তুনহুয়াং’র মোকাও গুহাসমূহ 

             উত্তরপশ্চিম চীনের তুনহুয়াং’র মোকাও গুহাসমূহ হলো শিল্পকলার এক বিরাট ধনভাণ্ডার।এটা চীনের চারটি মহা গুহাসমূহের মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং বিষয়বস্তুতে সবচেয়ে সমৃদ্ধ একটি গুহাসমূহ । তাতে প্রতিফলিত হয় চীনের দশটিরও বেশী রাজবংশ আমলের প্রায় এক হাজার বছর ধরে খোদাই করা পাথরের ভাস্কর্যশিল্পের উত্কর্ষ। এটিই বিশ্বের বৃহত্তম এবং সবচেয়ে সম্পূর্ণভাবে সংরক্ষিত বৌদ্ধধর্মের পুরাকীতি নিদর্শন। 

  চীনের উত্তরপশ্চিম অংশের কানসু প্রদেশের তুনহুয়াং শহরের উপকণ্ঠে একটি পাহাড় আছে, যার নাম “মিংশাশান” , অর্থাত্ “বালিঝড় গর্জন পাহাড়”। এই পাহাড়ের পূর্ব দিকের খাড়া পাহাড়ের গায়ে খোদাই করা হয়েছে অসংখ্য গুহা । গুহাসমূহ দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকে প্রায় দুই কিলোমিটার দীর্ঘ জায়গায় উপর থেকে নিচে মোট পাঁচ স্তরে বিভক্ত। সেগুলো উঁচু আর নিচু খুব সুশৃংখলভাবে সাজানো রয়েছে , একেবারেই শোভা পায়, দেখতে খুবই মহিমাময়। এটাই বিশ্ব-বিখ্যাত তুনহুয়াং’র মোকাও গুহাসমূহ । 

  মোকাও গুহাসমূহ নির্মাণের কাজ শুরু হয় ৩৬৬ খৃষ্টাব্দে । একদিন লোচুন নামে একজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ভ্রমণ করতে করতে তুনহুয়াং এলাকায় পৌছলেন। তিনি দেখলেন, “বালিঝড় গর্জন পাহাড়ের ” ওপর থেকে হাজার হাজার সোনালী রশ্মি বিচ্ছুরিত হচ্ছে, যেন হাজার হাজার বুদ্ধ এই সোনালী আলোকে দেখা দিচ্ছে। লোচুন সন্ন্যাসী মনে মনে ভাবলেন, “ এটা নিশ্চয়ই একটি পবিত্র স্থান!”। অতএব তিনি মিস্ত্রীদের ডেকে খাড়া পাহাড়ের গায়ে খোদাই করালেন প্রথম বৌদ্ধমূর্তির গুহা। তার পর একের পর এক রাজবংশের সময়ে বৌদ্ধ গুহা নির্মাণের কাজ অব্যাহতভাবে চললো । গুহার সংখ্যা বাড়তে লাগলো । সপ্তম শতাব্দির থাং রাজবংশের আমলে মোকাও গুহাসমূহে মোট এক হাজারেরও বেশী গুহা খোদাই করা হয়েছে, তাই মোকাও গুহাসমূহকে আবার “ হাজার বুদ্ধের গুহা” নামেও সুপরিচিত হয়। 

  মোকাও গুহাসমূহ হলো এক শিল্পকলার মহাভাণ্ডার, তাতে প্রাচীন স্থাপত্যশিল্প, দেওয়ালচিত্র এবং ভাস্কর্যশিল্পের সমন্বয় সাধিত হয়েছে । বিভিন্ন রাজবংশের আমলে লোকেরা গুহা কাটার সময়ে গুহার ভেতরে প্রচুর সংখ্যক বুদ্ধমূর্তি তৈরি করেছেন এবং প্রচুর দেওয়ালচিত্র এঁকেছেন। যদিও অনেক ঐতিহাসিক পরিবর্তন এবং ধ্বংস ও ক্ষতিসাধন হওয়ার পর মোকাও গুহাসমূহে এখনও প্রায় ৫০০ গুহা বজায় রয়েছে এবং প্রায় ৫০ হাজার বর্গমিটার দেওয়ালচিত্র এবং দু হাজারেরও বেশি মূর্তি ইত্যাদি ভাস্কর্যশিল্পকর্ম সংরক্ষিত রয়েছে । মোকাও গুহাসমূহের মূর্তিগুলো খুবই বৈচিত্র্যময় , মূর্তিগুলোর পোষাক ও নানা রকমের, তাতে বিভিন্ন আমলের ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য প্রতিফলিত হয়। মোকাও গুহার দেওয়ালচিত্র সবচেয়ে মহাসমারোহপূর্ণ। এই সব দেওয়ালচিত্র একের পর এক লাগানো হলে তার মোট দৈর্ঘ্য হবে ৩০ কিলোমিটার। 

  তুনহুয়াং’য়ের মোকাও গুহা চীনের দূরদূরান্ত অঞ্চলে অবস্থিত বলে শত শত বছর ধরে তা বিশ্ববাসীদের দৃষ্টি আকৃষ্ট করে নি। বিংশ শতাব্দির প্রথম দিকে এখানে একটি রহস্যময় পুস্তক- গুদাম(ভাণ্ডার) আবিষ্কৃত হয়, ফলে মোকাও গুহার অমূল্য ‘ধনভাণ্ডার’ বিশ্বকে মুগ্ধ করে এবং চীনের আধুনিক ইতিহাসে এই পুরাকীর্তি নিদর্শনগুলো প্রচুর পরিমাণে বিদেশে পাচার হয়ে যায় । 

  ১৯০০ সালে মোকাও গুহার ব্যবস্থাপনাকারী একজন দাও ধর্মের সন্ন্যাসী,যিনি ওয়াং দাওসি নামে পরিচিত, তিনি দৈবক্রমে একটি গুপ্ত কক্ষ আবিষ্কার করলেন। পরে এই গুপ্ত কক্ষ “ বৌদ্ধসূত্র গুহা” নামে সুপরিচিত হয়। এই গুহা তিন মিটার লম্বা এবং তিন মিটার চওড়া। এই গুহার ভেতরে ঠাসাঠাসি গাদাগাদি করে বৌদ্ধসূত্র, বইপুস্তক, সূচিকর্ম, ছবি ,বৌদ্ধ মন্দিরের রেশমী ঝাণ্ডা ইত্যাদি মোট ৫০ হাজারটি অতি বিরল পুরাকীতি নিদর্শন রাখা হয়েছিল। এগুলো হলো চতুর্থ শতাব্দী থেকে একাদশ শতাব্দি পর্যন্ত সময়পর্বের পূরাকীর্তি নিদর্শন। এগুলোর বিষয়বস্তু চীন ও মধ্য এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া, এমন-কি ইউরোপের ইতিহাস, ভূগোল, রাজনীতি, জাতি, সামরিক বিষয়, ভাষা ও লিপি, সাহিত্য ও শিল্পকলা,ধর্ম, চিকিত্সা, ভেষজবিদ্যা ইত্যাদি ক্ষেত্রের সঙ্গে জড়িত। এটাকে “মধ্য-প্রাচীন যুগের বিশ্বকোষ” বলা যায় । 

  ওয়াং তাওশি এই ‘বৌদ্ধসূত্র গুহা” আবিষ্কৃত করার পর গুহার ভেতরকার কিছু জিনিস(পুরাকীতি নিদর্শন) বাইরে নিয়ে গেলেন এবং স্বার্থ লাভের জন্য জিনিসগুলো অন্যদের হাতে দিয়ে দিলেন। এই সব মূল্যবান পুরাকীর্তি নিদর্শন পাচার হয়ে সমাজের বিভিন্ন লোকের কাছে ছড়িয়ে পড়লো, ফলে বিদেশীরাও এ খবর পেলেন। অতএব বিশ্বের বিভিন্ন দেশের “আবিষ্কারকরা” হুড়মুড় করে ছুটে এলেন এখানে । তখনকার চীনের ছিংরাজবংশের সরকার দুর্বল ছিল বলে অল্প ২০ বছরের মধ্যেই রাশিয়া, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জাপান আর যুক্তরাষ্ট্র ইত্যাদি দেশের “আবিষ্কারকরা পর্যায়ক্রমে তুনহুয়াং থেকে প্রায় ৪০ হাজার খণ্ড বৌদ্ধসূত্র এবং মূল্যবান দেওয়ালচিত্র, ভাস্কর্য চুরি করে নিয়ে গেলেন । এটা তুনহুয়াং-এর মোকাও গুহার এক মহাবিপর্যয় । বর্তমানে ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া, ভারত, জার্মানি, ডেনমার্ক, সুইডেন, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিনল্যাণ্ড, যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি দেশে তুনহুয়াং-র পুরাকীতি নিদর্শন সংরক্ষিত রয়েছে, এগুলোর পরিমাণ “ বৌদ্ধসূত্র গুহাতে” আবিষ্কৃত পুরাকীতি নির্দশনগুলোর মোট পরিমাণের তিন ভাগের দুই ভাগ। “বৌদ্ধসূত্র গুহা” আবিষ্কৃত হবার পর বেশ কিছু চীনা পণ্ডিত অতি কষ্ট অবস্থায় তুনহুয়াং’র পুঁথিপত্র গবেষণা শুরু করলেন । ১৯১০ সালে চীনে তুনহুয়াং’র পুঁথিপত্র গবেষণা সংক্রান্ত প্রথম কিস্তী বিশেষ গ্রন্থ বা নিবন্ধসংকলন প্রকাশিত হয়। এটা বিদ্যাচর্চার ক্ষেত্রে “তুনহুয়াংবিদ্যা” নামে সুপরিচিত । তার পর কয়েক দশকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পণ্ডিতরা তুনহুয়াং-এর শিল্পকলা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে প্রবল আগ্রহ প্রকাশ করেন, তা নিয়ে অব্যাহতভাবে গবেষণা চালান। আর চীনা পণ্ডিতরা তুনহুয়াংবিদ্যা গবেষণার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য অর্জন করেছেন। তুনহুয়াং’র মোকাও গুহাসমূহ চীনা সংস্কৃতির অমূল্য সম্পদ । নয়াচীন সরকার বরাবরই এর সংরক্ষণের কাজে খুব মনোযোগ রাখে । ১৯৫০ সালে চীন সরকার মোকাও গুহাসমূহকে প্রথম কিস্তির জাতীয় পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ পুরাকীর্তি নিদর্শনের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে । ১৯৮৭ সালে মোকাও গুহাসমূহ আবার ইউনেস্কোর ধার্য করা ‘ বিশ্ব সংস্কৃতির উত্তরাধিকারগুলোর’ তালিকা-ভুক্ত হয়েছে । আজ মোকাও গুহার অপর দিকের সানওয়েই পাহাড়ের পাদদেশে তুনহুয়াং শিল্পকলা প্রদর্শনিকেন্দ্র স্থাপিত হয় । এখানে মোকাও গুহাসমূহের কিছু গুহার অবিকল প্রতিরূপ (কৃত্রিম গুহা ) নির্মাণ করে সত্যিকারের গুহার পুরাকীর্তি নিদর্শন এখানে এনে সুরক্ষিত রাখা হয়। তাতে পর্যটকদের পরিদর্শনের খুব সুবিধাও হয় । বিদেশী পর্যটকরা মোকাও গুহার প্রশংসা করে বলেন: “ এটি বর্তমান বিশ্বে সংরক্ষিত রাখা বৌদ্ধ শিল্পকলার বৃহত্তম রত্নভাণ্ডার”