সা’নসি প্রদেশের ফামেন মন্দিরে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান

      চীনের সা’নসি প্রদেশের ফুফেং জেলার ফামেন মন্দির একটি বিখ্যাত বৌদ্ধ মন্দির, যেখানে বুদ্ধদেব শাক্যমুনির পবিত্র দেহাবশেষের অংশবিশেষ সংরক্ষিত রয়েছে। ১৯৮৭ সালের এপ্রিল মাসে চীনের পুরাকীর্তি নিদর্শন বিষয়ক কর্মীরা ফামেন মন্দিরের প্যাগোডা পুনর্নির্মাণকালে অবলীলাক্রমে আবিষ্কার করেছেন যে, পুরনো প্যাগোডার ভিত্তির নিচে ছিল এক পাতালপুরি, পাতালপুরিতে সংরক্ষিত অতিমূল্যবান পুরাকীর্তি- নিদর্শনগুলো বিশ্বকে স্তম্ভিত করেছে । অনেকের মতে, এটা সা’নসি প্রদেশের ছিন সম্রাটের সৈন্য ও ঘোড়ার টেরাকোটা আবিষ্কার হওয়ার পর আর একটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার ।  

  ফামেন মন্দির সিআন শহরের ১২০ কিলোমিটার পশ্চিমে ফুফেং জেলায় অবস্থিত । চীনের উত্তর ওয়েই রাজবংশের আমলে ( ৪৯৯ খ্রীষ্টাব্দের কাছাকাছি সময়) এই মন্দির নির্মিত হয়। এই মন্দিরের স্বর্ণযুগ ছিল সপ্তম শতাব্দীর থাং রাজবংশের সময়। ফামেন মন্দির সম্প্রসারণ প্রকল্পে থাং রাজবংশীয় সরকার প্রচুর অর্থ এবং জনশক্তি নিয়োগ করেছিল। সম্প্রসারিত ফামেন মন্দিরে মোট ছিল ২৪টি উঠান, সন্যাসীদের মোট সংখ্যা ৫ হাজারেরও বেশী। এটাই ছিল থাংরাজবংশের রাজধানী এলাকার সবচেয়ে বড় বৌদ্ধমন্দির।  

  বৌদ্ধসূত্র অনুযায়ী, পাচীন ভারতের অশোক সম্রাট বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্য বুদ্ধদেব শাক্যমুনির সত্যিকারের দেহাবশেষকে বিভিন্ন অংশে ভাগ করে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সমাধিস্থ করার ব্যবস্থা অবলম্বন করেন । ফলে সারা বিশ্বে বুদ্ধদেবের দেহাবশেষের কিছু না কিছু অংশ সংরক্ষণের জন্য মোট ৮৪ হাজার প্যাগোডা নির্মিত হয়, তার মধ্যে চীনে নির্মিত হয় ১৯টি প্যাগোডা । আর ফামেন মন্দির হলো এই ১৯টির একটি । 

  ফামেন মন্দিরের প্যাগোডার মাটির নিচে বুদ্ধদেবের দেহাবশেষের অংশবিশেষ সংরক্ষিত রয়েছে বলে, খুব বেশী বৌদ্ধ পূজারী এই মন্দিরে ধুপ জ্বালিয়ে উপাসনা করতে আসেন, তাই এই মন্দিরের সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং এটা সুবিখ্যাত বৌদ্ধ মন্দিরে পরিণত হয় । চীনের ইতিহাসগ্রন্থে লিপিবদ্ধ রয়েছে যে, থাং রাজবংশের ৮ জন সম্রাট ফামেন মন্দির থেকে এক বা একাধিক বার বুদ্ধদেবের দেহাবশেষের বিশেষ অংশটি নিজেদের রাজপ্রাসাদে নিয়ে গিয়ে বেশ কিছুদিন সংরক্ষিত রেখে পূজা করেছিলেন এবং মন্দিরের জন্য উপহার হিসেবে প্রচুর সোনারূপা আর মণিরত্ন দান করেছিলেন , সেগুলোও ফামেন মন্দিরের পাতালপুরিতে সংরক্ষিত রাখা হয়। পরে বিভিন্ন আমলে সংঘটিত যুদ্ধবিগ্রহ, ভূমিকম্প ইত্যাদির কারণে ফানমেন মন্দিরের সেই ঐশ্বর্য আর কখনও ফিরিয়ে আনা যায় নি। 

  ১৯৮১ সালে ফামেন মন্দিরের ১৩ স্তরবিশিষ্ট বৌদ্ধপ্যাগোডা প্রবল বৃষ্টিপাতে ধ্বসে পড়েছে । ১৯৮৭ সালে সা’নসি প্রাদেশিক প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান দল এই বিধ্বস্ত প্যাগোডার ভিত্তির নিচে খননকাজ চালিয়েছে , ফলে ১১১৩ বছরের ইতিহাস-সম্পন্ন এই ফামেন মন্দিরের পাতালপুরি আবিষ্কৃত হয়েছে। 

  ফামেন মন্দিরের পাতালপুরী ২১.৪ মিটার দীর্ঘ। তার আয়তন ৩১.৪৮ বর্গমিটার,আর এই পাতালপুরী আবার ছয় ভাগে বিভক্ত : করিডোর, প্ল্যাটফর্ম, সুড়ং, সামনের কক্ষ, মধ্য কক্ষ এবং পিছনের কক্ষ। পাতালপুরীটিতে সংরক্ষিত রয়েছে থাং রাজবংশীয় আমলের প্রচুর পুরাকীর্তি নিদর্শন । প্রথম ধরনের জিনিস হলো বুদ্ধদেবের দেহাবশেষের অংশবিশেষ । দ্বিতীয় ধরনের জিনিস হলো এই পবিত্র অংশবিশেষ রাজপ্রাসাদে নিয়ে যাওয়ার এবং সেখান থেকে আবার মন্দিরে আনার সময়ে সম্রাটের দেয়া মূল্যবান উপহার, যেমন সোনা ,রূপা, মণিরত্ন, মুক্তা, জেডপাথরের কারুকার্য, চীনা মাটির জিনিসপত্র , রেশমী কাপড় ইত্যাদি মোট ৯০০টি মূল্যবান জিনিসপত্র। বিশেষ করে পাতালপুরীতে সংরক্ষিত বুদ্ধদেবের পবিত্র দেহাবশেষের বিশেষ অংশটি অমূল্য বলে গণ্য করা হয়। এটা ছিন সিহুয়াং সম্রাটের সৈনিক ও ঘোড়ার টেরাকোটা আবিষ্কৃত হবার পর চীনের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার। এটা চীন ও বিশ্বের বৌদ্ধধর্ম এবং বিশ্ব সংস্কৃতির ইতিহাসে এক বিরাট ঘটনা। 

  বুদ্ধদেবের পবিত্র দেহাবশেষ ছাড়াও ফামেন মন্দিরের পাতালপুরীতে সংরক্ষিত রেশমী কাপড়ের পরিমাণ আর রকমারিতা খুবই বেশি এবং খুবই মূল্যবান। এটাকে চীনের থাং রাজবংশের (৬১৮-৯০৭ খৃষ্টাব্দ) রেশমজাত দ্রব্যের মূল্যবান ভাণ্ডার বলে প্রশংসা করা হয় । অবশ্য উত্তরপশ্চিম চীনের কানসু প্রদেশের তুনহুয়াং নামক স্থানের গুহাগুলোতে সর্বপ্রথমে থাং রাজবংশ আমলের প্রচুর রেশমজাত দ্রব্য আবিষ্কৃত হয়েছিল । প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্য অনুযায়ী, ফামেন মন্দিরের পাতালপুরীতে সংরক্ষিত রেশমী কাপড়ের কারুকার্য খুবই সূক্ষ্ম। পোষাক সেলাই করার জন্য যে সোনালী সূতা ব্যবহার করা হয়, তার গড়পড়তা ব্যাস মাত্র ০.১ মিলিমিটার, মানে চুলের চেয়েও সরু বা চিকন। পাতালপুরীর একটি সিন্দুকে স্তুপাকারে সংরক্ষিত রেশমী কাপড়ের গাদার মোট উচ্চতা মাত্র ২৩ সেণ্টিমিটার, তার ভেতরে ভাজ আছে ৭৮০টি। অর্থাত্ রেশমী কাপড় খুবই পাতলা। 

  ফামেন মন্দিরের পাতালপুরীর খননকাজ থেকে ঝকঝকে উজ্জ্বল সোনা,রূপা আর ‘রঙিন চীনা মাটি’ ইত্যাদি দিয়ে তৈরী জিনিসপত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। ১৬টি বিশেষ রঙের চীনামাটির পাত্র পাওয়া গেছে, তাতে চীনামাটি- গবেষণাকারী বিশেষজ্ঞরা খুব অনুপ্রাণিত হলেন, কারণ এই বিশেষ রঙের চীনামাটির পাত্র হলো থাং রাজবংশের দরবারে বিশেষ-ব্যবহার্য রঙের চীনামাটির পাত্র । তা তৈরি করার কলাকৌশলের ধারাবাহিকতা বংশপরম্পরায় উত্তরাধিকার-সূত্রে বজায় রাখা সম্ভব হয় নি। মানে লোকেরা অনেক আগেই তা ভুলে গেছে , এমন-কি সত্যিকারের জিনিসও দেখে নি । শুধু প্রাচীন ঐতিহাসিক গ্রন্থে তার বর্ণনা পাওয়া যায় । থাং রাজবংশের রাজদরবারে ব্যবহৃত এই ‘বিশেষ রঙের চীনামাটি’র পাত্র তৈরি করার জন্য যে গ্লেজ ব্যবহার করা হত, তা খুবই উত্তম মানের । ফলে এই পাত্র এতোই উজ্বল যে, যেন সত্যিই তার ভেতরে পানি রাখা হয়েছে, চকচকে উজ্বল । 

  ফামেন মন্দিরের পাতালপুরীতে আবিষ্কৃত মূল্যবান পুরাকীর্তি নিদর্শন সংরক্ষণ ও প্রদর্শন করার জন্য স্থানীয় যাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে । চীনের পুরাকীর্তি সংরক্ষণ বিশেষজ্ঞরা জার্মান বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে সহযোগিতা চালিয়ে পাতালপুরী থেকে আবিষ্কৃত রেশমী কাপড় সংরক্ষণে হাইটেক প্রযুক্তি প্রয়োগ করেছেন । ২০০২ সালে পাতালপুরীটিতে সংরক্ষিত বুদ্ধদেবের দেহাবশেষের বিশেষ পবিত্র অংশবিশেষ প্রদর্শনির জন্য চীনের তাইওয়ান অঞ্চলে পাঠানো হয়েছিল।