মিং বংশের সম্রাটদের ১৩টি সমাধির প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান

      মিং বংশের সম্রাটদের ১৩টি সমাধির ইতিহাস রাজদরবারের এক অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহের সঙ্গে জড়িত। মিং রাজবংশের প্রথম সম্রাট চু ইউয়ানচাং চীনের দক্ষিণপূর্ব অংশের নানচিংয়ে রাজধানী স্থাপন করেন, মৃত্যুকালে তিনি তাঁর সিংহাসন তাঁর নাতীকে দেন।কিন্তু চু ইউয়ানচাংয়ের চতুর্থ ছেলে চু লি তা মেনে নিতে পারেন নি বলে সিংহাসন দখল করার জন্য গৃহযুদ্ধ বাধিয়ে দেন এবং জয়ী হয়ে নতুন সম্রাট হন । তিনি পুরানো রাজধানী নানচিং দখল করেন, কিন্তু চু ইউয়ানচাংয়ের নাতিটি নিখোঁজ হন । এটা আজ পর্যন্তও মিং রাজবংশের ইতিহাসে এক অমীমাংসিত সমস্যা বা ধাঁধা। চু লি সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হবার পর ভাবলেন, নানচিং নিরাপদ নয়। তাই তিনি রাজধানী নানচিং থেকে পেইচিংয়ে স্থানান্তরিত করলেন। সম্রাট চু লির শাসনামলেই লোকজনকে নিয়োজিত করে নিজের জন্য সমাধিস্থান বেছে নেয়া হয় । অনেক খোঁজাখুজি এবং বাছাইয়ের পর পেইচিংয়ের উত্তরপশ্চিম উপকণ্ঠের এক নয়নাভিরাম দৃশ্য-সম্পন্ন জায়গা বেছে নেয়া হয়েছে। জায়গাটা পাহাড়ের কাছে, সহজেই রক্ষা করা যায়, বাইরে থেকে আক্রমণ করা খুব কঠিন। এখানে সম্রাট চু লি নিজের সমাধি নির্মাণের আদেশ দেন। তার সমাধির নামকরণ হলো ছাংলিং সমাধি । ছাংলিং সমাধির নির্মাণ কাজ ১৪০৯ খৃষ্টাব্দে শুরু হয়। তখন থেকে ১৬৪৪ খৃষ্টাব্দে মিং রাজবংশের পতন পর্যন্ত মোট দু শো বছরেরও বেশী সময় ধরে পর্যায়ক্রমে ১৩ জন সম্রাটের সমাধি নির্মাণ করা এবং তাঁদের মৃতদেহ সমাধিস্থ করা হয়েছে এই এলাকায়। এটাই মিং বংশের সম্রাটদের সমাধিসমূহ । সংক্ষেপে এটাকে মিং বংশের ১৩ সমাধি বলা হয়। 

  এই ১৩ সমাধির স্থাপত্যশৈলী ও কাঠামো মোটামুটি মিং বংশের প্রথম সম্রাটের সমাধির অনুরূপ। সমাধি -এলাকার মাঝখানে একটি রাজকীয় মর্যাদাসম্পন্ন ‘দৈবপথ’ আছে। সমাধি-এলাকার সামনের একটি উঁচু আর বিরাট আকারের পাথরনির্মিত স্মৃতিসূচক তোরণ, এটা ৪৫০ বছর আগে নির্মাণ করা হয়েছে। এই পাথরের তোরণ অক্ষত অবস্থায় সংরক্ষিত রয়েছে , এটা বিরাট মার্বেল পাথর দিয়ে তৈরী, ওপরে নানা রকম চমত্কার ভাস্কর্যশিল্পকর্ম খোদিত রয়েছে । মিং এবং ছিং রাজবংশের আমলে এরকম সুন্দর পাথরের তোরণ খুব বিরল। এই তোরণের পেছন দিকে অদূরেই গোটা সমাধি এলাকার প্রধান ফটক । তার চীনা নাম ‘তাগোংমেন’ ,অর্থাত্ প্রাসাদের বড় ফটক। এই প্রধান ফটক দিয়েই সম্রাটরা সমাধিতে শ্রদ্ধানিবেদন করতে যেতেন । এই প্রধান ফটক থেকে পাহাড় ও নদী বরাবর প্রায় ৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ এক বৃত্তাকার প্রাচীর নির্মিত রয়েছে, যার ভেতরেই মিং সম্রাটদের১৩টি সমাধি । এই প্রাচীরে আছে দশটি প্রবেশপথ । অতীতে প্রতিটি প্রবেশপথেই সমাধি-এলাকার নিরাপত্তা রক্ষার জন্য মোতায়েন ছিল প্রচুর সৈন্য। ১৩টি সমাধির প্রত্যেকটির সমাধি-তত্ত্বাবধায়ক, উদ্যান তত্ত্বাবধায়ক এবং রক্ষীবাহিনীর অধিনায়ক নিয়োজিত ছিলেন। সমাধি-তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব পালন করতেন রাজপ্রাসাদের খোজা। উদ্যানের তত্ত্বাবধায়ক ফলমূলের চাষ পরিচালনা করতেন , সমাধিতে যজ্ঞানুষ্ঠানে প্রচুর উত্কৃষ্ট ফলমূল প্রয়োজন। সমাধির রক্ষী বাহিনীর দায়িত্ব গোটা সমাধি রক্ষা করা। 

(ছবি: ‘ দৈবপথ’)

  সম্রাটরা তাঁদের সমাধি চিরস্থায়ীভাবে সংরক্ষণের জন্য অনেক রূপকথা বা কাহিনী রচনা করে প্রচার করেন এবং সমাধি (বিশেষ করে পাতালপুরী) খুব গোপনে রাখার কড়াকড়ি ব্যবস্থা নেন । তাই বিভিন্ন সমাধির পাতালপুরীর ওপর বরাবরই এক রহস্যপূর্ণ “ রং” লাগানো হয়ে থাকে। ১৩টি সমাধির মধ্যেকার তিংলিং সমাধি হলো এই সব সমাধির মধ্যে সবচেয়ে রহস্যময় একটি, বিশেষ করে তার পাতালপুরি সম্পর্কে কেউই কিছুই জানতো না। ১৯৫৬ সালের মে মাসে চীনের প্রত্নতত্ত্বকর্মীরা তিংলিং সমাধির পাতালপুরীর প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজ শুরু করেন। তিংলিং সমাধির পাতালপুরীর মোট আয়তন ১১৮৫ বর্গমিটার। এটি পাঁচটি কক্ষে বিভক্ত : সামনের কক্ষ, মধ্য কক্ষ, পেছন কক্ষ, বাম কক্ষ এবং ডান কক্ষ। এই পাঁচটি কক্ষ পরস্পর সংযুক্ত। এগুলো সম্পূর্ণভাবে পাথর দিয়ে বাঁধানো। সম্রাটের কফিনবাহী গাড়ি পাতালপুরীতে প্রবেশ করার সময়ে পাথরের মেঝের যাতে কোনো ক্ষতি না হয়, তার জন্য মেঝেতে মোটা তক্তা বিছানো । এই তক্তা পাতালপুরীর সামনের কক্ষ থেকে পেছন কক্ষ পর্যন্ত মেঝের ওপরে থেকে গেছে । মধ্য কক্ষে রয়েছে তিনটি মার্বেল পাথরের সিংহাসন, পেছন কক্ষ হলো পাতালপুরীর প্রধান অংশ। সম্মুখের প্ল্যাটফর্মে রাখা ছিল তিনটি কফিন, মাঝখানকার কফিন খুবই বড়, তা হলো মিং বংশের সম্রাট চু ইচুনের কফিন, তার দু’পাশে দুটো কফিন হলো দুই রাণীর কফিন। তিনটি কফিনের চারদিকে রাখা ছিল ২৬টি সিন্দুক এবং জেড পাথর আর উত্কৃষ্ট চীনা মাটির ফুলদানি। তিংলিং সমাধিতে খননকাজে আবিষ্কৃত হয়েছে তিন হাজারেরও বেশী মূল্যবান পুরাকীর্তি নিদর্শনের জিনিসপত্র। তার মধ্যে ছিল রংবেরংয়ের সুন্দর বস্ত্র, পোষাক, সুক্ষ্ম স্বর্ণখচিত অলংকার এবং অতিবিরল সোনার পাত্র, জেড পাথরের শিল্পকর্ম, চীনামাটির জিনিস ইত্যাদি। এগুলো সবই মিং রাজবংশের কারুশিল্প গবেষণার জন্য মূল্যবান জিনিসপত্র।

(ছবি: মিং রাজবংশের ১৩ সমাধিতে আবিষ্কৃত পুরাকীর্তি নিদর্শন)