মিং রাজবংশের (১৩৬৮--১৬৪৪ খৃষ্টাব্দ) প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট চু ইউয়ানচাং-এর সমাধি হলো বিশ্বে বৃহত্তম প্রাচীন সম্রাট বা রাজার সমাধির অন্যতম।
মিং রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট চু ইউয়ানচাং (তাঁর শাসনামল ১৩৬৮ থেকে ১৩৯৮সাল পর্যন্ত) ছিলেন চীনের ইতিহাসে খুবই বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সম্রাট। তাঁর জন্ম এক গরীব কৃষকের পরিবারে। জীবিকার জন্য তিনি গৃহ ত্যাগ করে একটি স্থানীয় মন্দিরে সন্ন্যাসী হন। পরে ইউয়ান রাজবংশের(১২৭১--১৩৬৮ খৃষ্টাব্দ) প্রতিরোধে কৃষক বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেন। তিনি বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করেন এবং রণনৈতিক কলাকৌশলে পারদর্শী ছিলেন বলে একজন সাধারণ সৈনিক থেকে কৃষক বিদ্রোহী বাহিনীর নেতা হন। ১৩৬৮ সালে তিনি সম্রাট হয়েছেন বলে ঘোষণা করেন এবং অবশেষে চীনকে একত্রিত করেন ।
সম্রাট চু ইউয়ানচাং তাঁর শাসনামল থেকেই নিজের সমাধি নির্মাণ শুরু করেন, এটা নির্মাণ করতে মোট ২৫ বছর লেগেছে, তাঁর ছেলের আমলেই -শুধু সমাধিটি নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। মিং রাজবংশের প্রথম সম্রাট পূর্বচীনের নানচিং শহরে রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন, তাঁর ছেলে সম্রাট হবার পর রাজধানী নানচিং থেকে পেইচিংয়ে স্থানান্তরিত করেন। তাই নানচিং উপকণ্ঠে অবস্থিত সম্রাট চু ইউয়ানচাংয়ের সমাধি হলো নানচিংয়ে অবস্থিত মিং রাজবংশের একমাত্র সম্রাটের সমাধি । এই বংশের পরবর্তী ১৫ জন সম্রাটের কারো সমাধিই নানচিংয়ে নেই , বরং পেইচিংয়ে । ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী, নানচিংয়ের উপকণ্ঠে অবস্থিত সম্রাট চু ইউয়ানচাংয়ের সমাধির বৃত্তাকার প্রাচীর মোট ২২.৫ কিলোমিটার দীর্ঘ। এটা তখনকার রাজধানীর প্রাচীরের তিন ভাগের দুই ভাগ, তাই সমাধিটির আকার খুবই বিরাট। ৬ শো বছরের ঝড়ঝাপ্টা এবং যুদ্ধবিগ্রহ-জনিত ক্ষয়ক্ষতির ফলে আজ সমাধির কাঠনির্মিত কাঠামো-সম্পন্ন মন্দির আকারের ভবনগুলো বিধ্বস্ত হয়েছে, তবুও সমাধির পাথরের ভিত্তি থেকে এখনও স্পষ্টভাবে বুঝা যায় তখনকার সমাধির আকার আর বিন্যাস। মিং রাজবংশের এই প্রথম সম্রাটের সমাধির কাঠামো, বিন্যাস এবং স্থাপত্যশৈলী পরবর্তী সম্রাটদের সমাধির অনুরূপ এবং ঐ সব সমাধির চেয়ে অনেক বড়। এতে প্রমাণিত হয়েছে , মিং রাজবংশের পরবর্তী সম্রাটদের সমাধিগুলো সবই এই প্রথম সম্রাটের সমাধির অনুকরণ করেছে । মিং বংশের প্রথম সম্রাট চু ইউয়ানচাংয়ের সমাধির বিন্যাস আগেকার যাবতীয় রাজবংশের সম্রাটদের সমাধির বিন্যাস থেকে ভিন্ন । তার ‘দৈবপথ’ সোজা নয়, বরং আঁকাবাঁকা। প্রত্নতত্ত্ববিদরাও এর ভাল ব্যাখ্যা করতে পারছেন না। কেউ বলছেন, সম্রাট চু ইউয়ানচাংয়ের অদ্ভুত ইচ্ছা অনুযায়ী তা তৈরী হয়েছে, যাতে তাঁর অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ফুটিয়ে তোলা যায়। কেউ বলছেন, চু ইউয়ানচাংয়ের এই আঁকাবাঁকা ‘দৈবপথ’ নির্মাণের উদ্দেশ্য তাঁর ‘দৈবপথ’ আরও দীর্ঘ ও সুগভীর করা।
এই ‘দৈবপথ’ শুরু হয় ‘চতুষ্কোণ নগর’ থেকে। ‘চুতুষ্কোণ নগর’ ছিল এক ‘স্মৃতিফলক প্যাভিলিয়ন’, তার উপরিভাগ বিধ্বস্ত হয়েছে, এখন শুধু তার নিম্ন অংশ: চতুষ্কোণ-বিশিষ্ট দেয়াল অবশিষ্ট রয়েছে। এই ‘চুতুষ্কোণ নগরের’ ভেতরে রয়েছে একটি বড় আকারের পাথরের স্মৃতিফলক, সম্রাট চু ইউয়ানচাংয়ের ছেলের স্বহস্তে লিখিত বক্তব্যের অবিকল প্রতিরূপ এই ফলকে খোদিত হয়েছে। তাতে সম্রাট চু ইউয়ানচাংয়ের কীর্তিকলাপ বর্ণনা করা হয়, এই পাথরের ফলকে খোদিত চীনা চিত্রাক্ষরের মোট সংখ্যা ২৭৪৬। দৈবপথের মধ্য অংশে সারিবদ্ধভাবে স্থাপিত হয়েছে বিরাট পাথরের প্রাণী, যেমন, সিংহ, উট, হাতি, ঘোড়া ইত্যাদি। ৬ জোড়া মোট ১২টি পাথরের প্রাণী। তার পর উত্তর দিকে মোড় নিয়ে দৈবপথের দুপাশে স্থাপিত রয়েছে চার জোড়া মন্ত্রী এবং সেনাপতির পাথরমূর্তি। এই সব মূর্তির আকার প্রকাণ্ড। এগুলো মিং রাজবংশ আমলের পাথরভাস্কর্য শিল্পের উত্কৃষ্ট কর্ম।
সম্রাট চু ইউয়ানচাংয়ের সমাধির সবচেয়ে রহস্যময় স্থান হলো সম্রাট চু ইউয়ানচাং আর তাঁর রাণীর যৌথ সমাধির পাতালপুরী । পাতালপুরীর ওপর হলো বৃত্তাকারের একটি উঁচু প্রাচীর যা ১১০০ মিটারের বেশী দীর্ঘ। আসলে এটা একেবারে গোলাকার তা নয়, তার ব্যাস প্রায় ৪০০ মিটার। প্রাচীরের ভেতরে এক ছোট পাহাড়ের মতো কবর যার আকৃতি বিরাট গম্বুজের মতো, তার উচ্চতা সমুদ্রসমতল থেকে ১২৯ মিটার উঁচু। পাতালপুরী ঠিক কোন্ জায়গায় থাকে, সেই সম্পর্কে বরাবরই ভিন্ন ভিন্ন মত আছে। কেউ বলে, সম্রাট চু ইউয়ানচাংয়ের মৃতদেহ পাতালপুরীতে সমাধিস্থ করার আগে পরবর্তীকালে পাছে ডাকাতরা কবরের পাতালপুরীর ধনরত্ন লুঠ করে নেয়, তার জন্য রাজধানী শহরের ১৩টি দরজা থেকে একই সময়ে ১৩টি একই রকমের শবযাত্রা বেরিয়ে যায় , যাতে লোকেরা কোন্-টা আসল, কোন্-টা ঝুট বুঝতে পারে না।কেউ কেউ এমন-কি মনে করে, সম্রাট চু ইউয়ানচাংয়ের মৃতদেহ মোটেই নানচিংয়ে সমাধিস্থ করা হয় নি, বরং পেইচিংয়ে সামাধিস্থ করা হয়েছে। তাই সম্রাট চু ইউয়ানচাংয়ের মুতদেহ সত্যিই নানচিংয়ের উপকণ্ঠের এই জায়গায় সমাধিস্থ করা হয়েছে কিনা , তা শত শত বছর ধরে বরাবরই ছিল এক ধাঁধা। ১৯৯৭ সাল থেকে স্থানীয় পুরাকীর্তির নিদর্শন সংরক্ষণ বিভাগের কর্মীরা ম্যাগনেটিক অনুসন্ধান প্রযুক্তি এবং জি পি এস ভৌগোলিক অবস্থান নির্ণয় প্রভৃতি হাইটেক প্রযুক্তি এবং চীনের ঐতিহ্যিক কলাকৌশলের সমন্বিত পদ্ধতি অবলম্বন করে এই পাতালপুরীর চারদিকের ২০ হাজার বর্গমিটারেরও বেশী আয়তনবিশিষ্ট এলাকায় জরীপ চালিয়েছেন এবং বিশ্লেষণ করেছেন। তাতে ২০ হাজারের বেশি উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে এবং পরিশেষে সাফল্যের সঙ্গে পাতালপুরীর সঠিক অবস্থিতি জানা গেছে, সম্রাট চু ইউয়ানচাংয়ের মৃতদেহের কফিনের সঠিক জায়গা নির্ণয় করা হয়েছে। এই জরীপ পরিচালনাকারী বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, তাঁরা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ম্যাগনেটিক জরীপ প্রযুক্তি দিয়ে নির্ণয় করতে পেরেছেন যে, সম্রাট চু ইউয়ানচাংয়ের মৃতদেহ মাটির কয়েক ডজন মিটার নিচে সমাধিস্থ করা হয়েছে , এই পাতালপুরী অক্ষত অবস্থায় সংরক্ষিত আছে । অতীতে পাতালপুরীর ধনরত্ন চুরি হয়ে গেছে বলে যে সব জল্পনাকল্পনা বেরিয়েছিল , তা সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।
(ছবি: অতীতের মহিমাময় সম্রাট চু ইউয়ানচাংয়ের সমাধি)
(ছবি: সম্রাট চু ইউয়ানচাংয়ের সমাধিস্থানের ‘দৈবপথে’ মন্ত্রী ও সেনাপতিদের প্রস্তরমূর্তি)
মিং রাজবংশের প্রথম সম্রাট চু ইউয়ানচাংয়ের সমাধির পাতালপুরী ইতিহাসের অন্য যাবতীয় রাজবংশের সম্রাটদের সমাধি থেকে অনেক পৃথক । এবারকার জরীপ থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে যে, এই পাতালপুরীর সুড়ঙ্গ আঁকাবাঁকা এবং এই সুড়ঙ্গপথ পাতালপুরীর মধ্য কক্ষ-লাইন বরাবর নয় ,বরং কক্ষচ্যুত হয়েছে। কেন এরকম হয়েছে , তার কারণ এখনও স্পষ্ট জানা যায় নি। কিন্তু এই স্থাপত্যশৈলী মিং রাজবংশের পরবর্তী সম্রাটদের সমাধির স্থাপত্যশৈলীর ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছে । যেমন পেইচিংয়ে মিং বংশের ১৩ জন সম্রাটের সমাধির মধ্যে একমাত্র তিংলিং সমাধির পাতালপুরীর প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজ চালানো হয়েছে। তাতে দেখা গেছে পাতালপুরীর প্রবেশপথ মধ্য বা কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত নয়, বরং একটু বাঁ দিকে অবস্থিত । এটা মিং বংশের প্রথম সম্রাট চু ইউয়ানচাংয়ের সামাধির অবস্থার ঠিক উল্টা। প্রত্নতত্ত্ববিদরা আবিষ্কার করেছেন, সম্রাট চু ইউয়ানচাংয়ের কবর যে পাহাড়ে অবস্থিত , তার উপরিভাগের ৬০ শতাংশ হলো মানুষের নির্মিত স্থাপত্য। যেমন, কবরের ‘গম্বুজের’ওপরে বিছানো হয়েছে প্রচুর বড় বড় পাথর। সমাধি নির্মাণের সময়ে তখনকার শ্রমিকরা অনেক দূর থেকে এগুলো এখানে এনেছে , যার ফলে সমাধি দেখতে খুবই সুন্দর , তা’ছাড়া এতে বৃষ্টির পানি থেকে এই কবর রক্ষা করা যায় এবং চোর-ডাকাতরা সহজে খনন করে ভেতরে ঢুকতেও পারবে না । বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে, প্রত্নতত্ত্ববিদরা আবিষ্কার করেছেন যে, মিংবংশের প্রথম সম্রাট চু ইউয়ানচাংয়ের সমাধির সামনের ‘দৈবপথে’ স্থাপিত বিরাট আকারের প্রাণীর পাথরমূর্তিগুলো আসলে ৩০ কোটি বছর আগেকার অতিপ্রাচীন জীবাশ্মের পাথর দিয়ে তৈরী। একটি স্থানীয় রৌপ্যখনির উচ্চপদস্থ ইঞ্জিনিয়ার এই রহস্য আবিষ্কার করেছেন। অন্যান্য বিশেষজ্ঞও তাঁর এই আবিষ্কারকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। এই ইঞ্জিনিয়ার ২২টি প্রাণীর পাথরমূর্তিতে শৈবাল আর প্রবাল জাতীয় জীবাশ্ম আবিষ্কার করেছেন। কতকগুলো জীবাশ্ম খালি চোখে দেখা যায়, অন্যগুলো শুধু আতসী কাঁচ দিয়েই দেখতে হয় । এই আবিষ্কারের ফলে সম্রাট চু ইউয়ানচাংয়ের সমাধির ‘দৈবপথে’ স্থাপিত পাথরমূর্তিগুলোর তাত্পর্য বেড়েছে, সেগুলোর যেমন আছে ঐতিহাসিক মূল্য, শৈল্পিক মূল্য, তেমনই আছে বৈজ্ঞানিক গবেষণার তাত্পর্য।
|