গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে দক্ষিণ চীনের হুনান প্রদেশের চাংশা’র মাওয়াংতুই’তে হান রাজবংশ আমলের সমাধিতে খননকাজ চালানো হয়, তাতে অক্ষত অবস্থায় সংরক্ষিত এক মহিলার মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয় এবং তা চীন সহ সারা বিশ্বকে বিস্মিত করে । কারণ এটা বিশ্বে প্রথমবারের মতো আবিষ্কৃত প্রাচীনকালের এক প্রায় অবিকৃত মৃতদেহ। মহিলার মৃতদেহটি দু হাজারের অধিক বছর আগে সমাধিস্থ করা হলেও তার চোখ ও মুখ আজও দেখতে জীবিতের মতো , তার মাংসপেশি ও চামড়া এখনও বেশ নরম। এটা এক বিস্ময়কর কাণ্ড। এর সঙ্গে সঙ্গে মাওয়াংতুই সমাধির খননে আরও আবিষ্কৃত হয়েছে প্রচুর সংখ্যক নানা রকমের অক্ষত অবস্থায় সংরক্ষিত, মূল্যবান আর বিরল পুরাকীতির নিদর্শন। এটা চীনা সভ্যতার উত্কৃষ্ট ধনরত্ন।
দক্ষিণ চীনের হুনান প্রদেশের রাজধানী ছাংশা শহরের পূর্ব উপকণ্ঠে জনগণের মধ্যে একটি কাহিনী প্রচলিত ছিল যে, এখানে এক বিরাট সমাধিস্থান, কেউ বলেন, মা নামক এক স্থানীয় রাজার সমাধি এখানে । তাই এই জায়গার নাম বরাবরই ছিল মা -ওয়াং -তুই । চীনা শব্দ ওয়াং-এর অর্থ রাজা, তুই-এর অর্থ সম্ভবত ঢিবি বা কবর। আরও কেউ বলেন , এখানে প্রাচীন ছাংশা রাজ্যের রাজার মা-এর সমাধি , এই সব রাজা আর রাজ-মাতা-র কাহিনীও আছে। গত শতাব্দির সত্তরের দশকে এক নির্মাণ প্রকল্পের ভূগর্ভস্থ কক্ষের জন্য খননকাজে হঠাত্ আবিষ্কৃত হলো এক বিরাট সমাধি এবং সমাধিস্থ ব্যক্তির পরিচয়ও পরে সনাক্ত করা সম্ভব হলো। এটা ১৯৭১ সালের ঘটনা । শ্রমিকরা মাটি খনন করতে করতে দশ-বারো মিটারেরও বেশি গভীর এক গর্ত দেখা দিলো, তখন দেখা দিলো মিহিন ধরনের সাদা সাদা মাটি বেরিয়েছে । শ্রমিকরা যন্ত্র দিয়ে আরও গভীর দিকে ড্রিলিং করলে ছিদ্র থেকে বেরিয়ে এলো এক ঝাঁঝালো গন্ধের বাতাস। ঠিক এমন সময়ে কেউ দিয়াশলাই দিয়ে সিগারেট ধরাতে যাচ্ছিল, এই ঝাঁঝালো বাতাসে আগুন ধরে গেল, আগুনের শিখা বেশির ভাগ নীল রঙের , অবশ্য কিছু লাল রঙও মিশে আছে। অগ্নিশিখার ডগা সাঁপের মতো এঁকেবেঁকে নড়ছে। কেউ আগুনের ওপর পানি ঢেলে নিভাতে চেষ্টা করতে লাগলো, কিন্তু ঝাঁঝালো গণ্ধের প্রবল বাতাসের তোড়ে পানি উল্টা দিকে ছিটকে পড়েছে । শেষে শ্রমিকরা মাটি ভরা বস্তা দিয়ে ছিদ্র বন্ধ করে দিলেই-কেবল আগুন নেভাতে পেরেছে ।
বিশেষজ্ঞরা সরেজমিনে তদন্ত চালানোর পর প্রাথমিকভাবে সনাক্ত করেছেন ,এটা একটি প্রাচীন সমাধি। খনন করতে করতে সমাধির নিচে দেখা গেল বড় কফিনের কক্ষ, যা ভরা ছিল এক মিটারেরও বেশি পুরু এক সাদা মাটির স্তর। সাদা মাটির নিচে রাখা ছিল পুরু এক স্তর কাঠের কয়লা, যার মোট ওজন আড়াই হাজার কিলোগ্রামের বেশি , গোটা চার ট্রাক ভরে কয়লা অন্যত্র সরানো হলো । কয়লার নিচেই শুধু দেখা দিলো কফিন, তবে কফিনের ওপর আরও বিছানো ছিল কয়েক ডজন বাঁশের চাটাই। আবিষ্কৃত হবার প্রথম দিকে এই চাটাইয়ের রঙ হাল্কা হলুদ ছিল এবং ঝকঝকে নতুন, কিন্তু দশ মিনিট পর এ চাটাইগুলো কালো রঙের জীর্ণ বস্তুতে পরিণত হলো। বড় কফিনের ভেতরে একটি ছোট কফিন , তার ভেতরে আরও একটি ছোট কফিন, যার ভেতরে আর একটি সবচেয়ে ছোট কফিন, তার ভেতরেই মৃতদেহ। অর্থাত, এটা চার স্তরের কফিন। সব চেয়ে বাইরের কফিন ৭ মিটার লম্বা, ৫ মিটার চওড়া এবং প্রায় তিন মিটার উঁচু।
সবচেয়ে ভেতরের কফিন খুললে তার ভেতরে দেখা গেল এক নারীর মৃতদেহ এবং তার চেহারা দেখতে জীবিত মানুষের মতো , তাতে সবাই অবাক হলেন।মৃতদেহ একেবারে প্রায় অক্ষত অবস্থায় সংরক্ষিত রয়েছে, তার মুখের রূপ খুবই স্পষ্ট, চুল কুচকুচে কালো , হাত- পায়ের আঙ্গুলগুলোর ভাঁজ বা রেখা খুবই পরিষ্কার দেখা যায়, চামড়া মোটেই শুকিয়ে যায় নি, বরং তেলতেলে ভাব, মাংসপেশি নরম এবং স্প্রিং বা ইলাস্টিক প্রকৃতিবিশিষ্ট, হাত-পায়ের গ্রন্থিগুলো সহজেই নড়ানো যায়। মৃতদেহ ব্যবচ্ছেদ করে দেখা গেছে, দেহের ভেতরকার বিভিন্ন অঙ্গ বা যন্ত্র সম্পূর্ণ রয়েছে , পাকস্থলি আর নাড়িভূড়ির ভেতরে পাওয়া গেছে মিষ্টি ফুটির শতাধিক বীজ। তাতে প্রমাণিত হয়েছে , এই বৃদ্ধা নারী ফুটি খেতে ভীষণ পছন্দ করতেন । হয়তো মাত্রাতিরিক্ত বেশি ফুটি খেয়েই মারা গেছেন । মৃত্যুর সময় হয়তো ঠিক ফুটি পাকার মরশুম । সমাধির ভেতরে মৃত ব্যক্তির নাম-সম্পন্ন সীল পাওয়া গেছে, তাতে লেখা ছিল “স্ত্রি সিংচুই”। অনুসন্ধান চালিয়ে প্রমাণ করা হয়েছে যে, সমাধির ভেতরকার মৃতদেহ খৃষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে সমাধিস্থ করা হয়েছিল। ব্যক্তিটি ছিলেন পশ্চিম হান রাজবংশ আমলের প্রথম দিককার ছাংশা রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী লি ছাংয়ের স্ত্রি, যার নাম সিং চুই।
“দুই হাজার বছরের বেশী সময়েও মহিলার মৃতদেহ পঁচে যায় নি”। এই মৃতদেহ আবিষ্কৃত হবার ঘটনা সারা পৃথিবীতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। বিশেষজ্ঞ, পর্যটক, চলচ্চিত্রের ক্যামেরাম্যান, বিজ্ঞান-গবেষকরা সবাই ছাংশা শহরে ছুটে গেলেন । সংশ্লিষ্ট পরিসংখ্যান অনুযায়ী মাওয়াংতুই মহিলার মৃতদেহ আবিষ্কৃত হবার পর অল্প সময়ের মধ্যেই ছাংশা শহরে অস্থায়ী লোকসংখ্যা হঠাত্ বেড়েছে ৫০ হাজার। মহিলা সিং চুই’র সমাধির খননকাজ চালানোর পর দুই বছরে, তার আশেপাশে আরও দুটো বিরাট আকারের হান রাজবংশীয় আমলের সমাধিতে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজ চালানো হয়েছে। অনুসন্ধান চালিয়ে প্রমাণিত হয়েছে যে, একটি সমাধি ছিল সিং চুইয়ের স্বামী ছাংশা রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী লি ছাং-এর। অন্য একটি সমাধি হয়তো ছিল তাঁদের ছেলের । এই তিনটি সমাধিকে একত্রে বলা হয় “ ছাংশা’র মাওয়াংতুই’র হান রাজবংশীয় আমলের সমাধি”। এই সমাধিগুলোতে আবিষ্কৃত পুরাকীতির নিদর্শনের সংখ্যা খুবই বেশী । এর অন্তর্ভুক্ত রয়েছে জামাপোষাক, খাদ্যবস্তু, ওষুধপত্র, বার্নিশ দেয়া আসবাবপত্র, কাঠের পুতুল, বাদ্যযন্ত্র, মোটা ধরনের চীনা মাটির পাত্র, রেশমী কাপড়ের ওপর পেন্টিং এবং প্রচুর পরিমাণ রেশমী কাপড়ের ওপর প্রাচীন লিপি আর বাঁশের ফলকে প্রাচীন লিপি। এই সব জিনিসপত্রের শৈল্পিক কলাকৌশলের উত্কর্ষ যেমন বিস্ময়কর, তেমনি জিনিসগুলো খুবই ব্যবহারিক । এগুলো খুবই মূল্যবান । এই সমাধিগুলোতে আবিষ্কৃত এক হাজার চার শোর বেশী রেশমী কাপড়চোপড়কে “পশ্চিম হান আমলের (খৃষ্টপূর্ব২০৬- খৃষ্টীয় ২৫ সাল) বিস্ময়কর রেশমী কাপড়ের রত্নভাণ্ডার” বলে প্রশংসা করা হয় । এর মধ্যে দুটো পাতলা ধরনের রেশমী জামা ১ মিটারের বেশী লম্বা, দুটো হাতা টেনে সোজা করলে প্রায়২ মিটার লম্বা, অথচ জামাটির ওজন মাত্র ২৮ গ্রাম। এই লম্বা জামা ভাজ করে গুটিয়ে রাখলে এক হাতের মুঠোর মধ্যেই ধরা যায়। এই জামা গায়ে দিলে সত্যই প্রাচীন গ্রন্থে লিপিবদ্ধ বর্ণনার মতো : “ ঝিঁঝিঁ পোকার ঝিল্লির(পাতলা খোলসের) মতো পাতলা এবং ধোঁয়ার মতো হাল্কা ”। এতে তখনকার চীনের বস্ত্রশিল্পের প্রযুক্তির উত্কর্ষ পুরোপুরি প্রতিফলিত হয়েছে । সমাধিটিতে আবিষ্কৃত রেশমী কাপড়ের ওপর প্রাচীন লিপি এবং বাঁশের ফলকের ওপর লেখাগুলোর মধ্যে ছিল বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন জ্যোতির্বিদ্যা গ্রন্থ “ উ সিং চান(পাঁচ নক্ষত্র জ্যোতিষ)” এবং “ জ্যোতিশাস্ত্র ও আবহাওয়াবিদ্যা”। আরও আছে চীনের সবচেয়ে প্রাচীন চিকিত্সাগ্রন্থ “মাই ফা( নাড়িজ্ঞান শাস্ত্র)” এবং “ ৫২ ব্যাধির ব্যবস্থাপত্র” ইত্যাদি । মাওয়াংতুই’র হান রাজবংশীয় আমলের সমাধিতে আবিষ্কৃত প্রচুর সংখ্যক রেশমী কাপড়ের লিপিবদ্ধ গ্রন্থগুলোর বিষয়বস্তুও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তা অনেক মাত্রায় চীনের আগেকার অনেক বিদ্যাগত মতবাদ এবং গতানুগতিক ধ্যানধারণার পরিবর্তন ঘটিয়েছে।
ছাংশার মাওয়াংতুই সমাধির প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজ চীনের প্রত্নতত্ত্ব মহলের ওপর গভীর ও সুদুরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করেছে । বিশেষজ্ঞদের মতে , এই সমাধিতে সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস ছিল অক্ষত অবস্থায় সংরক্ষিত প্রাচীন মৃতদেহ এবং ধারাবাহিক পুরো সেট জিনিসপত্র এবং বিষয়বস্তুতে সমৃদ্ধ আর প্রচুর সংখ্যক প্রাচীন লিপি, যা রেশমী কাপড় ও বাঁশের ফলকগুলোতে লিখিত । উপরোক্ত তিন ধরনের জিনিসের যে কোনো একটি আবিষ্কৃত হলেই গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার বলে গণ্য করা যায় । এখন তিনটা একসঙ্গে পাওয়া গেছে, চীনের প্রত্নতত্ত্বের ইতিহাসে এর পূর্বনজীর ছিল না। তাই মাওয়াংতুই’র হান রাজবংশীয় আমলের সমাধির খননকাজকে “ বিংশ শতাব্দীতে চীন ও বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারের অন্যতম” বলে গণ্য করা হয়।”
|