সানসিংতুই পুরাকীর্তি নিদর্শন

      চীনের সিছুয়েন প্রদেশের কুয়াংহান শহরের নিকটে রয়েছে সানসিংতুই পুরাকীর্তি নিদর্শন। এটাও এক ধ্বংসাবশেষ, যার অস্তিত্ব ছিল তিন থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে, এটা প্রাচীন শু রাজ্যের ধ্বংসাবশেষ।  

  ১৯২৯ সালের বসন্তকালে একজন স্থানীয় কৃষক ক্ষেতে চাষাবাদের কাজ করতে গিয়ে হঠাত্ মাটির নিচ থেকে একটি সুন্দর জেড পাথরের জিনিস দেখতে পেলেন। এই জেড পাথরের জিনিস হলো প্রাচীন শু রাজ্যের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ একটি শিল্পকর্ম,যা বিশ্ববাসীদের ব্যাপক দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে । এ থেকেই তিন হাজার বছর আগেকার প্রাচীন সানসিংতুই সভ্যতা আবিষ্কৃত হয় । ১৯৮৬ সালে প্রত্নতত্ত্ব কর্মীরা এখানে দুটো বিরাট যজ্ঞকুণ্ডের খননকাজ চালিয়েছেন, তাতে এক হাজারেরও বেশি মূল্যবান পুরাকীর্তি নিদর্শনের জিনিসপত্র আবিষ্কৃত হয় এবং সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি হয় । এই প্রচুর পরিমাণ অভূতপূর্ণ , রহস্যময় বিরল পুরাকীর্তি নিদর্শনগুলোর আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে ধাঁধার মতো প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

  সানসিংতুই সভ্যতার একটি বৈশিষ্ট্য এই যে, এখানে মাটির নিচে থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে প্রচুর-সংখ্যক ব্রোঞ্জের মুখোশ। এর আগে চীনের মধ্য সমতলভূমি এলাকার হোনান প্রদেশেও প্রচুর সুন্দর ব্রোঞ্জ পাত্র যেমন ‘তিং’ নামক তিন-পা-বিশিষ্ট পাত্র এবং গামলা ,থালা ইত্যাদি ব্রোঞ্জপাত্র আবিষ্কৃত হয়েছিল , কিন্তু সেখানে ব্রোঞ্জ মুখোশ পাওয়া যায় নি। সানসিংতুই নামক স্থানে আবিষ্কৃত ব্রোঞ্জ মুখোশগুলোর প্রত্যেকটির মোটা ভ্রূ, খুব বড় চোখ, উঁচু নাক, চেপ্টা ঠোঁট আছে , কিন্তু চিবুক প্রায় নেই বলা যায় । মুখের ভাব হাসির মতো হলেও হাসি নয়, রাগের মতো হলেও সত্যিকারের রাগ বা ক্ষোভ নয় । এই সব ব্রোঞ্জ মুখোশ ভাল করে দেখলে লক্ষ্য করা যায় তার দুটো কানের প্রত্যেকটিতে আছে একটি ছোট ছিদ্র । এই মুখোশের মানুষের মুখের ধাঁচ আজকালকার স্থানীয় অধিবাসীদের থেকে অনেক তফাত, তাহলে এই মুখোশের আসল অর্থ কী? প্রত্নতত্ত্ববিদরা এখনও এর সঠিক উত্তর পান নি। 

  সানসিংতুই -এর ভূগর্ভ থেকে আরও আবিষ্কৃত হয়েছে একটি পাতলা এবং খুব উঁচু মানুষের ব্রোঞ্জমূর্তি, তার রূপের বৈশিষ্ট্য ব্রোঞ্জমুখোশের বৈশিষ্ট্যের মতো। মানুষটি ‘ সোয়ালো’ পাখির লেজের আকৃতি-বিশিষ্ট লম্বা জামা পরে, তার খালি পা, মানুষটি একটি উঁচু আসনে দাঁড়িয়ে আছে। ব্রোঞ্জমূর্তিটি১.৭ মিটার উঁচু। এটাই বিশ্বে আবিষ্কৃত প্রাচীনকালের উচ্চতম ব্রোঞ্জমূর্তি। এই ব্রোঞ্জনির্মিত মানুষের এক হাত উপরে ,অন্য হাত নিচে ,যেন একটি জিনিস ধরে রেখেছে। কিন্তু এই ব্রোঞ্জমূর্তি আবিষ্কৃত হবার সময়ে তার হাতে কোনো জিনিস ছিল না। বিশেষজ্ঞরা আন্দাজ করেছেন, এই সর এবং উঁচু ব্রোঞ্জমূর্তি দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে হাতে ভারী জিনিস থাকতে পারে না। থাকলে ভারসাম্য হারিয়ে মূর্তিটি কাত হয়ে মাটিতে পড়ে যেতো। বিশেষজ্ঞদের অনুমান এই যে, মূর্তিটির হাবভাব আর হাতের ভঙ্গি অনুযায়ী বিবেচনা করলে এটা যেন সাধারণ মানুষ নয়, সে হয়ত একজন ওঝা, নয়তো দেবতাও হতে পারে, যেখানে তার উপস্থিতি, সেটা এক যজ্ঞকুণ্ড হতে পারে । হয়তো সে যজ্ঞানুষ্ঠান পরিচালনা করছে। 

  মুখোশ আর মূর্তি ছাড়াও সানসিংতুই নামক জায়গার মাটি থেকে আরও আবিষ্কৃত হয়েছে, সোনার ছড়ি, ব্রোঞ্জের “দৈববৃক্ষ”, হাতির দাঁত ইত্যাদি । সোনার ছড়ি ১.৪২ মিটার লম্বা, তার ওপর সুন্দর ও রহস্যময় নকসা কাটা রয়েছে , এক জোড়া পাখি , পিঠের সঙ্গে পিঠ লেগে যাওয়া এক জোড়া মাছ এবং মাছের মাথায় এবং পাখির গলায় চাপিয়ে রাখা হয়েছে একটি তীরের মতো জিনিস, আরও আছে রহস্যের হাসি মুখ-সম্পন্ন এক মানুষের মাথার মূর্তি । ব্রোঞ্জের “দেববৃক্ষও” বিস্ময়কর । বৃক্ষ প্রায় ৪ মিটার উঁচু এবং তিন স্তরে বিভক্ত, বৃক্ষের মোট ৯টি শাখা । প্রত্যেক শাখায় দাঁড়িয়ে আছে একটি পাখি । গবেষণার ফলে জানা গেছে,এটা সাধারণ পাখি নয়, বরং সূর্যের প্রতীক এক দৈবপাখি। 

  বিশেষজ্ঞরা গবেষণা চালিয়ে উপলব্ধি করেছেন যে, সানসিংতুইতে আবিষ্কৃত প্রচুর সংখ্যক ব্রোঞ্জের জিনিসপত্রের মধ্যে চীনের প্রাচীন শু রাজ্যের সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্যের চিহ্ন যেমন সুস্পষ্ট দেখা গেছে, তেমনই পশ্চিম এশিয়া এবং অন্যান্য অঞ্চলের সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য খুবই স্পষ্ট । বিশেষ করে ব্রোঞ্জের মূর্তি, সোনার ছড়ি ইত্যাদি জিনিস বিশ্বে বিখ্যাত মধ্য-আমেরিকার মাইয়া সংস্কৃতি এবং প্রাচীন মিসরের সংস্কৃতির খুব কাছাকাছি, অর্থাত্ মিশ্র বৈশিষ্ট্য আছে । এটা “সংকর” ধরনের বৈশিষ্ট্যও বলা যায় । “সংকর” জাতির ব্রোঞ্জের জিনিসপত্র চীনের মধ্য সমতল ভূমি এলাকার ব্রোঞ্জ সংস্কৃতি থেকে সুস্পষ্টভাবেই ভিন্ন। তা’ছাড়া, যজ্ঞকুণ্ড থেকে আবিষ্কৃত ৭০টি হাতির দাঁত সহ অন্যান্য জিনিস দেখলে মনে হয় , সানসিংতুইয়ের প্রাচীন শু রাজ্য তার প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে , এমনকি আরও দূরের দেশের সঙ্গে পণ্য বিনিময় এবং আদানপ্রদান করেছে । এখানে পাওয়া মাটির তৈরী মদের পেয়ালা একই সময়পর্বের ইউরোপীয় কাপের অনুরূপ , সানসিংতুইয়ের পুরাকীর্তি নিদর্শন চীনের প্রত্নতত্ত্ব, নন্দনতত্ত্ব, ইতিহাসবিদ্যা ইত্যাদি ক্ষেত্রে কতকগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অভাব পূরণ করেছে।