প্রাচীন নগর লিচিয়াং চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ইয়েনান প্রদেশের লিচিয়াং নাসি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে অবস্থিত। চীনের সং রাশবংশের শেষ দিকে আর ইয়ান রাজবংশের প্রথম দিকে (খ্রষ্টব্দ ১৩ শতাব্দীর শেষ পর্যায়) এই নগরের নির্মান কাজ শুরু হয়। এই প্রাচীন নগর ইয়েনান-গুয়েযৌ মালভূমিতে অবস্থিত। এই মালভূমি সমুদ্র-সমদল থেকে ২৪০০ মিটার উচু। গোটা নগরের আয়তন ৩ দশমিক ৮ বর্গমিটার। প্রাচীনকাল থেকে এটা হল নাম-করা ব্যস্ত বাজার এবং গুরুত্বপূর্ণ নগর। বতর্মানে লিচিয়াং নগরে ৬২০০টিরও বেশী পরিবার বসবাস করে, লোকসংখ্যা ২৫ হাজারাধিক । অধিকাংশ হল নাসি জাতি। তাদের মধ্যে ৩০ শতাংশ লোক ব্রোঞ্জ ও রৌপের যন্ত্রপাতি তৈরী এবং চামড়া ও রেশম, বস্ত্র, মদ বানানো প্রভৃতি ঐতিহ্যিক শিল্প আর বাণিজ্যিক তত্পরতায় নিয়োজিত হয়।
(ছবিতে লিচিয়াং প্রাচীন নগরের ভবন আর স্থাপত্যের দৃশ্য)
লিচিয়াং প্রাচীন নগরের চার দিকে পাহাড় আর নদনদী। সড়কগুলো সাধারণত লাল রংয়ের পাথর দিয়ে সাজানো হয়। সুতরাং মৌসুমে এ সব সড়ক কদর্মক্ত হয় না এবং যখন বৃস্টি না হয় তখন ধূলিকণা বাতাসের সঙ্গে উড়ে না। পাথরে যে সব চিত্র খোদাই করা হয় সে সব চিত্র মার্জিত। এই প্রাচীন নগরের কেন্দ্রের সিফান সড়ক লিচিয়াং প্রাচীন নগরের প্রতিনিধিত্ব করে।
|
|
ছবিতে লিচিয়াং প্রাচীন নগর |
ছবিতে লিচিয়াং প্রাচীন নগরে লাওচিয়ে নামে একটি সড়ক |
লিচিয়াং প্রাচীন নগরের ভিতরে ইউয়েহো নামে একটি নদী আছে। এই নদীর উপর মোট ৩৫৪টি সেতু নিমির্ত হয়েছে। গড়ে প্রত্যেক বগর্মিটার ৯৩টি সেতু আছে। সেতুর চেহারা বৈশিত্রময়। অপেক্ষাকৃত বিখ্যাত সেতুগুলো হল: ডাসি সেতু, উয়ানছিন সেতু, নানমেন সেতু, মাআন সেতু, রেনশৌ সেতু প্রভৃতি। এ সব সেতু মিং আর ছিং রাজবংশ আমলে (চতুথর্দশ থেকে উনবিংশ শতাব্দী পযর্ন্ত) নিমির্ত হয়। এ সব সেতুর মধ্যে সিফান সড়কের পূব দিকে ১০০ মিটার দূরের ডাসি সেতু সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন।
(
ছবিতে লিচিয়াং প্রাচীন নগরের দৃশ্য
)
প্রাচীন নগরের ভিতরে মুফু নামে একটি ভবন লিচিয়াংএর বংশগত থুস( তখনকার এক শ্রেণীর স্থানীয় প্রশাসক) মু পরিবারের কাযার্লয়। ইউয়ান রাজবংশ আমলে(১২৭১ খৃষ্টাব্দ থেকে ১৩৬৮ খৃষ্টাব্দ ) নিমির্ত হয়। ১৯৯৮ সালে পূণর্নিমিত হওয়ার পর এই ভবন প্রাচীন নগরের জাদুঘরে পরিবর্তিত হয়।মু পরিবারেরআয়তন ৪৬ মু। পরিবারের উদানে ছোট-বড় ১৬২টি ঘর আছে। ভিন্ন আমলের রাজার প্রদান-করা ১১টি বোর্ড ঘরের দেওয়ালে ঝুঁলানো হয়। এতে মু পরিবারের সমৃদ্ধ ইতিহাস প্রতিফলিত হয়।
নগরের ফুগু মন্দিরের উফন ভবনমিং রাজবংশের উয়েনলি উনত্রিশ বছরে ( ১৬০১ খৃষ্টাব্দ) নিমির্ত হয়। ভবনের উচ্চতা ২০ মিটার। স্থাপত্যের আকার দেখতে উড়ন্ত পাঁচটি রঙিন ফক্সের মতো। তাই এই ভবনকে ‘ পাঁচ ফক্স’ ডাকা হয়।এই ভবনের ছাদে নানা রকমের সুচারু চিত্রাঙ্কন আঁকা হয়। এই’ পাঁচ ফক্স’ ভবনে হ্যান, তিব্বত আর নাসি জাতির স্থাপত্যের শিল্পকালার শৈলী মিশ্রিত হয়। এটা হল চীনের প্রাচীকালের স্থাপত্যগুলোতে একটি মূল্যবান দৃষ্টান্ত।
বেইশা আবাসিক স্থাপত্যের সংগ্রহশালা লিচিয়াং প্রাচীন নগরের উত্তর দিকে ৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ঔ জায়গা ছিল সোং আর ইউয়ান রাজবংশ আমলে ( খৃষ্টাব্দ ১০-১৪ শতাব্দীতে) লিচিয়াং অঞ্চলের রাজনীতি, অথর্নীতি আর সংস্কৃতি কেন্দ্র। বেইশা আবাসিক স্থাপত্যের সংগ্রহশালা দক্ষিণ-উত্তর বিস্তীর্ণ একটি ভূমিতে ছড়িয়ে পড়ে। এর কেন্দ্র হল একটি সিড়ির মতো চত্বর । ঝরনা উত্তর দিক থেকে চত্বরে আনা হয়। চাঁরটি গলি চত্বর থেকে চার দিকে বিস্তৃত হয়। সত্যই খুব বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। বেইশা আবাসিক স্থাপত্যের সংগ্রহশালার গঠন এবং বিকাশ পরবর্তীকালে লিচিয়াং প্রাচীন নগরের বিন্যাসের জন্যে ভিত্তি স্থাপন করেছে।
সুহো আবাসিক স্থাপত্য সংগ্রশালা লিচিয়াং প্রাচীন নগরের উত্তর দিকে ৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এটা হল এই প্রাচীন নগরের নিকটবতী ছোট বাজার। সেখানকার স্থাপত্য সংগ্রহশালা সুবিন্যস্তভাবে নিমির্ত হয়। দেখতে খুব সিফান সড়কের মতো। এই স্থাপত্যশালার মাঝখানে ছিনলং নামে একটি নদী প্রবাহিত হয়। মিং রাজবংশে( ১৩৬৮ খৃস্টাব্দ থেকে ১৬৪৪ খৃস্টাব্দ) নিমির্ত ছিনলং সেতু এই নদীতে স্থাপিত হয়। ছিনলং সেতু লিচিয়াং প্রাচীন নগরের বৃহত্তম পাথর খিলানযুক্ত সেতু।
লিচিয়াং প্রাচীন নগরের ইতিহাস সুদীঘর্কালের । নগর সুবিন্যস্তভাবে নিমার্ন করা হয়। নগর দেখতে যেমন পাহাড়ী নগরের মতো তেমনি দক্ষিণ চীনের নদনদীপূর্ণ নগরের মতো। লিচিয়াং আবাসিক স্থাপত্যশালায় হান, বেই , লি এবং তিব্বত জাতির শৈলী প্রতিফলিত হয়। তা ছাড়া নাসি জাতির বৈশিস্ট্যসম্পন্ন শৈলীও দেখা যায়। চীনের স্থাপত্য ইতিহাস এবং সাংস্কৃতিক ইতিহাস গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ উত্তরাধিকার। লিচিয়াং প্রাচীন নগরে সমৃদ্ধ জাতির ঐতিহাসিক সংস্কৃতি অন্তভুর্ক্ত এবং নাসি জাতির চড়াই-উরাই লক্ষনীয়ভাবে প্রতিফলিত হয়। এটা হল মানবজাতির সংস্কৃতি বিকাশ গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য।
|
|
ছবিতে কমর্ঠ নাসি জাতির নারী |
ছবিতে ‘সিফান সড়কের দরদালান |
লিচিয়াং প্রাচীন নগর অপেক্ষাকৃত উচ্চ বহুমুখী মূল্য আর সাবির্ক মূল্যসম্পন্ন ঐতিহাসিক আর সাংস্কৃতিক নগর। এতে লক্ষনীয়ভাবে স্থানীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি এবং জাতির রীতিনীতি প্রতিফলিত হয় । অতীতের সামাজিক অগ্রগতির সারগর্ভ প্রকৃতিও এতে প্রতিফলিত হয়। এখানকার চলন্ত নগর অবকাশ, প্রাণবন্ড নদনদী, একই শৈলীর স্থাপত্যশালা , উপযুক্ত আকারের আবাসিক স্থাপত্য , আন্তরিক আর মনোরম বসবাসের অবকাশ ও পরিবেশ এবং জাতির বৈশিস্ট্যসম্পন্ন শিল্পকলা ইত্যাদি চীনের যে কোনো ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক নগরে দেখা যায় না। এই প্রাচীন নগরের স্থাপত্যগুলোতে যে সরল, কাযর্কর এবং সুসম প্রকৃতি দেখা দিয়েছে তাতে বিশেষ ইতিহাসের পটভূমিতে নগর নিমার্নে মানব জাতির সৃস্ট আত্মা আর প্রগতির তাথপর্য প্রতিফলিত হয়েছে। লিচিয়াং প্রাচীন নগর হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ তাত্পর্যসম্পন্ন সংখ্যালঘু জাতির ঐতিহাসিক বসতিস্থান। তার অস্তিত্ব মানব জাতির নগর নিমার্ন ইতিহাসের গবেষণা, মানব জাতির জাতি উন্নয়ন ইতিহাসের গবেষণার জন্যে মূল্যবান তথ্য যুগিয়ে দিয়েছে। এটা হল মূল্যবান সংস্কৃতি উত্তরাধিকার এবং চীন তথা বিশ্বের যত্ন। ‘ বিশ্ব উত্তরাধিকারের তালিকায়’ অন্তভুর্ক্ত হওয়ার যুক্তি আছে।
(
ছবিতে লিচিয়াং ইয়াংসি নদীর প্রথম উপ সাগরের দৃশ্য
)
লিচিয়াং প্রাচীন নগর এমন একটি নগর যাতে প্রাকৃতিক আর কৃত্রিম সৌন্দর্য , শিল্পকলা আর প্রযোজ্য অথর্নীতি মিশ্রিত হয়। ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বর সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের বাছাই মানদন্ড অনুযায়ী লিচিয়াং প্রাচীন নগর ‘বিশ্ব উত্তরাধিকারের তালিকায়’ অন্তভূর্ক্ত হয়। বিশ্ব উত্তরাধিকার কমিশনের মূল্যয়ন হল: প্রাচীন নগর লিচিয়াং অথর্নীতি আর গুরুত্বপূর্ণ রণনৈতিক স্থান আঁকাবাঁকাপাহাড়ী অঞ্চলের সঙ্গে সুন্দরভাবে মিশে গেছে।এখানে সত্য আর অক্ষতভাবে সরল দৃশ্য সংরক্ষণ করা হয়েছে এবং আরেকবার তা প্রকাশ পেয়েছে।প্রাচীন নগরের স্থাপত্য অনেক রাজবংশ অতিক্রম করে অজস্র দুযোর্গে নিপীড়িত হয়ে বিভিন্ন জাতির সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে মিশ্রিত হয়েছে বলে দেশজোড়ে বিখ্যাত। লিচিয়াং নগরে প্রাচীন কালের পানি সরবরাহ ব্যবস্থা আছে। এ সব ব্যবস্থা সারা নগরে ছড়িয়ে পড়ে। এখন পযর্ন্ত এ সব ব্যবস্থা কাযর্কর ভূমিকা পালন করছে।
|