মানছেং জেলায় আবিষ্কৃত হান রাজবংশের সমাধি এবং ‘সোনার সূতার জেড-পোষাক’

          চীনের পশ্চিম হান রাজবংশের আমলে( খৃষ্টপূর্ব ২০০ সাল--খৃষ্টীয় ৮ সাল) লোকদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল এই যে, জেডপাথরের পোষাক পরলে মৃতদেহ পঁচে যাবে না, তাই সম্রাট আর অভিজাতদের মৃত্যুর পর তাঁদের মৃতদেহে বর্মের মতো একরকম পোষাক --সোনার সূতায় গাঁথা জেডপাথরের পোষাক পরানো হয় । সোনার সূতা দিয়ে ছোট ছোট জেডপাথরের টুকরা একত্রে গাঁথা হয়, এটাই সংক্ষেপে‘সোনার সূতার জেডপোষাক’ বলা হয়। ১৯৬৮ সালে উত্তরচীনের হোপেই প্রদেশের মানছেং জেলায় প্রত্নতত্ত্বকর্মীরা প্রথমবারের মতো এমন একটি সম্পূর্ণ ‘সোনার সূতার জেড পোষাক’ আবিষ্কার করেন। এটি এক অতি বিরল পূরাকীর্তির নিদর্শন। 

  হান বংশের এই সমাধি পেইচিং থেকে দু শ’ কিলোমিটারের বেশি দূরে হোপেই প্রদেশের মানছেং জেলায় অবস্থিত । এটা পশ্চিম হান রাজবংশ আমলের অন্যতম স্থানীয় রাজ্য--চোংশান রাজ্যের রাজা লিউ শেং এবং তাঁর স্ত্রী তৌ ওয়ানের যৌথ সমাধি। ঐতিহাসিক গ্রন্থের তথ্য অনুযায়ী , ১৫৪ খৃষ্টাব্দে লিউ শেংকে চোংশান রাজ্যের রাজা নিযুক্ত করা হয় । লিউ শেং ৪২ বছর ধরে রাজত্ব করেন, এবং তিনিই চোংশান রাজ্যের প্রথম রাজা। 

  লিউ শেংয়ের সমাধি একটি বিচ্ছিন্ন পাহাড়ের ওপর নির্মিত । গোটা পাহাড়ই তাঁর কবর । কবরটি ভিন্ন ভিন্ন অথচ একত্রেসংযুক্ত কক্ষ ছিল : শয়নকক্ষ, বৈঠকখানা এবং সঙ্গীত কক্ষ ইত্যাদি। এই সমাধি যেন পাহাড়ী গুহার ভেতরকার এক জাঁকজমকপূর্ণ রাজপুরী । 

  গোটা ‘রাজপুরীর’ কাঠামো দেখলে বোঝা যায়, রাজা লিউ শেংয়ের সমাধিটি যত্নের সঙ্গে ডিজাইন করা হয়েছিল। এটা এক বড় এবং কষ্টসাধ্য প্রকল্প ছিল। একটি পাথরের পাহাড়ের গায়ে এতো বিরাট গুহা কেটে সমাধি তৈরি করতে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি দিয়েও শতাধিক লোকের এক বছরের মতো সময় লাগবে। 

  লিউ শেংয়ের সমাধি থেকে আবিষ্কৃত প্রচুরসংখ্যক জিনিসপত্র সুশৃংখলভাবে রাখা হয়েছিল, এর মধ্যে মাটির জিনিসপত্রের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি, সংখ্যার দিক থেকে তার পর ব্রোঞ্জ, লোহা এবং সোনা ও রূপার জিনিসের স্থান। তার মধ্যে বিশ্ববিখ্যাত মূল্যবান জিনিস হলো: ‘সোনার সূতার জেডপোষাক’। 

  ‘সোনার সূতার জেড-পোষাক ’ সাধারণত এইভাবে তৈরী করা হয় : নানা আকারের জেড পাথরের টুকরা, যেমন আয়তাকার, বর্গাকার, ট্র্যাপেজিয়াম, ত্রিভূজ আকার, চতুর্ভূজ আকার এবং বহুভুজ আকারের জেডপাথরের টুকরাগুলোকে সোনার সূতা দিয়ে একত্রে গাঁথা হলে এই পোষাক তৈরী হয় । তবে এই পোষাক পাঁচটি ভাগে বিভক্ত : মাথার অংশ, জামার অংশ, প্যাণ্টের অংশ ,হাতপাঞ্জার অংশ এবং পায়ের অংশ । গোটা জেড-পোষাক প্রায় দুই মিটার লম্বা, এতে মোট ২৪৯৮ টুকরা জেডপাথর ব্যবহার করা হয়েছে। সোনার সূতার মোট ওজন ১.১ কিলোগ্রাম। জেড-পোষাকের পাঁচ ভাগের প্রত্যেক ভাগ আবার কয়েক অংশে বিভক্ত । যেমন জেডপোষাকের মাথার অংশটা আবার ‘চোখের আবরণ’ ,নাকের ছিপি , কানের ছিপি এবং মুখের ছিপি আছে । পেটের অংশের নিম্নভাগে আছে লিঙ্গের ঢাকনা এবং মলদ্বারের ছিপি। এগুলো সবই জেডপাথর দিয়ে তৈরী। 

  বিশেষজ্ঞরা গবেষণা চালিয়ে জানতে পেরেছেন, এই সোনার সূতার জেডপোষাক তৈরীর প্রক্রিয়া খুবই জটিল। মৃতদেহের আকৃতি অনুসারে জেডপাথরের বড় খণ্ড কেটে ছোট- বড় নানা সাইজের টুকরা করতে হয় এবং সেগুলো ঘষামাজা করে পাতলা এবং ঝকঝকে করতে হয়। তার পর প্রতিটি টুকরার চার কোণে চারটি ছোট ছিদ্র ড্রিলিং করতে হয় । মেপে দেখা গেছে, দুটি জেডপাথরের টুকরার মধ্যেকার ফাঁক মাত্র ০.৩ মিলিমিটার , জেডপাথরের টুকরার প্রতিটি ছিদ্রের ব্যাস মাত্র ১ মিলিমিটার। এতো প্রাচীন কালের যে সব মিস্ত্রী এমন সূক্ষ্ম কাজ করেছেন, তাঁদের নৈপুণ্যের উত্কর্ষ আজও বিশ্ববাসীদের তাক না লাগিয়ে পারে না। 

  রাজা লিউ শেংয়ের সোনার সূতার জেডপোষাকের মতো তাঁর স্ত্রী তৌ ওয়ানের সমাধিতেও একটি ‘সোনার সূতার জেডপোষাক’ আবিষ্কৃত হয়েছে । এই পোষাকও একইভাবে ৫ ভাগে বিভক্ত । শুধু সাইজ কিছু ছোট। দুজনের ‘সোনার সূতার জেডপোষাকই’ অক্ষত অবস্থায় পাওয়া গেছে। চীনের কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজে এটাই প্রথমবারের মতো আবিষ্কৃত পূরো সেট ‘ সোনার সূতার জেডপোষাক’ । ফলে লোকেরা হান রাজবংশের ‘সোনার সুতার জেডপোষাকের’ এক বাস্তব নমুনা পেয়েছেন এবং তার রূপ ও কাঠামো জানতে পেরেছেন ।

  এই সুন্দর জেডপোষাক ছাড়াও রাজা লিউ শেংয়ের সমাধিতে সোনা ও রূপার সূচ( আকুপাংচারের সূচ) এবং ‘ চিকিত্সাকর্ম’ শব্দ খোদিত ব্রোঞ্জের গামলা আবিষ্কৃত হয়েছে । এটা চীনের প্রাচীন আকুপাংচার বিদ্যা এবং চিকিত্সাবিদ্যার ইতিহাস গবেষণার জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। লিউ শেংয়ের তলোয়ার যাচাই-বিশ্লেষণ করার পর জানা গেছে, তা বারংবার পিটানো হয়েছে এবং তার উপরি ভাগ রাসায়নিক পদ্ধতিতে প্রক্রিয়াকরণ করা হয়েছে , এটা চীনের প্রাচীন ইস্পাত শিল্পের উল্লেখযোগ্য সাফল্য। 

  মানছেং জেলার হান রাজবংশীয় আমলের সমাধি খুবই মূল্যবান বলে ১৯৮৮ সালে এই সমাধি চীন-সরকারের ধার্য করা জাতীয় পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ পুরাকীর্তি নিদর্শনের তালিকাভুক্ত হয়েছে।