চীন দেশে এক প্রবাদ আছে: “ইয়েলাং রাজার হাম বড়া” , এর অর্থ অনেকটা “কুয়োর ব্যাঙ” । এর পেছনে একটি কাহিনী রয়েছে : দু হাজারেরও বেশি বছর আগে দক্ষিণপশ্চিম চীনের একটি মালভূমি ও পার্বত্য এলাকায় একটি রাজ্য ছিল, তার নাম ইয়েলাং । রাজ্যটি শতাধিক বছর সমৃদ্ধিশালী ও বেশ শক্তিশালী ছিল, কিন্তু পরে তা ইতিহাসে যেন উল্কার মতো এক ঝিলিক মেরে আবার অদৃশ্য হয়ে গেল । বর্তমান শতাব্দির শুরুতে চীনের প্রত্নতত্ত্ববিষয়ক কর্মীরা কুইচৌ প্রদেশের হোচাং জেলায় প্রাচীন সমাধিসমূহের খননকাজ চালিয়েছেন এবং প্রাথমিকভাবে প্রাচীন ইয়েলাং রাজ্যের রহস্য ভেদ করেছেন।
২০০১ সালেরসেপ্টেম্বরে দক্ষিণপশ্চিম চীনেরকুইচৌ প্রদেশের হোচাংজেলার‘কোলো’ থানায় একপ্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজেপ্রাচীন ইয়েলাং রাজ্য- আমলের ১০৮টি কবরআবিষ্কৃত হয়েছে ।প্রাচীন ইয়েলাং রাজ্যের প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানেএবারই সবচেয়েবেশি পুরাকীর্তি নিদর্শনপাওয়া গেছে।প্রাচীনইয়েলাং রাজ্যের সংস্কৃতিও ইতিহাস গবেষণার জন্য এটা খুবই তাত্পর্যপূর্ণ। এই প্রত্নতাত্ত্বিকআবিষ্কারকে২০০১ সালে “চীনেরদশটি বৃহত্তম প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারের” অন্যতম হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছে। প্রাচীন ইয়েলাং রাজ্য ছিলচীনের দক্ষিণপশ্চিম অঞ্চলের এক বেশ শক্তিশালী সংখ্যালঘু জাতির রাজ্য । ইয়েলাং রাজ্য খুব সম্ভব খৃষ্টপূর্ব তৃতীয় শতক থেকেখৃষ্টীয়প্রথম শতক পর্যন্তবিদ্যমান ছিল। খৃষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে চীনের পশ্চিম হান রাজবংশীয় আমলেরবিখ্যাতইতিহাসবিদসিমা ছিয়েনহান রাজবংশের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গেচীনের দক্ষিণপশ্চিম অঞ্চলেরবিভিন্ন সংখ্যালঘু জাতির প্রশাসনিক এলাকাসফর করেছেন। তিনি তাঁর রচিত“সিচি. দক্ষিণপশ্চিমঅঞ্চলের উপজাতিসমূহের ইতিহাস” নামকঐতিহাসিক গ্রন্থে লিখেছিলেন,দক্ষিণপশ্চিমঅঞ্চলেরউপজাতিগুলোর মধ্যেসবচেয়ে শক্তিশালীউপজাতি হলো ইয়েলাং, তার ১ লক্ষ সৈন্য এবংনদীতে সর্বত্রই ইয়েলাংদের নৌযান চলাচল করছে, এলাকাটা খুবই সমৃদ্ধিশালী। ইয়েলাংয়ের রাজাপশ্চিম হান বংশের সম্রাটের দূতের সঙ্গেআলাপ করার সময়প্রশ্ন করলেন, “ তোমাদের হান রাজবংশবড় না আমাদের ইয়েলাং রাজবংশ বড়?”আসলে তখনকারহান রাজবংশেররাষ্ট্রীয় ভূখণ্ডের অন্তর্ভুক্তছিলআজকেরসুবিশাল চীনের বেশির ভাগঅঞ্চল। ইয়েলাং রাজ্য বরংদূরদূরান্ত পার্বত্যঅঞ্চলে অবস্থিত এবং ইয়েলাং রাজা জানতেন না,আয়তন আর শক্তির দিক থেকেপশ্চিম হান সাম্রাজ্যআর ইয়েলাং রাজ্যের মধ্যেব্যবধান খুবই বেশী। তাই ইয়েলাং রাজা এরকম প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে ফেলেছেন। তখন থেকে “ ইয়েলাং রাজারহাম বড়া” কথাটা এক প্রবাদএবংউপহাসের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটাই২০০০ বছর আগেইয়েলাং রাজ্যের অস্তিত্বের এক ভালপ্রমাণ।
প্রাচীন ইয়েলাং রাজ্যের ছিল এক চমত্কার সংস্কৃতি , যার বিষয়বস্তু সমৃদ্ধ এবং অত্যন্ত আকর্ষণীয় । তবে চীনের ইতিহাসে তা উল্কার মতো ক্ষণস্থায়ীভাবে নিজের জাঁকজমক দেখানোর পর আবার ইতিহাসের অন্ধকারে বিলীন হয়ে গেছে । তার পর চীনের প্রশাসনিক বিভাজনের পরিবর্তন ঘন ঘন ঘটেছে এবং জাতিসত্ত্বাগুলোর স্থানান্তরও প্রায়ই ঘটতে থাকে , এ সম্পর্কে তথ্যও খুব কম ছিল বলে ইয়েলাং রাজ্যের ইতিহাস বরাবরই আবছা আবছা ছিল , এটা চীনের সংখ্যালঘু জাতিসমূহের প্রাচীন ইতিহাসে এক গোলক- ধাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইয়েলাং রাজ্যের বেশির ভাগ ভুখণ্ড বর্তমান কুইচৌ প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত । কুইচৌ প্রদেশের হোচাং জেলায় এখনও টিকে আছে এক বিরাট এবং উঁচু মঞ্চ, এখানে দাঁড়িয়েই প্রাচীন ইয়েলাং রাজা সৈন্য ও সেনাপতিদের সমাবেশ করতেন । এই এলাকায় মাটি খনন করে বার বার সেই আমলের ( অর্থাত্ প্রাচীন চীনের ছিন এবং হান রাজবংশীয় আমল) টালি আবিষ্কৃত হয়েছে, তাতে অনুমান করা যায়, তখনকার ইয়েলাং রাজ্য কতোই না সমৃদ্ধিশালী ছিল। প্রাচীন ইয়েলাং রাজ্যের প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান হলো কুইচৌ প্রদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প । হোচাং জেলার কোলো থানা-এলাকায় প্রাচীন সমাধিসমূহে খনন কাজ চালানো হয়েছে, তাতে আবিষ্কৃত হয়েছে প্রাচীন ইয়েলাং রাজ্যের বিশেষ সমাধি-প্রথা । এটা ২০০১ সালে “ চীনের দশটি বৃহত্তম প্রত্নতাত্ত্বিক নতুন আবিষ্কারের” তালিকাভুক্ত হয়েছে।
হোচাং জেলায় আবিষ্কৃত প্রাচীন সমাধিসমূহ ঘন ঘনভাবে বিন্যস্ত , তবে প্রতিটি কবর বড় নয়, সাধারণত শুধু ৩ মিটারের কম লম্বা, এবং ১ মিটারের সামান্য বেশী চওড়া। কিন্তু সমাহিত করার পদ্ধতি খুব অদ্ভুত। সামাধিস্থ অনেক মৃতদেহের মাথায় ঢাকা ছিল ব্রোঞ্জের হাঁড়ি । মাথা ঢাকার পদ্ধতিও ভিন্ন ভিন্ন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্রোঞ্জের হাঁড়ি বা কড়াই দিয়ে মাথা ঢেকে রাখা ছাড়াও অন্য একটি ব্রোঞ্জের কড়াই দিয়ে পা ঢেকে রাখা হয় । কোনো কোনো কবরে একটি ব্রোঞ্জের বাটি দিয়ে মুখ ঢেকে রাখা হয়। কোনো কোনো কবরে মৃতদেহের পায়ের নিচে একটি বড় আকারের ব্রোঞ্জের গামলা রাখা হয়, বাহুর কাছে রাখা হয় ব্রোঞ্জের বাটি । তা’ছাড়া অন্য কিছু কবরে মৃতদেহের মুখ ঢাকার জন্য রাখা হয় ব্রোঞ্জের বাটি । আর কিছু কবরে মৃতদেহের মাথার নিচে রাখা হয় ব্রোঞ্জের গামলা । কোনো কোনো মৃতদেহের পাশে রাখা হয় ব্রোঞ্জের বল্লম। ব্রোঞ্জের পাত্র দিয়ে মৃতদেহের মাথা ঢাকার এই বিশেষ সমাধিপ্রথা চীনের অন্যান্য অঞ্চলে কখনও আবিষ্কৃত হয় নি । এটা ইয়েলাং জাতির বিশেষ সমাধিপ্রথা। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এই বিশেষ সমাধিপ্রথায় প্রতিফলিত হয়েছে যে, ইয়েলাং জাতির জনগণ আত্মার পূজা করেন এবং ব্রোঞ্জের কড়াই , হাঁড়ি, বাটি , গামলা ইত্যাদি পাত্র বিশেষভাবে পূজা করেন । অন্য বিশেষজ্ঞরা আবার মনে করেন, এই বিশেষ সমাধিপ্রথার আসল অর্থ এবং ধর্মীয় ধারণা নিয়ে আরও গভীর গবেষণা চালানো দরকার।
কোলো থানায় প্রাচীন কবরস্থান থেকে আবিষ্কৃত ব্রোঞ্জের পাত্র আর জিনিসপত্র থেকে প্রমাণিত হয়েছে , প্রাচীন কালে চীনের অন্যান্য অংশের মতো কুইচৌ প্রদেশেও ব্রোঞ্জের শিল্প ছিল এবং কুইচৌ প্রদেশের প্রাচীন কালের ব্রোঞ্জ শিল্পের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য, অর্থাত্ ইয়েলাং জাতির অনন্যসাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল । আবিষ্কৃত ব্রোঞ্জের জিনিসপত্র খুবই মূল্যবান, বিশেষ করে গবেষণার জন্য খুবই তাত্পর্যপূর্ণ। যেমন, কবরে আবিষ্কৃত কোনো কোনো ব্রোঞ্জের পাত্রের আকৃতি ঢাকঢোলের মতো, কড়াইয়ের মতো এবং ব্রোঞ্জের বিশেষ ধরনের বল্লম এবং তরোয়ালও পাওয়া গেছে। চীনের মধ্যসমতল ভূমি এলাকায় পাওয়া ব্রোঞ্জের পাত্র ও জিনিসপত্রের শৈলী থেকে এগুলো ভিন্ন ধরনের। তাতে মনে হয় ইয়েলাং জাতির ব্রোঞ্জ সংস্কৃতি স্বতন্ত্র। হোচাং জেলার কোলো থানায় আবিষ্কৃত এই প্রাচীন সমাধিসমূহ লিখিত ভাষা নয়, বরং বাস্তব জিনিসপত্র দিয়ে ইতিহাসের সুদীর্ঘ নদীর স্রোতে ইয়েলাং রাজ্যের চিহ্ন “লিপিবদ্ধ” করেছে। দু হাজার বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া এই প্রাচীন রাজ্যের অবস্থা সম্পর্কে অন্তত কিছু তথ্য জানা গেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রাচীন ইয়েলাং রাজ্যের ইতিহাস সম্পর্কিত ধাঁধা ভেদ করার চাবিকাঠি হয়তো এই সমাধিসমূহের ভেতরেই লুকিয়ে আছে ।
|