ইংরেজী ‘চায়না’ শব্দটার দুটো অর্থ: একটি হলো “চীন”, অন্য অর্থ হলো “চীনা মাটি “। বাংলা ভাষায় ‘চীনা মাটি’ শব্দ থেকে সহজেই আন্দাজ করা যায় চীনা মাটির উত্পত্তি চীনে। প্রাচীন কাল থেকে চীনকে “চীনা মাটির দেশ” বলা হতো । তা’হলে চীন আর চীনা মাটির মধ্যে আসলে কি-রকম সম্পর্ক , তার ইতিহাস বা কি-রকম?
প্রাচীন তথ্য থেকে প্রমাণিত হয়েছে, উন্নত মানের চীনা মাটি চীনের প্রাচীন কালের প্রাথমিক ধরনের ‘ছিংছি’ চীনা মাটি থেকে বিকশিত হয়। ‘ছিংছি হলো মাটির পাত্র এবং চীনা মাটির মধ্যে এক মাঝারি ধরনের জিনিসপত্র। এটার যেমন চীনা মাটির বৈশিষ্ট্য আছে , তেমনই মাটির পাত্রের বৈশিষ্ট্যও আছে। চীনের সবচেয়ে প্রাচীন ‘ছিংছি” চীনা মাটি আবিষ্কৃত হয় উত্তরচীনের শানসি প্রদেশের সিয়াসিয়েন জেলার ‘লোংশান সংস্কৃতির’ ধ্বংসাবশেষ থেকে, এটা ছিল ৪২০০ বছর আগেকার জিনিস।
চীনের সত্যিকারের চীনা মাটি দেখা দেয় পূর্ব হান রাজবংশের আমলে( ২৩-২২০ খৃষ্টাব্দ)। দক্ষিণপূর্ব চীনের চেচিয়াং প্রদেশেই এই সত্যিকারের চীনা মাটির জিনিসপত্র সবচেয়ে আগে দেখা দিয়েছে।তার পর চীনা মাটি তৈরির প্রযুক্তি দক্ষিণ থেকে উত্তর অঞ্চলে বিস্তার লাভ করে এবং উল্লেখযোগ্য উন্নতি অর্জিত হয়। এর মধ্যে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল সাদা রঙের চীনা মাটির জিনিসের উত্পত্তি। খুব প্রাচীন কালের ‘ছিংছি’ চীনা মাটির রঙ ধূসর বা গাঢ় ধুসর ছিল, কারণ তার কাঁচা মাল হিসেবে মাটির ভেতরে লোহার উপাদান বেশি ছিল। সাদা চীনা মাটির কাঁচা মাল হিসেবে মাটিতে লোহার উপাদন কম বলে রঙ সাদা হয় । চীনা মাটির উপরি ভাগে যে চকচকে প্রলেপ মাখা হয় , তা ইংরেজী ভাষায় ‘গ্লেজ’ বলা হয়। প্রথম দিকে এই গ্লেজের রঙ এক ধরনের । তার পর বহু রঙের গ্লেজ দেখা গেছে এবং রংবেরঙের সুন্দর চীনা মাটির জিনিসপত্র তৈরি হলো। চীনা মাটির কাঁচা মাল হিসেবে মাটি সাদা হলে সহজেই তার উপরিভাগে রংবেরঙের গ্লেজ মেখে দেয়া যায়। তাই সাদা চীনা মাটির উত্পত্তি চীনা মাটির উন্নয়নের ইতিহাসে গভীর ও সুদুরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করেছে।
খৃষ্টীয় দশম আর ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথম দিক পর্যন্ত(থাং এবং সোং রাজবংশের সময়পর্বে) চীনে চীনা মাটি শিল্পের প্রযুক্তির উন্নয়ন অব্যাহতভাবে চলেছে । থাং রাজবংশের সময়ে সাধারণ মাটির জিনিসপত্রের ওপর চীনা মাটির তিন রঙের গ্লেজ প্রলেপ দেয়া হয়। মাটি আগুনের তাপে প্রক্রিয়াকরণের সময়ে রাসায়নিক ক্রিয়া সংঘটিত হয় , ফলে রঙ আরও সুন্দর আর পাকাপোক্ত হয়। এটাই ‘থাংসানছাই’ অর্থাত্ থাং রাজবংশের তিন রঙের চীনা মাটি । থাং আমলের তিন রঙের চীনা মাটি শিল্পে অবলম্বন করা হয়েছে চীনের ঐতিহ্যিক পেইণ্টিং( ছবি আঁকা) এবং ঐতিহ্যিক ভাস্কর্য শিল্প প্রভৃতি কারু-শিল্পকলার কৌশল আর বৈশিষ্ট্য । একটি মাটির জিনিসের ওপর লাল, সবুজ আর সাদা তিন রকম রঙের গ্লেজ প্রলেপ দেয়া হয়, তার পর এটা উচ্চ তাপে প্রক্রিয়াকরণের পর তিন রঙের গ্লেজ পরস্পরের সঙ্গে মিশে গিয়ে রংবেরঙের হয়ে যায় । তার বৈচিত্র্য সত্যই অপূর্ব। এটাই থাং রাজবংশের তিন রঙের চীনা মাটির বৈশিষ্ট্য।
মিং রাজবংশ( ১৩৬৮-১৬৪৪ খৃষ্টাব্দ), ছিং রাজবংশ (১৬৪৪-১৯১১) এই দুই রাজবংশের সময়পর্ব হলো চীনা মাটি উত্পাদনের স্বর্ণযুগ, এই সময়পর্বে চীনা মাটির উত্পাদনের পরিমাণ এবং গুণগত মান উত্কর্ষের শীর্ষে পৌছেছে । দক্ষিণচীনের চিংতেচেং শহর “ চীনা মাটির রাজধানী” হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে , চীনের চীনা মাটি শিল্পের ক্ষেত্রে চিংতেচেং চীনা মাটির প্রাধান্য কয়েক শো বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয় । আজও চীনের সবচেয়ে উন্নত ধরনের চীনা মাটি এখানে উত্পন্ন হয় । চীন থেকে চীনা মাটির জিনিসপত্র বিদেশে রপ্তানী করা শুরু হয় অষ্টম শতাব্দী থেকে । এর আগে চীনের রেশমী কাপড় ইত্যাদি পণ্য “ সিল্ক রোড”(রেশম পথ) বেয়ে পশ্চিমের দেশগুলোতে রপ্তানী করা হতো । ঐ পথ ছিল চীন আর বিদেশের বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের গুরুত্বপূর্ণ পথ । চীন “ রেশমের দেশ” বলে সুপরিচিত ছিল । অষ্টম শতাব্দীতে চীন থেকে চীনা মাটির পণ্যদ্রব্য রপ্তানী করার সঙ্গে সঙ্গে চীন আবার “ চীনা মাটির দেশ” নামেও সারা বিশ্বে সুপরিচিত হতে শুরু করে ।
চীনের চীনা মাটি সামগ্রিপ্রথম দিকেপ্রধানতএশিয়া অঞ্চলে রপ্তানী করা হতো। সপ্তদশ শতাব্দীতেপশ্চিম ইউরোপেররাজপরিবার ও রাজপ্রাসাদেচীনা মাটির জিনিসপত্র সংগ্রহেরহিড়িক দেখা যায় ।পর্তুগিজরা নতুনসামুদ্রিক পথখুঁজে বের করার পরচীনা মাটির জিনিসপত্র ইউরোপীয় সমাজে সবচেয়ে মূল্যবান উপহার-সামগ্রীতে পরিণত হয় । এই সময়পর্বইউরোপেররোকোকোশিল্পকলা - শৈলীপ্রচলিতহয় ।এই শিল্প-শৈলীর বৈশিষ্ট্য ছিল : প্রাণবন্ততা, সৌন্দর্য্য, সুমার্জিততা এবং স্বাভাবিকতা । এইইউরোপীয়শিল্প শৈলীচীনের শিল্প শৈলীর সঙ্গে ভিন্ন পথেএগিয়ে চললেওমূলত মিলেযায় । চীনা শৈলীর বৈশিষ্ট্য ছিলনিখুঁত , নম্র ,সূক্ষএবংশিষ্ট রুচি।মোটামুটি মিল থাকার কারণেচীনা মাটি সহচীনা শৈলিরকারুশিল্পজাত দ্রব্যগোটা ইউরোপেপ্রচলিত হয়েছে । এক অসম্পূর্ণ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সপ্তদশ শতাব্দীতেপ্রতি বছর চীন থেকেচীনা মাটির দু’ লক্ষ জিনিসপত্র রপ্তানী করা হতো,অষ্টাদশ শতাব্দীতেসবচেয়েবেশি- বছরে প্রায় দশ লক্ষ চীনা মাটির জিনিস রপ্তানী করা হয় ।চীনা মাটির জিনিসপত্রসারা বিশ্বেখুব বিক্রীহয় , এটা বিশ্বজনীনপণ্যদ্রব্য হয়ে দাঁড়ায়। চীনা মাটি রপ্তানীর সঙ্গে সঙ্গেচীনের সুনাম ব্রিটেন ও ইউরোপ মহাদেশেব্যাপকভাবেছড়িয়ে পড়ে । চীন এবং চীনা মাটির সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য হয়েছে। বিদেশে ‘চীনা মাটি ’ শব্দটা কখন থেকে প্রচলিত হয়েছে, তা ধার্য করামুশকিল হলেও , নি:সন্দেহেবলা যায় , প্রাচীন কালের চীনা মাটি শিল্পেরউত্কর্ষ ও সফলতার কারণেচীনা মাটিরপ্রসার লাভ করেছে , ফলেচীনের এই বিশিষ্ট জিনিস বিশ্ববাসীদের মধ্যে সমাদৃত হয়েছে । চীন এবং চীনামাটি চিরকালের মতো অবিচ্ছেদ্য হয়েছে ।
|