যৌখৌডিয়ান পিকিং মানবের “ আবাসস্থল”
 

       যৌখৌডিয়ান পিকিং মানবের “ আবাসস্থল” পেইচিং মহা নগরের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে ৪৮ কিলোমিটার দূরের ফাংসেন বিভাগের যৌখৌডিয়ান গ্রামের লনগু পাহাড়ে অবস্থিত।তার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে উত্তর চীনের সমতলভূমি এবং উত্তর-পশ্চিম দিকে পাহাড়ী এলাকা। পিকিং মানবের “ আবাসস্থল” ঠিকই এই পাহাড়ী অঞ্চল আর সমতলভূমি সংলগ্ন জায়গায় অবস্থিত।যৌখৌডিয়ানের নিকটবর্তী পাহাড়ী এলাকায় বেশির ভাগ চুনাপাথর । জলের প্রবাহে অনেক ছোট-বড় , নানা আকারের প্রাকৃতিক গুহা গড়ে উঠেছে।পাহাড়ে পূব-পশ্চিম কিস্তীর্ণ প্রায় ১৪০ মিটার লম্বা এই প্রাকৃতিক গুহা আছে। এই গুহা “ মর্কট-মানবের গুহা” বলা হয়।১৯২৯ সালে এই গুহাতে প্রথম বার প্রাচীনকালের মানব ধ্বংসাবশেস উদ্ধার করা হয় । পরে এই জায়গাকে “যৌখৌডিয়ানের প্রথম স্থল” বলে গণ্য করা হয়। 

(ছবিতে যৌখৌডিয়ান পিকিং মানবের “ আবাসস্থল”)

  যৌখৌডিয়ান ধ্বংসাবশেষ এলাকা হচ্ছে উত্তর চীনের পুরাতন পাথর যুগের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধ্বংসাবশেষ।এই এলাকার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হল যৌখৌডিয়ানের এক নম্বর স্থল অর্থাত পিকিং মানবের “ আবাসস্থল”। ১৯২১ সালে সুইডেনের পন্ডিত আটেসেন প্রথমে এই ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার করেন। তার পর আরও বেশী পন্ডিত ওখানে গিয়ে খননের কাজ চালান। ১৯২৭ সালে ক্যানাডার পন্ডিত বুডাসেন যৌখৌডিয়ান ধ্বংসাবশেষে আনুষ্ঠানিকভাবে খননের কাজ চালান। তিনি ওখানে উদ্ধারকৃত মানুষের তিনটি ডাতকে আনুষ্ঠানিকভাবে “চীনেরউল্লুকের পেইচিং প্রজাতি” বলে আখ্যয়িত করেন।১৯২৯ সালে চীনের প্রত্নকর পেভেনজন খনন কাজ চালানোর সময় “পিকিং মানবের” প্রথমটি করোটি উদ্ধার করেন।এটা বিশ্বে আড়োলনের সৃষ্টি করে। 

  গত আশি বছরের বেশী সময় ধরে যৌখৌডিয়ান ধ্বংসাবশেষের খনন কাজ অব্যাহত রয়েছে।বিজ্ঞান গবেষণা কাজ এখনও চলছে।এই ধ্বংসাবশেষের প্রথম নম্বর স্থানে ৪০টিরও বেশী মিটারদূরত্ব খনন করা হয়েছে।কিন্তু যে খনন কাজ হয়েছে তা গর্তে জমানো ধ্বংসাবশেষের অর্ধেকও হয় না।যৌখৌডিয়ান পিকিং মানব ধ্বংসাবশেষে যে মর্কট-মানবের জীবাশ্ম, পাথরের তৈরী দ্রব্য, স্তন্যপায়ী প্রাণীর জীবাশ্ম আবিষ্কৃত হয়েছে তার প্রজাতি এত বেশী,আগুণ ব্যবহারের ধ্বংসাবশেষ এত সমৃদ্ধ তাথেকে একই যুগের অন্যান্য ধ্বংসাবশেষের তুনলা নেই। 

   যৌখৌডিয়ান পিকিং মানব ধ্বংসাবশেষে আগুণ ব্যবহারের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে বলে মানব জাতির আগুণ ব্যবহারের ইতিহাস আরও কয়েক লক্ষ বছরের সামনে রেখে দেওয়া হয়েছে। ধ্বংসাবশেষে পাঁচটিছাইয়ের পোঁচ , তিনটি ছাইয়ে স্তুপ এবং বিপুল পরিমাণে মানুষের হাড় আবিষ্কৃত হল। ছাইয়ের পোঁচের সবচেয়ে পুরু জায়গা ৬ মিটার। এসব ধ্বংসাবশেষ থেকে বুঝা যায় পেইচিং মানব শুধু যে আগুণ ব্যবহার করতে পারতেন তাই নয় আগুণের বীজ সংরক্ষণও করতে পারতেন। 

  ধ্বংসাবশেষে হাজার হাজার পাথরের তৈরী পণ্য আবিষ্কৃত হয়েছে। এসব উপাদান সবই ধ্বংসাবশেষের নিকটবর্তী জায়গা থেকে আনা হত। পাথরের তৈরী পণ্যগুলোর মধ্যে বেশীর ভাগ ছোট আকারের এবং নানান রকমের। পুরাতন প্রস্তর যুগে প্রস্তর-নির্মিত যন্ত্রাদি বড় এবং বেশীর ভাগ ছুড়ি আর হাতুড়ি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু মধ্যপ্রস্তর যুগে যে সব প্রস্তরনির্মিত যন্ত্রাদি হয়েছিল সে সব যন্ত্রাদির আকার ছোট হল এবং খড়া যন্ত্রাদির দিকে বিকশিত হয়। অন্ত-প্রত্নপ্রস্তর যুগের প্রস্তরনির্মিত যন্ত্রাদির আকার আরও ছোট হয়ে গেল।  

  মাটির নিচে আবিস্কৃত এ সব পণ্যে প্রমাণিত হয়েছে যে, আজ থেকে ৭--২ লক্ষ বছর আগের সময়পর্বে পিকিং মর্কট মানব যৌখোওডিয়ান এলাকায় বসবাস করেন। তাদের জীবিকা প্রধানত বন্য ফুলমুল সংগ্রহের উপর নির্ভর করেন, আশেপাশে তারা শিকারও করতেন।প্রথম যুগের পিকিং মর্কট মানব আজ থেকে ৭--৪ লক্ষ বছর আগের , মধ্য যুগের মর্কট মানব আজ থেকে ৪--৩ লক্ষ বছর আগের এবং পরবর্তীকালীণ যুগের পিকিং মর্কট মানব আজ থেকে ৩--২ লক্ষ বছর আগের । পেইচিং মানব হল প্রাচীন মর্কট মানব থেকে বুধিসম্পন্ন মানুষে রুপান্তরের প্রক্রিয়ায় আবিভূর্ত আদিম মানব জাতি। জীববিদ্যা, ইতিহাস আর মানব জাতির উন্নয়ন ইতিহাসের গবেষণায় এই আবিস্কার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং মূল্যবান।  

  পিকিং মানব আর সংস্কৃতির আবিস্কার ও গবেষণার ফলে, উনবিংশ শতাব্দীতে জাওয়া মানুষ আবিস্কৃত হওয়ার পর থেকে বিজ্ঞান ক্ষেত্রে আধা শতাব্দী স্থায়ী বির্তক মিমাংসিত হয়। এই বিতর্ক ছিল ‘সোজা দাঁড়ানো মানব’ মর্কট-মানব না কি মানুষ। বাস্তবতা থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, মানব জাতি ইতিহাসের প্রথম যুগে সত্যিই ‘ সোজা দাঁড়ানো মানব পর্যায় ছিল। কারন শারীরিক গঠন, সাংস্কৃতিক প্রকৃতি থেকে সামাজিক সংগঠন পযর্ন্ত ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হয়েছে। তারা যেমন ‘দক্ষিণ মর্কট -মানবের বংশধর তেমনি পরর্বর্তীকালে আবির্ভুত ‘ বুধিসম্পন্ন মানুষের’ পূর্বপুরুষ। ‘ সোজা দাঁড়ানো মানব’ মর্কট-মানব থেকে মানুষে রুপান্তরের প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে ছিল। এখন পর্যন্ত ‘সোজা দাঁড়ানো মানবের’ দৃষ্টান্তমূলক চেহারা এখনও যোখোডিয়ানের পিকিং মানবের বিধার ভিত্তিতে। যৌখোডিয়ান মানব আবাসস্থাল এখনও বিশ্বের অনুরুপ সময়পর্বে প্রাচীন মানব জাতি ধ্বংসাবশেষে সবচেয়ে সমৃদ্ধ, সম্পূর্ণ আর মূল্যবান তথ্যগুলোর অন্যতম। বিশ্বের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের যাচাই মানদন্ড অনুসারে ১৯৮৭ সালের ডিসেম্বর যৌখৌডিয়ান পিকিং মানব আবাসস্থল ‘বিশ্ব উত্তরাধিকারের তালিকাভুক্ত হয়। বিশ্ব উত্তরাধিকার কমিটির মূ্ল্যয়ন হল: যৌখৌডিয়ান ‘পিকং মানব’ আবাসস্থলের বিজ্ঞানসম্মত অনুসন্ধান কাজ এখনও চলছে। এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানিরা আবিষ্কার করেছেন যে, চীনা মর্কট-মানব পিকিং মানবের ধ্বংসাবশেষ। তারা মধ্য আর পরির্বতনকারী যুগে বসবাস করতেন। এর সঙ্গে সঙ্গে নানা ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য আবিষ্কার করা হয়েছে। তা ছাড়া, খৃষ্টপূর্ব ১৮০০ থেকে ১১০০ পর্যন্ত নতুন মানব জাতির ধ্বংসাবশেষও আবিষ্কার করা হয়েছে। যৌখৌডিয়ান ধ্বংসাবশেষ দূর প্রাচীন কালে এশিয়া মহাদেশের মানব জাতির দুর্লভ ঐতিহাসিক প্রমাণ বটে, তা ছাড়া এটা মানব জাতির রুপান্তরকরণের প্রক্রিয়ার পরিচয় দিয়েছে।