর উপরে তাদের গবেষণা কোন দিন বন্ধ হয়নি। তুনওয়াং বিষয়ক তত্ত্বের উপর গবেষণার ক্ষেত্রে চীনা পন্ডিতরাও গুরুত্বপূর্ণ আর প্রভাবশীল সাফল্য অর্জন করেছেন।
তুনওয়াং মোওগা গুহাকে চীনের মূল্যবান সাংস্কৃতিক ধন হিসেবে মনে করা হয়েছে বলে চীন সরকার এর সংরক্ষণের দিকে সবর্দাই গুরুত্ব দিয়ে এসেছে।সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তুনওয়াং মোওগা গুহা পরির্দশ করতে আসা দেশী-বিদেশী পযর্টকদের সংখ্যা অধিক থেকে অধিকতর হয়ে উঠেছে। সুতরাং এই পুরাকীর্তি রক্ষার জন্যে চীন সরকার মোওগা গুহার বিপরীত দিকের শানভিয়ে পাহাড়ের পাদদেশে তুনওয়াংয়ের শিল্পকলা রক্ষার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছে। এই কেন্দ্রে তুনওয়াং মোওগা গুহার আংশীক নকল পযর্টকদের জন্যে দেখানো হয়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ‘ডিজিটল কল্পিত মোওগা গুহা প্রতিষ্ঠার জন্যে চীন সরকার ২০ কোটি ইয়ান বরাদ্দ করেছে। জানা গেছে, দর্শকরা এই ডিজিটল কল্পিত গুহাতে খাঁটি মোওগা গুহা অনুভব করতে পারেন। তা ছাড়া গুহার ভিতরে আবর্তন করতে করতে দর্শকরা ষ্পষ্টভাবে গুহার ভিতরের স্থাপত্য, রঙি ভাষ্কর্য আর চার দিকের দেয়ানচিত্রের সকল শিল্পকলা দেখতে পারেন। বিশেষকরা বলেছেন, ‘ডিজিটল কল্পিত মোওগা গুহার’ নিমার্নশুধু যে দেয়ালচিত্র রক্ষা করতে পারে তাই নয়,তুনওয়াং সাংস্কৃতিক সম্পদের রেকর্ড আর সংরক্ষণ তরান্বিত করবে। যাতে মোওগা গুহার পুরাকীর্তি আর সংস্কৃতি দীর্ঘস্থায়ী থাকে।
|